আজ মধুকবির ১৯২তম জন্মবার্ষিকী

‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব/বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!’ বাংলা সাহিত্যের অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবক্তা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯২তম জন্মবার্ষিকী আজ ২৫ জানুয়ারি।

১৮২৪ সালের আজকের দিনে যশোরের কেশবপুরের কপোতাক্ষ নদের পাড়ে সাগরদাঁড়ি গ্রামে মাইকেল মধুসূধন দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। প্রতিবারের মতো জন্মদিনকে ঘিরে ২২-২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সাগরদাঁড়িতে সপ্তাহব্যাপী মধুমেলা শুরু হয়েছে। তবে এবারের জন্মদিনকে ঘিরে কবির জন্মস্থানে মধুসূদন সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ।

মধুসূদন দত্ত জন্মগতভাবে বাঙালি হলেও পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণবশত তিনি প্রথম থেকে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। তবে জীবনের দ্বিতীয় পর্বে তার ভ্রম কাটে। মাইকেল নিজ মাতৃভাষায় প্রথমে নাট্যকার হিসেবেই সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। তার সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচরণের পূর্বে একটি ইতিহাস রয়েছে। বাংলা নাটকের ক্ষেত্রেও তা বাদ যায়নি।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা সাহিত্যের প্রভাবশালী নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। এজন্য তিনি নিজে নাটক লেখায় হাত দেন। রচনা করেন সাড়াজাগানো নাটক শর্মিষ্ঠা ও কৃষ্ণকুমারী।

বাংলায় সাহিত্য রচনার বেশ আগে ১৮৪৩ সালে মধুসূদন প্রশ্চাত্য প্রভাবে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। তখন থেকে তার নাম হয় মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ঘটনার পর বাবা রাজনারায়ণ দত্ত মধুসূদনকে ‘ত্যাজ্যপুত্র’ ঘোষণা করেন। তবে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণার পরেও মধুসূদনকে তার বাবা চার বছর ধরে অর্থ জোগান দিয়েছেন। পরে তিনি টাকা দেয়া বন্ধ করে দিলে চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়েন মধুসূদন। সেই নিদারুণ দারিদ্রের মধ্যেই রচনা করেন ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ নামে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি। মাত্র ২৫ বছর বয়সে লেখা কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর কবি ও দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

মোহভঙ্গ হলে ১৮৫৬ সালে দেশে ফিরে মধুসূদন একাগ্রচিত্তে বাংলায় সাহিত্য রচনা হাত দেন। ১৮৬১ সালে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচনা করেন ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’। যেখানে মূল রামায়ণে খলচরিত্র হিসেবে দেখানো রাবণ ও তার পুত্র ঈন্দ্রজিৎকে নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করেন মধুসূদন। ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রামায়ণের ঠিক বিপরীতে ‘স্রোত বহমান’ করানো এই উদ্যোগ তৎকালীন ভারতবর্ষে সহজ কাজ ছিল না। তবে তিনি সেই সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বাংলা সাহিত্যেকে নিয়ে যান অন্যন্য উচ্চতায়।

মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্রের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। বাবার মতো আইন ব্যবসায়ে তিনি সফল হননি। এছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের কারণে তিনি ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন (অর্থাভাবে) অবস্থায় তিনি মারা যান।

কবির মৃত্যুর পর তার ভাইয়ের মেয়ে কবি মানকুমারি বসু ১৮৯০ সালে কবির প্রথম স্মরণসভার আয়োজন করেন সাগরদাঁড়িতে। সেই থেকে শুরু হয় মধুমেলার। এর ধারাবাহিকতায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় জেলা প্রশাসন এবারও আয়োজন করেছে সপ্তাহব্যাপী মধুমেলার। ২২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এ মেলার উদ্বোধন করেন। মেলাকে ঘিরে এরই মধ্যে উৎসব আমেজের সৃষ্টি হয়েছে কেশবপুরসহ আশপাশের এলাকায়। মেলায় বিনোদনের নানা আয়োজন ছাড়াও প্রতিদিন মঞ্চে থাকছে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে এবার মধুকবির জন্মজয়ন্তী উৎসবকে ঘিরে কবির জন্মস্থানে মধুসূদন সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। এ দাবিতে গঠিত হয়েছে আন্দোলন কমিটি। যশোরবাসীর প্রাণের দাবি মহাকবি মধুসূদন দত্তের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের।

এদিকে, প্রতিবারের মতো এবারও মধুমেলা উপলক্ষে কপোতাক্ষের দু’পাড়ের যশোর ও সাতক্ষীরাবাসীর ভেতর ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। মেলা উপলক্ষে এবারও মেয়ে জামাইসহ আত্মীয় স্বজন আপ্যায়নে গ্রামের গৃহবধূরা প্রস্তুতি নিয়েছেন। মেলায় সার্কাস ও কুটির শিল্পসহ গ্রামীণ পসরার বৈচিত্র্যময় সমাহার রয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই