আজ কবি রজনীকান্ত সেন এর জন্মদিন

বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,/ কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই,/ আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে/ তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।/ বাবুই হাসিয়া কহে-সন্দেহ কি তায়? /কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়,/ পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,/ নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা। -‘স্বাধীনতার সুখ’ শিরোনামের এই কবিতাটি কার না জানা। কবিতাটির লেখক রজনীকান্ত সেন।
এ ধরনের আরো নীতি কবিতা লিখে গেছেন এই কবি। যেমন- ‘পরোপকার’ শিরোনামে -‘নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল,/তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,/গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,/কাষ্ঠ, দগ্ধ হ’য়ে, করে পরে অন্নদান,/স্বর্ণ করে নিজরূপে অপরে শোভিত,/বংশী করে নিজস্বরে অপরে মোহিত,/ শস্য জন্মাইয়া, নাহি খায় জলধরে,/ সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরহিত-তরে।’
আবার ‘বৃথাদর্প’ শিরোনামে -‘নর কহে, “ধূলিকণা, তোর জন্ম মিছে,/ চিরকাল পড়ে র’লি চরণের নীচে;”/ধূলিকণা কহে, “ভাই, কেন কর ঘৃণা?/ তোমার দেহের আমি পরিণাম কি না?”/ মেঘ বলে, “সিন্ধু, তব জনম বিফল,/ পিপাসায় দিতে নার এক বিন্দু জল;”/ সিন্ধু কহে, “পিতৃনিন্দ কর কোন্ মুখে!/ তুমিও অপেয় হবে পড়িলে এ বুকে।”
প্রতিভাবান কবি রজনীকান্ত সেন এর জন্মদিন আজ। ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই সিরাজগঞ্জের ভাঙাবাড়ি গ্রামে জন্ম এই কবির। কেবল কবিই নন, গীতিকার এবং সুরকার হিসেবেও বাঙালি শিক্ষা-সংস্কৃতিতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন রজনীকান্ত সেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমসাময়িক এই গীতিকারের গানগুলো খুবই জনপ্রিয়। ঈশ্বরের আরাধনায় ভক্তিমূলক ও দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ বা স্বদেশ প্রেমই তার গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও উপজীব্য বিষয়।
রজনীকান্ত সেনকে বলা হয় বাংলার ‘কান্তকবি’। রজনীকান্ত ১৮৮৩ সালে কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে ২য় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। ভালো ফলাফলের জন্য প্রতিমাসে দশ রূপি বৃত্তি পেতেন। ১৮৮৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে ২য় বিভাগে এফএ পাস করেন। সিটি কলেজ থেকে ১৮৮৯ সালে বিএ পাস করেন। ওই কলেজ থেকে ১৮৯১ সালে বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। ওই বছরই রাজশাহী আদালতে যোগ দিয়েছিলেন আইন ব্যবসায়।
শৈশবকাল থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলা ও সংস্কৃত- দুই ভাষাতেই কবিতা লিখতেন। কবিতাগুলোকে গান আকারেও রূপ দিতে শুরু করেন। ১৫ বছর বয়সে কালীসংগীত রচনা করেন। পরে আইন পেশার পাশাপাশি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষত সংগীত, সাহিত্য, নাটকে অভিনয় ইত্যাদিতে গভীরভাবে যুক্ত থাকেন। তার কবিতা স্থানীয় উৎস, আশালতা প্রভৃতি সংবাদ-সাময়িকীতে প্রকাশিত হতো।
রজনীকান্ত শৈশবকাল থেকে সংগীতপ্রিয়। কোথাও কোনো সুমধুর গান শুনলেই সুর, তালসহ তৎক্ষণাৎ তা কণ্ঠস্থ করতে পারতেন। তার বাবাও একজন সংগীতজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ফলে শৈশবে সংগীত অনুশীলনের সুযোগ ঘটে। কলেজ জীবনে অভিষেক ও বিদায় অনুষ্ঠানে তার গান গাওয়া হতো। গান লেখায় তার সময় বেশি লাগত না। এ ছাড়া অল্প সময়ে গানগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠে। স্বদেশি আন্দোলন ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতায় তার গান ছিল প্রেরণার উৎস। বিশেষ করে ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই’ গানটি স্বদেশি আন্দোলনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, প্রীতিমূলক ও হাস্যরস- চার ধরনের গানেরই রচয়িতা তিনি। তারমধ্যে দেশাত্মবোধক গানের আবেদনই বিশাল ও ব্যাপক। এখনও বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক শিল্পী তার গানগুলো গেয়ে ধাকেন। এ ছাড়া আধ্যাত্মিক গানের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তার গানগুলো হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ঘারানার। এতে কীর্তন, বাউল ও টপ্পার যথাযথ সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
জীবদ্দশায় তার তিনটি বই প্রকাশ হয়- বাণী (১৯০২), কল্যাণী (১৯০৫) ও অমৃত (১৯১০)। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়- অভয়া (১৯১০), আনন্দময়ী (১৯১০), বিশ্রাম (১৯১০), সদ্ভাবকুসুম (১৯১৩) ও শেষদান (১৯১৬)। এর মধ্যে বাণী ও কল্যাণী হচ্ছে গানের সঙ্কলন।
তার লেখা গানগুলো ‘কান্তগীতি’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ এবং ভারতের অনেক সঙ্গীত শিল্পী কান্তগীতি গেয়েছেন।
তন্মধ্যে – কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, নীলা মজুমদার, পান্নালাল ভট্টাচার্য্য, অনুপ ঘোষাল, নিশীথ সাধু, হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত আচার্য্য, অর্ঘ্য সেন, জুঁথিকা রায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতী মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, ইফফাত আরা দেওয়ান, উৎপলা সেন প্রমুখ অন্যতম।
রজনীকান্ত ওকালতি পেশায় গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি শরৎ কুমার রায়কে চিঠিতে জানিয়েছিলেন – ‘কুমার, আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু আমি ব্যবসায় করিতে পারি নাই। কোন দুর্লঙ্ঘ্য অদৃষ্ট আমাকে ঐ ব্যবসায়ের সহিত বাঁধিয়া দিয়াছিল, কিন্তু আমার চিত্ত উহাতে প্রবেশ লাভ করিতে পারে নাই। আমি শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম; কবিতার পূজা করিতাম, কল্পনার আরাধনা করিতাম; আমার চিত্ত তাই লইয়া জীবিত ছিল।’
-একান্ত অনুগত শ্রীরজনী কান্ত সেন।
১৯০৯ সালে রজনীকান্ত কণ্ঠনালীর প্রদাহজনিত কারণে সমস্যা ভোগ করতে থাকেন। তিনি কলকাতার বিভিন্ন প্রথিতযশা ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। কিন্তু তাঁর অবস্থার আর উত্তরণ হয়নি, বরঞ্চ উত্তরোত্তর অবনতি হতে থাকে। এ সময় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রজনীকান্ত সেনকে দেখার জন্যে হাসপাতাল পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন। রজনীকান্তের শেষ দিনগুলো ছিল অসম্ভব ব্যথায় পরিপূর্ণ। তিনি ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর লোকান্তরিত হন।
কবি সুকান্তের মতো অকালে মৃত্যুবরণ করেন রাজশাহীর কবি ও গীতিকার রজনীকান্ত সেন। আজ চর্চা নেই তার অমূল্য সাহিত্য কীর্তির। এমনকি তার শেষ স্মৃতি চিহ্ন রাজশাহীর বসত বাড়িটিও নাকি সংরক্ষণ করা হয়নি আজো। অথচ কবি নজরুল এ বাড়িটির সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে কবি রজনীকান্ত সেন’র প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রাচীন যুগের স্বদেশী গানের স্রষ্টা, গীতিকার, সুরকার, আজো তুমি গানের মাঝে অমর হয়ে আছো, তোমাকে নমস্কার।’
ক্ষণজন্মা রজনীকান্তের জীবনের সাথে বিদ্রোহী কাজী নজরুলের জীবনের এক বিস্ময়কর মিল পাওয়া যায়। উভয় ছিলেন ক্ষণজন্মা কবি। মেধা বিকশিত হওয়ার প্রাক্কালে স্বল্প বয়সে নির্বাক হয়ে যান। তারা দু’জনই যে কোন পরিবেশে চটজলদি গান-কবিতা লিখতে পারতেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীকারের আন্দোলনে উভয়ের ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা। আবার দু’জনের জীবদ্দশায় সন্তানের অকাল মৃত্যু ঘটে।
রজনীকান্ত সেনের লেখা গানের লিঙ্ক : https://www.youtube.com/watch?v=d4twVaVrYJ4

































মন্তব্য চালু নেই