অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতে ধারাবাহিক অগ্রগতি

২০১৫ সালে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের সূচকে ধারাবাহিক উন্নতি হয়েছে।

বছরের প্রথম তিন মাস দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সরকারের সার্বিক সহযোগিতা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে দেশের অর্থনীতি ও আর্থিক খাত সুদৃঢ় অবস্থায় আছে।

মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ইকোনমি ২০১৫: পারফরম্যান্স অ্যান্ড আউটলুক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। এতে ২০১৫ সালের সামগ্রিক অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে ২০১৫ সালের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক, ব্যাংকিং খাতের সূচক, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, কৃষি খাত, এসএমই খাত, গ্রিন ব্যাংকিং, সিএসআর, মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, ব্যাংক ও শাখার সংখ্যা, গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ, ডিজিটালাইজেশন, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সহজীকরণ এবং সুপারভিশন জোরদারকরণের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

এতে বলা হয়, সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থসামাজিক উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গত কয়েক বছরের মতো এবারও বাংলাদেশ ব্যাংক বিচক্ষণ মুদ্রানীতি গ্রহণ করছে। পাশাপাশি অব্যাহত রেখেছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর ব্যাংকিং কার্যক্রম।

সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পাশাপাশি অর্জিত হয়েছে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় ভাল সাফল্য।

জিডিপি: ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ০৫ শতাংশ। সেখানে সর্বশেষ অর্থবছর ২০১৪-১৫ এর ৬ দশমিক ৫১ শতাংশসহ গত ছয় অর্থবছরে গড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি মন্দার পরিবেশেও অব্যাহতভাবে গড়ে ছয় শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। এ ধরনের প্রবৃদ্ধি বিশ্বেও বিরল।

মূল্যস্ফীতি: বাংলাদেশ ব্যাংক বিচক্ষণ মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতির হারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ইতোমধ্যেই এতে সাফল্য এসেছে। ২০১১ এর পর থেকে মূল্যস্ফীতির হার ধারাবাহিকভাবে কমছে। বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ডিসেম্বর ২০১৪ ও জুন ২০১৫ এর যথাক্রমে ৬ দশমিক ৯৯ ও ৬ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে আরো কমে নভেম্বর ২০১৫ শেষে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা সন্তোষজনক ও সহনীয়।

আমদানি: ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট আমদানি ব্যয় হয়েছিল ২২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, সেখানে গত অর্থবছরে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৪০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি।

বছরের শেষভাগে এসে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঊর্ধ্বমুখী ধারা সামনের দিনগুলোতে উৎপাদন বাড়ানোর শক্ত পাটাতন তৈরি করতে সাহায্য করেছে। নভেম্বর, ২০১৫-তে এলসি খোলা ও সেটেলমেন্ট গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৯ এবং ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।

রপ্তানি: ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ১৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, সেখানে গত অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৩১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ১২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।

রেমিট্যান্স: ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রেকর্ড ১৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের সমান।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ: ২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা সাড়ে তিনগুণের বেশি বেড়ে ২৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। যা দিয়ে দেশের আট মাসের মতো আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ উন্নয়নে জোরালো ভূমিকা রাখছে। বৈদেশিক অর্থনৈতিক খাতের এই শক্তির জোরেই বর্তমান সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে।

টাকার বিনিময় হার: টাকার মূল্যমান দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ও উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশগুলোর মুদ্রার তুলনায় অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ও জোরালো অবস্থানে রয়েছে। সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বর তারিখে ডলার-টাকার গড় বিনিময় হার ছিল ৭৮ দশমিক ৭০ টাকা।

মাথাপিছু আয়: পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য মতে, গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩শ ১৪ ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছর শেষে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৪৪ ডলার।

এখানে উল্লেখ্য যে, গড় মাথাপিছু আয়ের এই অর্জনের কারণে দাতা সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে নিম্ন-মধ্যম দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়।

ব্যাংকিং খাতের সূচক: প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাত এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও রেসিলিয়েন্ট বা ঝুঁকিসহনে সক্ষম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংকিং খাতের সূচকগুলো দিন দিনই শক্তিশালী হচ্ছে।

মূলধন পর্যাপ্ততা: ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী কি না তার অন্যতম পরিমাপক মূলধন পর্যাপ্ততা। ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা সংক্রান্ত ব্যাসেল-২ নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের পর এ বছর থেকেই ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন করার পথ-নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে।

এর আওতায় জুন ২০১৫ শেষে মূলধন পর্যাপ্ততার হার ছিল ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে এ হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিক মানদন্ড আট শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি।

আমানত ও ঋণ: অক্টোবর ২০১৫ শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানত ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ২৫ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৭০ হাজার ৬২০ কোটি। ঋণের প্রবৃদ্ধি ১১দশমিক ৫ শতাংশ।

এছাড়া ব্যাংকিং খাতে শ্রেণীকৃত ঋণ, কলমানি সুদের হার ও সুদহারের স্প্রেড কমানো, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক পুন:অর্থায়ন তহবিল, স্কুল ব্যাংকিং এবং পথশিশুদের ব্যাংক হিসাব খোলায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে ২০১৫ সালে।

কৃষি ঋণ: গত অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১৬ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে অক্টোবর ২০১৫ পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা বা ২৮ শতাংশ।

এছাড়া বর্গাচাষি ঋণ ও বিশেষ ফসল চাষে রেয়াতি সুদে ঋণ প্রদাণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে।

নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বছর জুড়েই এসএমই খাতে অর্থায়নের ওপর জোর দিয়েছে। গত প্রায় ছয় বছরে ব্যাংকগুলো প্রায় ৩০ লাখ উদ্যোক্তাকে ৪ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা এসএমই ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের দেয়া হয়েছে ১৫ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে এসএমই ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। যার মধ্যে সেপ্টেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে ৮১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা বা ৭৮ শতাংশ।

অক্টোবর পর্যন্ত ৪৯ হাজার ২৯৮ জন উদ্যোক্তাকে ৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়ন করা হয়েছে। এছাড়া ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এমএসএমই খাতে ১৫ লাখের বেশি নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। ১৪ হাজার ১৩৩ নারী উদ্যোক্তা ১৩৭৬ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা পেয়েছে।

জনগণের দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছাতে বর্তমানে ৫৬টি ব্যাংক ও ৩২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যরত রয়েছে। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট শাখা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২১৯টি। যার মধ্যে ৫ হাজার ২৩৪টিই পল্লী শাখা। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শাখা রয়েছে ২১০টি।

এছাড়া চলতি বছরে মোবাইল ব্যাংকিং, ব্যাংকিং খাতে ডিজিটালাইজেশন, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সহজীকরণ, সুপারভিশন জোরদারকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই