মালয়েশিয়ার গভীর জঙ্গলে ১৩৯ গণকবর, ২৮ বন্দীশিবির

আতঙ্ক এখন গণকবর নিয়ে

আতঙ্ক এখন গণকবর নিয়ে। মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলে থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে মানব পাচারকারীদের পরিত্যক্ত আস্তানায় ১৩৯টি কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। দেশটির পুলিশ বিভাগ এ খবর নিশ্চিত করেছে। মালয়েশিয়া জাতীয় পুলিশপ্রধান খালিদ আবু বকর সোমবার এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে অভিযান চালিয়ে দেশদির পুলিশ সদস্যরা এসব কবর চিহ্নিত করেছেন। আর এর প্রায় সব কটিতেই একাধিক দেহাবশেষ থাকতে পারে। পুলিশপ্রধান এও জানিয়েছেন, এই ১৩৯টি কবরের সন্ধান পাওয়া যায় ২৮টি পরিত্যক্ত ক্যাম্পে।

পুলিশপ্রধান খালিদ আবু বকরের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, ওই সব গণকবর থাইল্যান্ডের খুবই কাছে এবং ওই সব পরিত্যক্ত ক্যাম্প ও কয়েক ডজন অগভীর কবরের সন্ধান তারা এ মাসেই খুঁজে পান। থাই সীমান্তের ৫০০ মিটার উত্তরে এসব কবর পাওয়া গেছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন খালিদ আবু বকর। এর মধ্যে একটি গণকবরের অবস্থান গত মাসে থাইল্যান্ডে পাওয়া কবর থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে। কবরগুলো থেকে দেহাবশেষ তোলার কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন মালয়েশীয় পুলিশপ্রধান। মানব পাচারকারীরা হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশুকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে পৌছে দেবে বলে সাগরে ভাসালেও হাজার হাজার অভিবাসীকে কোনো দেশই গ্রহণ করতে চায়নি। পরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া তাদের গ্রহণ করতে চাইলেও এখনো কয়েক হাজার অভিবাসী সাগরে ভাসছে। এক মাস আগে থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশের পাহাড়ি এলাকায় পাচারকারীদের ক্যাম্পে ওই গণকবরে ২৬টি দেহাবশেষ পাওয়ার পরই সাগরপথে মানব পাচারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসে। ধারণা করা হচ্ছে, বিভিন্ন স্থান থেকে অভিবাসন-প্রত্যাশীদের নৌকায় করে প্রথমে থাইল্যান্ডে আনা হয়। সেখানে জঙ্গলের মধ্যে পাচারকারীদের বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখা হয় তাদের। পরে সুযোগমতো তাদের আবার নৌকায় করে বা স্থলপথে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার দিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর এ ক্ষেত্রে শংখলা প্রদেশ ও পেদাং বেসারের ওই দুর্গম এলাকা পাচারকারীদের একটি রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। পাচারকারীরা তাদের বহু বছর ধরে পাচারকাজে দক্ষিণ থাইল্যান্ড ও উত্তর মালয়েশিয়ার গভীর জঙ্গল ব্যবহার করে আসছে। তারা এভাবে বহু ভাগ্যহতকে মালয়েশিয়ায় ঠেলে দিয়েছে, যাদের জায়গা হয়েছে বিভিন্ন ক্যাম্পে বা কারাগারে। আবার বহু অভিবাসন-প্রত্যাশীকে বরণ করতে হয়েছে মৃত্যু, যাদের হত্যা করা হয়েছে। বেঁচে থাকাদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খাদ্য ও পানির অভাবে। এমনকি তাদের অনেকে খাবারের অভাবে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে, নিজে নিজে উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এদের মধ্যে অনেকে রোহিঙ্গা, যাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। বেঁচে থাকার আশায় তারা অভিবাসী হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছে। আর বাকিরা বাংলাদেশের বাসিন্দা, যারা কাজের সন্ধানে পাড়ি জমাতে চেয়েছে মালয়েশিয়ায়। এর আগে ছয় মাস ঘুরে বিবিসির প্রতিবেদক তার অনুসন্ধানে তুলে এনেছিলেন, থাইল্যান্ডে সন্ধান পাওয়া পরিত্যক্ত ক্যাম্পের অনেকগুলোই থাই-মালয়েশিয়া সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে। আর গণকবরের সন্ধান মিলেছে সীমান্তের মাত্র কয়েকশ’ মিটারের মধ্যে। বিবিসির ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, থাই সমাজের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে মানব পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবর পাওয়ার পর মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড উপকূলে সাগরে ভাসমান অবস্থায় পাচারকারীদের কয়েকটি নৌকা থেকে তিন হাজারের বেশি মানুষকে উদ্ধার করা হয়, যারা বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। মালয়েশীয় পুলিশপ্রধান খালিদ আবু বকর এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গতকাল মালয়েশিয়ায় সন্ধান পাওয়া গণকবরের কথা জানান। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় ক্যাম্পটিতে আটকে রাখা হয়েছিল ৩০০ ভাগ্যহত মানুষকে। ওই কর্মকর্তা বলেন, তারা নিশ্চিত হয়েছেন, যাদের এখানে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে তারা মানব পাচারের শিকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি।

এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড। মালয়েশিয়ার পুলিশ চলতি মাসের শুরু থেকেই থাই সীমান্ত-সংলগ্ন পেদাং বেসার ও ওয়াং কেলিয়ান এলাকায় পাচারকারীদের আস্তানার খোঁজ পেলেও বিষয়টি রবিবার গণমাধ্যমে আসে। এদিন ১৭টি পরিত্যক্ত ক্যাম্পে ৩০টি কবরের সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহিদ হামিদি। পরদিন গতকাল এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য দেন দেশটির পুলিশপ্রধান। মালয়েশিয়ার পুলিশপ্রধান বলেছেন, ১১ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে ১৩৯টি কবর খুঁজে পেয়েছেন তারা। মানব পাচারকারীদের ২৮টি বন্দীশিবিরে কাছাকাছি জায়গায় এসব কবর খুঁজে পাওয়া গেছে। এসব কবরের অনেকগুলোতেই একাধিক লাশ কবর দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। এ ছাড়া থাই সীমান্তের কাছে অনেক অগভীর কবরও চিহ্নিত হয়েছে এর আগে। এসব কবরে সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ার পথে রওনা হওয়া শত শত বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গার লাশ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। থাইল্যান্ডের পর মালয়েশিয়ায়ও রবিবার গণকবরের সন্ধান পাওয়ার এক দিন পর গতকাল সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলছিলেন খালিদ আবু বকর। মিয়ানমারে সরকারের নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা কয়েক বছর ধরেই সমুদ্রপথে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবেশী মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ থেকেও কাঠের নৌকা বা মাছধরার ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টার ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। সার্বিক পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের মুখে বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাগর থেকে উদ্ধার করে সাময়িক আশ্রয় দিতে এবং নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে সম্মত হয়েছে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সহায়তায় সেখানে আটক বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এদিকে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম জানিয়েছে, মানব পাচারের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকে তারা এমন বহু লোকের সন্ধান পেয়েছে যারা বেঁচে থাকার চেষ্টায় থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আইওএমের থাই মিশনের প্রধান জেফরি ল্যাবোভিজ বলেন, এসব লোককে দেখেই বোঝা গেছে যে তারা আটকাবস্থা বা থাইল্যান্ডের কোনো ক্যাম্পে ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকের শরীরে আবার বেরিবেরি দেখা গেছে, যা কি না ভিটামিন বি-ওয়ানের অভাবে হয়। বিবিসিকে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এসব মানুষের মধ্যে বহু লোক রয়েছেন যারা কঙ্কালে পরিণত হয়েছেন এবং তাদের শরীরে কোনো চর্বি নেই। আছে শুধু জিরজিরে হাড়। এমনকি তারা তাদের শরীরের ভার বহন করতে সক্ষম নন। তারা পাচারকারীদের পণ্য। তাদের পরিণতিও অন্যদের মতো হতে পারত চাহিদামতো মুক্তিপণ না দিতে পারলে।’

এর আগে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বলেছিলেন, মালয়েশিয়ার মাটিতে অভিবাসন-প্রত্যাশীদের কোনো কবর আছে কি না তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি তার ফেসবুক ও টুইটারে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘দায়িত্বের সঙ্গে খুঁজে’ দেখতে।

এ ছাড়া বিবিসির প্রতিবেদক জোনাথন হেড বলেন, থাইল্যান্ডের পাশে মালয়েশিয়ায় অবস্থিত পাচারকারীদের ক্যাম্পগুলো এমন একটি জায়গায় অবস্থিত, যেখানে সেনা ও পুলিশের শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে। এ কারণে এখন এ প্রশ্ন উঠেছে যে, কেন এর আগে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।



মন্তব্য চালু নেই