আগাম নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে সরকার

আন্তর্জাতিক চাপ ও রাজনীতির গুমোট পরিস্থিতির অবসানে আগাম নির্বাচন দিতে পারে সরকার। শিগগির না হলেও ২০১৯ সালে মেয়াদ পূরণের আগেই নির্বাচন দেওয়ার বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। এর মধ্যে সুবিধাজনক যেকোনো সময় নির্বাচন দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পশ্চিমা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কিছুটা রক্ষার কথা ভাবছে সরকার। নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হবে—ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রকাশ্যে এমন বক্তব্য দিলেও আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় মেয়াদ পূর্তির আগেই যেকোনো সময় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে। সরকারের কট্টর সমর্থক হিসেবে পরিচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের চাওয়াও এ রকমই। আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা-মন্ত্রী নাম না প্রকাশের শর্তে এমনটা জানিয়েছেন।

ওই নেতাদের মতে, নির্বাচনে নিশ্চিত জয় পাওয়া যাবে, এমন একটি সুবিধাজনক সময় খুঁজছে সরকারের নীতিনির্ধারণী উচ্চ পর্যায়। এ সরকারের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার কিছু আগে হলেও একটি আগাম নির্বাচন দেওয়া হতে পারে। কারণ প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বাইরে রেখে আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি কারো জন্যই ভালো ফল আনবে না। তবে আগাম নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ছাড়তে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে কট্টর সমর্থক দেশের প্রধানমন্ত্রী চান, আমরা যেন একটি আগাম নির্বাচন দিই। তাঁর এ ধরনের মনোভাব আমাদের সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানানো হয়েছে। তিনি (ওই দেশের প্রধানমন্ত্রী) চান, শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী থাকুক, কিন্তু একটি আগাম নির্বাচন হোক। কারণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে একটি কমিটমেন্ট করা হয়েছিল। তবে সে নির্বাচন এখনই দিতে হবে তিনি (ওই প্রধানমন্ত্রী) এমনটা বলেননি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আওয়ামী লীগ নেতা আরো বলেন, ‘প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সরকারকে একটি আগাম নির্বাচনের দিকেই যেতে হবে। সেটি মেয়াদ পূরণের ছয় মাস আগে হলেও। কারণ এ বছরের মাঝামাঝি থেকেই আগাম নির্বাচনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে; যদিও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাই আগাম নির্বাচনের বিরুদ্ধে। কিন্তু একটি গুমোট পরিস্থিতি দূর করে ইতিবাচক রাজনীতি শুরু করতে না পারলে গণতন্ত্রের বিপদ কাটবে না।’

ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের সূত্রগুলো জানায়, সম্প্রতি দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বিএনপি তাদের রাজনৈতিক দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে মিত্র দুই-তিনটি দেশকে বড় ধরনের চাপ দিয়েছে। ফলে ওই দেশগুলো আগাম নির্বাচনের বিষয়ে বেশ কিছুদিন চুপ থাকলেও এখন আবার সক্রিয় হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন লবি রক্ষা করে চলেন, আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ এমন নেতাদের ওপর ওই দেশগুলো নানাভাবে চাপ তৈরি করছে।

দলীয় সূত্রগুলো জানায়, আন্তর্জাতিক ওই মহল থেকে বিএনপিকে আগাম নির্বাচনের আশ্বাস এবং কিছু পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। সংসদ থেকে ছিটকে পড়া বিএনপিকে আবারও সংসদে ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্ত করতে চায় ওই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী। এ পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার অধীনেই একটি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। রাজনীতিতে চরম বেকায়দায় থাকা বিএনপির নেতৃত্বও এটি মেনে নিয়েছেন। ফলে তারা আন্দোলনের বদলে নির্বাচনের পথে চলতে শুরু করেছে। দুই দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোট দখলের অভিযোগ করলেও শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়নি। জাতীয় নির্বাচনের কথা ভেবেই অনেক জায়গায় প্রার্থীরা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হলেও এবং মাঠে নামতে না পারলেও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে না বিএনপি।

