অসময়ের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল : হাওর জুড়ে কৃষকের কান্না, হাহাকার

শস্য ভাণ্ডারখ্যাত নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী, মদন, বারহাট্টা, কেন্দুয়া ও কলমাকান্দা উপজেলায় রয়েছে ছোট বড় একশ’ ৪০টি হাওর। এই হাওরের ফসলকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখেন হাজার হাজার কৃষক। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্নের কাল হয়েছে অসময়ের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল।

অসময়ে প্রবল বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙ্গে হাইজদ্যা ফসল রক্ষা বাঁধসহ ডিংগাপুতা, কির্তনখলা, মান্দাউড়া বাঁধ ভেঙ্গে নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। এখন হাওর জুড়ে শুধু কৃষকের হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস। হাওরবাসীর একমাত্র স্বপ্নের ফসল ঘরে তুলতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা। অর্থাভাবে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে তাদের।

কৃষকদের অভিযোগ, আমাদের এই দু:সময়েও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও খোঁজ নিচ্ছে না। এমনকি এখনো মেলেনি কোন সরকারি-বেসরকারি সাহায্য।

কৃষি অফিসের তথ্য মতে, হাওরে প্রায় ৪১ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে শনিবার (৮ এপ্রিল) পর্যন্ত প্রায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া অতিবর্ষণে পানি বেড়ে ও জলাবদ্ধতায় জেলার আরো ৩৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।

স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনিয়ম ও গাফিলতির কারণে এই দুর্যোগে পড়তে হয়েছে তাদের।

জেলার মোহনগঞ্জের তেঁতুলিয়া ঘাটে শুক্রবার (৭ এপ্রিল) বিকেলে অল্প কিছু ছোট মাছ নিয়ে বসে আছেন এলাকার ইদ্রিস মিয়া। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, ধার-দেনা করে এক একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলাম। আজ সব কিছুই পানির নীচে। ঘরে চাল নেই তিন দিন ধরে। বাড়িতে ছোট বড় সদস্য পাঁচজন। সকালে বত্রিশ টাকা দিয়ে এক কেজি আটা কিনে চাঁ বানিয়ে খেয়ে এক বেলা পার করেছিন। বাকী বেলার খাবার জোগাতে জাল নিয়ে বের হই। অল্প কিছু মাছ পেয়েছি ক্রেতার আশায় তা নিয়েই বসে আছি। যদি কিছু পায় তা দিয়েই চলবে আরেক বেলা খাবার।

একটু এগিয়ে একটি বাড়িতে প্রবেশ করতেই মুহুর্তের জড়ো হয় গোটা পঞ্চাশেক নারী-পুরুষ। সবার চোখে মুখেই হতাশা আর বিষন্নতার ছাপ। যে সময়টুকু তারা পার করতেন ফসল তোলার কাজে। আজ সবাই কর্মহীন অলস সময় পার করছেন। সেই বাড়ির সেলিম মিয়ার স্ত্রী পারুল বেগম জানান, দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্বামী স্ত্রীর সংসার তাদের। তিন সন্তানের পড়ালেখা বাবদ খরচ অনেক। কিন্তু এবছর সব হারিয়ে আমাদের পরিবার আজ নিঃস্ব। যা সহায় সম্বল ছিল সব বিক্রি করে ত্রিশ চল্লিশ কাঠা বোরো আবাদ করেছিলাম। আগাম পানি এসে সব তলিয়ে দিয়েছে। বাকী সময়টুকু কিভাবে পার করব, কি খাব, ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা কি দিয়ে করাব বুঝে পাচ্ছিনা।

তেতুঁলিয়া বাজারের ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, হাওরবাসীর একমাত্র দু:খ বাঁধ। সরকার যদি সঠিকভাবে সময়মত বাঁধ মেরামত করে, তাহলে অনেক ফসল আগাম পানির হাত থেকে রক্ষা পাবে। আমাদের দাবি হাওরের ফসল রক্ষায় সরকার যেন স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা করেন।

খালিয়াজুরির কির্তনখলা বাঁধ এলাকায় কথা হয় ষাঁটোর্ধ্ব আবুল কাশেমের সঙ্গে। তিনি জানান, আমরা ছোড (ছোট) বেলা থাইক্কা (থেকে) দেইক্কা আইছি হাওরে পানি আয় বৈশাকের বিশের পরে, কিন্তু এনবার পানি আইয়া পড়ছে এক মাস আগে। এই এক মাসে হাওরের মাইনসে (মানুষে) ধান তুইল্লা (তুলে) ঝর ঝরা অনয়া যাইত।

নেত্রকোনা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সাংবাদিক শ্যামল পাল জানান, হাওর অঞ্চলের নব্বই শতাংশ মানুষের ঘরে খাবার নেই। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি, যাতে শিগগিরই হাওর অঞ্চলকে জরুরি দুর্যোগপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে পর্যাপ্ত ত্রানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিলাস চন্দ্র পাল জানান, ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের পাশে থেকে পরামর্শ দিচ্ছে জেলা কৃষি বিভাগ। আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারনে কাজ চলছে বলে জানান তিনি।

তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতিকে দায়ি করে বলেন, সময়মতো বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ করা হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক কম হতো।

পানি উন্নয়ন বের্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু তাহের জানান, জেলার ২শ’ ৮০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ৩১ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ রয়েছে। এগুলো চিহ্নিত করে একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। আর বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের কথা অস্বীকার করেন তিনি।

জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আনোয়ার হোসেন আকন্দ জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ত্রিশ হাজার কৃষকের একটি তালিকা তৈরী করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ত্রান মন্ত্রণালয় থেকে ১৫৩ মেট্রিক ট্রন চাল বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই বরাদ্ধ আরো বাড়ানো হবে।

এদিকে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহ উদ্দিন জানান, নেত্রকোনা হাওর এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে এবং তার আলোকে ইতিমধ্যে কাজও শুরু হয়ে গেছে।

এবছর জেলায় ১ লাখ ৮৪ হাজার ৩শ ৮২ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হলেও শুধু হাওর অঞ্চলেই আবাদ হয়েছিল ৪০ হাজার ৬শ ২০ হেক্টর।



মন্তব্য চালু নেই