আট বছরে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে অনেক দূর
আজ ৫ জানুয়ারি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন বছর পূর্তি। ২০১৪ সালের এই দিনে নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে ১২ জানুয়ারি সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
আগের পাঁচ বছর এবং বর্তমান তিন বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক দূর। প্রধানমন্ত্রী গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, গত আট বছরে চোখে পড়ার মতো অনেক উন্নয়ন আমরা করেছি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে উন্নয়ন হয়।
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর দরিদ্রসীমার নিচে ছিল ৯২ শতাংশ মানুষ। আর মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় ছিল ১০০ ডলার। সময়ের ব্যবধানে দেশে দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে সাড়ে ২৩ শতাংশে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে অতিদারিদ্র্যের হার এখন ১২ দশমিক ১ শতাংশ। মোট দেশজ আয়ে (জিডিপি) ৬ শতাংশের বাধা অতিক্রম করে প্রথমবারের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬৫ মার্কিন ডলারে। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তকমা ঝেড়ে ফেলার যোগ্যতা অর্জনের অনেকটাই দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ।
পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যক্তি খাতে প্রবৃদ্ধির সুবাদে সরকারের রাজস্ব আয় প্রত্যাশিত হারেই বেড়েছে। অবকাঠামোসহ নানা খাতে সরকার প্রতি বছর ব্যয় করছে লাখ কোটি টাকার বেশি। এক সময় খাদ্য চাহিদা পূরণ ও বাজেট বাস্তবায়নে বিদেশিদের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হয়েছে। বাংলাদেশ এখন আর খাদ্যসহায়তা নেয় না। পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পও নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উড্ডয়নের অপেক্ষায় রয়েছে।
এছাড়া অর্থায়নের অভাবে ১৯৬৪ সাল থেকে আটকে থাকা রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।১ লাখ ১৩ হাজার ৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। আর্থিক খাতে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেকটা সফলতা দেখাচ্ছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতি অনেক এগিয়েছে। এর স্বীকৃতিও পাওয়া গেছে বিভিন্ন মহল থেকে। তবে এটাও ঠিক যে, আমাদের সক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করা যায়নি। অর্থনীতিতে আমাদের প্রায় সব অর্জন এসেছে খেটে খাওয়া মানুষের হাত ধরে।
বিদায়ী বছরে প্রথমবারের মতো মোট দেশজ আয়ে (জিডিপি) ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখেছে বাংলাদেশ।বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে সাম্প্রতিক সময়ে নেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প। এসব প্রকল্প ঘিরেই আগামীতে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদনে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। তিন বছরের মধ্যেই ৮ শতাংশের ঘরে উঠবে প্রবৃদ্ধি। নতুন বছর ঘিরে এমনটা প্রত্যাশা করছেন সবাই।
১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের বাস। বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপ দেয়ায় তারা অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) হিসাবে বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ মানুষ এখন কর্মক্ষম। ২০২২ সালে কর্মক্ষম মানুষের হার ৬৯ শতাংশে উন্নীত হবে।
অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ কর্মবাজারে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। বিপুল জনশক্তির কর্মের নিশ্চয়তা দিতে অবকাঠামো উন্নয়নে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ।
বিদায়ী বছরে নিজস্ব অর্থায়নে অনেকটাই দৃশ্যমান হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রকল্পের অবকাঠামো। চলতি বছরের মধ্যে সেতুর মূল কাঠামো গড়ে তুলতে কর্মযজ্ঞ চলছে নদীর দুই পাড়ে। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৩৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
অবকাঠামো খাতে বেশ বড় কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এসব প্রকল্পের কাজ শেষে দেশের চেহারা অনেকটাই পাল্টে যাবে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ শেষ হলে মোট দেশজ আয় ১ শতাংশের বেশি বাড়বে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
এছাড়া রাজধানীর যানজট নিরসনে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলছে। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়নের কাজ চলছে। ইতোমধ্যেই ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক চার লেনে রূপান্তর করা হয়েছে। চার লেনের কাজ চলছে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ রেলপথগুলো ডাবল লাইনে উন্নীত করার কাজও চলছে।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হিসেবে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। আলোচিত কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটি। এসব প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতু ছাড়াও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। চলছে মেট্রোরেল নির্মাণের দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া।
রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে ২০১৮-এর ডিসেম্বরের মধ্যে। দ্রুত কাজ শেষ করতে এটিকে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে যোগ করা হয়েছে। জ্বালানি চাহিদা পূরণে মহেশখালীতে নির্মাণ হচ্ছে এলএনজি টার্মিনাল। তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির জন্যই এ টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
দক্ষ জনশক্তি বাড়াতে স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় তৈরি পোশাক, নির্মাণ, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, চামড়া এবং জাহাজ নির্মাণ খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে ৪৭ হাজার ৪শ’ জন এবং বেসরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে ২ লাখ ৬০ হাজার জনকে দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান ও ১ লাখ ৮২ হাজার জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কাজ চলছে।
কৃষিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে দেশ। জিডিপিতে কৃষির অবদান কমে বাড়ছে শিল্প খাতে।১৫ বছর ধরে জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বাস্তবায়নে সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এ খাতে প্রতি বছর ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও দাতারা শেষ পর্যন্ত ছাড় করেছে গড়ে ১৭৯ কোটি ডলার। লক্ষ্য অর্জনে অর্থ সঙ্কট বাংলাদেশের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। নিজস্ব সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে ২১টি টার্গেটের ১৩টি নির্ধারিত সময়ের আগেই অর্জন করা হয়েছে।
বাজেট বাস্তবায়নে বরাবর বড় ব্যর্থতা থাকলেও এবার অর্থনীতির প্রায় সবগুলো সূচক ইতিবাচক। রাজনৈতিক অবস্থা পরিস্থিতিশীল থাকায় চলতি অর্থবছর বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে বড় কোনো দুশ্চিন্তা নেই সরকারের। ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার বিশাল ব্যয়ের বাজেট বাস্তবায়নে অর্থমন্ত্রীর প্রধান ভরসার খাত রাজস্ব আয়। আগস্ট পর্যন্ত দুই মাসে রাজস্ব আয়ে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। দেশে বর্তমানে জিডিপির মাত্র ১১ শতাংশ কর আদায় হয়। এ হার ১৪ থেকে ১৫ শতাংশে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।
গত আট বছরে দেশে কৃষি খাতে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে প্রতি বছর সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে, তার শতভাগ পূরণ হচ্ছে। কৃষি বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন আবিষ্কার দেশকে শুধুই অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে। সামাজিক নিরাপত্তাসহ বেশ কিছু খাতে গুরুত্ব দেয়ায় সব মানুষের সক্ষমতাই বেড়েছে। ফলে বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার দিকনির্দেশনা সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রয়েছে বলে জানান সরকারের সিনিয়র সচিব পর্যায়ের এ কর্মকর্তা।
মন্তব্য চালু নেই