আজ জাতীয় শোক দিবস

আজ শুক্রবার ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩৯তম শাহাদত বার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের শোকাবহ এ কালোদিবসে সূর্য ওঠার আগে খুব ভোরে ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে স্বাধীনতা-বিরোধী চক্র নির্মমভাবে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
পৃথিবীর এ জঘন্যতম হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্ত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্ত:স্বত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোস্তাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনীদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায় আসলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামী লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়।
একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারি (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকান্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন। ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনীদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশীট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামীর উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।
১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ স্বাধীনতা-বিরোধী চক্রের নানা বাধার কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদ্বন্ড প্রদান করেন। অন্যদিকে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় প্রদান করে। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামীর মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদ্বন্ডাদেশ বজায় রাখেন। কিন্তু অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন।
২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিভক্ত রায় প্রদানের ফলে মামলাটি ডেথ রেফারেন্সে ও আপিল শুনানি দ্বিতীয় বেঞ্চের তৃতীয় বিচারকের কাছে স্থানাস্তরের প্রয়োজন দেখা দেয়ায় এর শুনানি উচ্চ আদালতের আরেকটি বেঞ্চে শুরু হয়। একই বছরের ৩০ এপ্রিল তৃতীয় বিচারক মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২৫ দিন শুনানির পর অভিযুক্ত ১২ জনের মৃত্যুদ্বন্ডাদেশ নিশ্চিত করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে।
দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামীকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন। ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর- ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন।
ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদ্বন্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামীর দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামীদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামীর ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় এমন এক সময়ে যখন তিনি জাতির জনক হিসেবে জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। যে কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ তার নিজস্ব অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতো। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল একাত্তরের পরাজিতদের প্রতিশোধ। যারা বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে মেনে নিতে পারেনি তাদের ষড়যন্ত্রেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।
১৫ আগস্টকে সামনে রেখে এ মাসের প্রথম দিন থেকেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এবারো সরকারিভাবে পালিত হচ্ছে দিবসটির বিভিন্ন কর্মসূচি। দিবসটিতে ইতোমধ্যেই সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।
আগামীকাল সরকারি কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে অর্ধনমিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন। এ ছাড়া বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার এবং সংবাপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে ধানমন্ডির ৩২নং রোডে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদান শেষে অনুষ্ঠিত হবে মোনাজাত ও কোরআন তেলওয়াত।
এছাড়াও ১৫ আগস্টে শাহাদাত বরণকারী জাতির জনকের পরিবারের সদস্য ও অন্যান্য শহীদের বনানী কবর স্থানে সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। পুস্পস্তবক অর্পন শেষে ফাতেহা পাঠ ও মুনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। এদিন সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে ফাতেহা পাঠ, প্রধানমন্ত্রীর পুষ্পস্তবক অর্পণ ও সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদানসহ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগ : আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সংগঠনের সকল স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। একই দিনে টুঙ্গিপাড়ায় সকাল ১০টায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
এ কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের একটি প্রতিনিধিদল উপস্থিত থাকবেন। এদিন বাদ জোহর দেশের সকল মসজিদে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সন্মেলন কক্ষে সর্বধর্ম প্রার্থনাসভার আয়োজন করা হয়েছে। বাদআছর বাংলাাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গনে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী িেলগর অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১৬ আগস্ট বিকাল ২টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। এতে প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভাপতিত্ব করবেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।
মহানগর আওয়ামী লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, মহিলা যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন শোক দিবস উপলক্ষে অনুরূপ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এছাড়াও ১৫ আগস্ট বাদ আসর দেশের সকল ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলায় মিলাদ মাহফিল এবং মন্দির, প্যাগোডা ও গীর্জায় বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
বঙ্গবন্ধুর ৩৯তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে ইসলামিক ফাইন্ডেশন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সকাল ৯ টায় বনানী কবরস্থানে কোরআনকানি, মিলাদ ও দোয়া মহিফিল, সাড়ে ১০ টায় বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, বেলা ১১ টায় বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে ‘ইসলাম প্রচার ও প্রসারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবদান’ শীর্ষক আলোচনা সভা, দুপুর ১ টা ৪০ মিনিটে বাযতুলমুকাররম জাতীয় মসজিদে জুমাআর নামাযের পর মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, বিকেল ৪ টায় একই স্থানে জাতির পিতার বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপর শোকগাথা আলোচনা সভা, সন্ধ্যা ৭ টায় বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে মিলাদ, দোয়া মাহফিল ও তবারক বিতরন।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী এবং জাতীয় শোকদিবস উপলক্ষে আরও যেসব সংগঠন কমৃসূচিগ্রহন করেছে সেগুলো হলো শেখ রাসের শিশু সংসদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় গণতান্ত্রিকলীগ, সেগুন বাগিচা নাগরিক সোসাইটি, ডিপ্লোমা বেকার নার্সেস এসোসিয়েশন, ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি, আওয়ামী পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা ফোরাম, বঙ্গবন্ধুলেখক পরিষদ, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি ইত্যাদি।



মন্তব্য চালু নেই