দলীয় সূত্রগুলো জানায়, এত দিন বিএনপি মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বললেও শিগগিরই তারা এ দাবি থেকে সরে যাবে। আগামী জুলাই থেকে তারা আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারে। সে ক্ষেত্রে তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের বদলে আগাম নির্বাচন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে জোরালো করতে তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট দখলের বিষয়টি সামনে আনবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মেনে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা আসতে পারে। বিএনপিও তা মেনে নেবে।

দলীয় সূত্রগুলো জানায়, প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার পক্ষে ভোট কেমন পড়ছে তা মূল্যায়ন হবে। সরকারের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে প্রার্থী মনোনয়নে একটি বিশেষ সংস্থার প্রতিবেদনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তৃণমূল মনোনীত কিংবা কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা বা মন্ত্রী-এমপিদের ঘনিষ্ঠরাও মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কেমন সমর্থন আছে তা বুঝে সরকার জাতীয় নির্বাচনের কৌশল নির্ধারণ করবে।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর দুইজন নেতা জানান, আগাম নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জামায়াতকে রাজনীতি থেকে একঘরে করে ফেলা হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এখন চায় জামায়াতকে ছেড়ে বিএনপি জাতীয় সংসদে ভূমিকা রাখুক। যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও মীর কাসেম আলীর দণ্ড কার্যকর হলে জামায়াতকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে সময়ের ব্যাপার। বিএনপির নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির বেশির ভাগ নেতাই জামায়াতকে ছাড়ার পক্ষে। বিএনপি জামায়াতকে ত্যাগ করার পরই নির্বাচনের ঘোষণা আসবে।

ওই নেতাদের মতে, শুধু জামায়াত নয়, আগাম নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে জাতীয় পার্টির রাজনীতিরও অবস্থান নির্ধারণ হবে। বর্তমানে দলটির যে অবস্থা তাতে আগামী নির্বাচনে তাদের অবস্থান খুবই শোচনীয় হবে। এক-দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো আসনেই জাতীয় পার্টির নেতাদের জয়ের সম্ভাবনা নেই। ফলে সে নির্বাচনের আগে দলটির গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাই আওয়ামী লীগে যোগ দিতে পারেন।

দলীয় সূত্রগুলো জানায়, আগামী নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই দল গোছাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি সম্প্রতি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও এর অধীন থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন কমিটি ঘোষণা করেছেন। কমিটিতে পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব রাখবেন এমন নেতাদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের আগামী কেন্দ্রীয় কাউন্সিলেও নেতৃত্ব নির্বাচনে জনপ্রিয়তা আছে এবং ভালো সংগঠক এমন নেতাদের গুরুত্ব দেওয়া হবে। নানা কারণে বিতর্কিত হয়েছেন, এমন অনেক নেতাই কমিটি থেকে বাদ পড়বেন।

দলীয় সূত্রগুলো জানায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করা হয়, নিয়ম রক্ষার ওই নির্বাচনের এক বছর পরে আরেকটি নির্বাচন দেওয়া হবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সে অবস্থান থেকে সরে যায় সরকার। বিএনপি-জামায়াতের সরকার পতনের কর্মসূচি সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারা এবং ভারতের জোরালো সমর্থন নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ সামলে উঠতে পারায় আর নির্বাচনমুখী হয়নি সরকার।

তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ জানান, সরকার আগাম নির্বাচনের বিষয়ে ভাবছে না। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আগাম নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের ওপর কোনো চাপ নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট। এ ছাড়া বিশ্বমন্দার মধ্যেও আমাদের অর্থনৈতিক অর্জনকে তারা স্বীকৃতি দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই।’

আগাম নির্বাচনে আন্তর্জাতিক চাপের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান অ্যাম্বাসাডর জমির বলেন, ‘ওসব নিয়ে এখন মাথা ঘামাচ্ছি না। দেশ বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ সময় নির্বাচনের কথা বলা কার স্বার্থে?’ কালের কণ্ঠ



মন্তব্য চালু নেই