অভিভাবকহীন বিএনপি

সর্বশেষ ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে থেকেই ‘উধাও’ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস। সত্তরেরও বেশি মামলার হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী এই সদস্য। একই অবস্থা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেলের। মাঝে-মধ্যে সভা-সমাবেশে তাকে দেখা গেলেও জাপানের নাগরিক হোশি কোনিও হত্যাকাণ্ডের পর হঠাৎ ‘লাপাত্তা’ সোহেলও। নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটির প্রভাবশালী সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আমান উল্লাহ আমানও কারাগারে।

অর্ধ শতাধিক মামলা আর গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে আত্মগোপনে আরেক সদস্য বরকতউল্লা বুলু। সবমিলিয়ে বর্তমানে ঢাকা মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম একেবারেই স্থবির হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে খুবই হতাশ মহানগর বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।

গত বছরের ১৮ জুলাই মির্জা আব্বাস ও হাবিব-উন নবী খান সোহেলের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর বিএনপির ৫২ সদস্যের হাইপ্রোফাইলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। দুই মাসে কাউন্সিল করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু বিগত দেড় বছরে কয়েক দফায় উদ্যোগ নিয়েও থানা-ওয়ার্ডের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি দলটি। অবশ্য বিগত কয়েকমাস ধরেই হুলিয়া নিয়ে দায়িত্ব পাওয়া নেতারা আত্মগোপনে। এখনো পর্যন্ত তারা প্রকাশ্যে আসতে পারেননি।

মহানগরে ৪৯টি থানা, ১০০টি ওয়ার্ড ও ১৮টি ইউনিয়নের সাংগঠনিক কমিটি রয়েছে। মহানগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক নেতা বলেন, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটি গঠন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়েই ছিল। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গঠিত সরকারের বছরপূর্তি উপলক্ষে তিন মাসের টানা আন্দোলনের কারণে শেষ পর্যায়ে এসে ওই সব কমিটি ঘোষণা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে মহানগরের নেতৃত্ব পরিবর্তন হলেও থানা-ওয়ার্ডের গঠিত কমিটিগুলোকে কাজে লাগানো যাবে।

তবে মামলায় পর্যুদস্ত হয়ে আত্মগোপনে থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস নিজে থেকেই মহানগরের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে আগ্রহী বলে জানান তার ঘনিষ্ঠজনরা। জানা যায়, আহ্বায়ক কমিটির উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহকে প্রকাশ্যে দেখা গেলেও প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে নিশ্চুপ রয়েছেন। উপদেষ্টা কমিটির সদস্য সাদেক হোসেন খোকা ও আবদুস সালাম নিউইয়র্কে।

এর মধ্যে এক মামলায় ইতিমধ্যে সাদেক হোসেন খোকার ১৩ বছরের কারাদণ্ড হয়ে গেছে। আপাতত তার দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই। ছয় সদস্যের যুগ্ম আহ্বায়কের আবদুল আওয়াল মিন্টু ও এম এ কাইয়ুম দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। আরেক সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু মারা গেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সালাউদ্দিন আহমেদ।

অবশ্য জামিনে থাকা যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী আবুল বাসার ও আবু সাইদ খান খোকনের নেতৃত্বে অতি সম্প্রতি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে ঢাকা মহানগরের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। আহ্বায়ক কমিটির ৪৫ সদস্যের মধ্যে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা যায়। লন্ডনে অবস্থান করছেন আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীম।

এ ছাড়া আবুল খায়ের ভুঁইয়া, আবদুল মজিদ ও শামসুল হুদা শারীরিকভাবে অসুস্থ। মারা গেছেন বোরহানুজ্জামান ওমর। প্রকাশ্যে রয়েছেন সাদেক আহমেদ, নিতাইচন্দ্র ঘোষ, ফেরদৗস আহমেদ মিষ্টি ও এস এম জিলানী।

সদস্যদের মধ্যে এস এ খালেক, সাহাবুদ্দিন আহমেদ, আবদুল লতিফ, সিরাজুল ইসলাম, আনোয়ারুজ্জামান, গোলাম হোসেন, সাজ্জাদ জহির, একরামুল হক, ইউনুস মৃধা, বজলুল বাসিত আনজু, আলী আজগর মাতবর, আহসান উল্লাহ হাসান, আলী ইমাম আসাদ, তানভীর আদেল বাবু, হারুন অর রশিদ খোকন, আবুল হাসান তালুকদার ননী, আবু মোতালেব, আনোয়ার পারভেজ বাদল, আবদুল মতিন, আবদুস সামাদ, হাজী আলতাফ হোসেন, ফরিদ আহমেদ, আক্তার হোসেন, নবী উল্লাহ নবী, মীর হোসেন মীরু, ফখরুল ইসলাম, তানভীর আহমেদ রবিন, শেখ রবিউল আলম, কফিলউদ্দিন, আরিফুর রহমান নাদিম ও জাফরুল ইসলাম বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে পলাতক রয়েছেন।

জানা গেছে, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে কম-বেশি আন্দোলন হলেও পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দেয় ঢাকা মহানগর বিএনপি। সম্প্রতি লন্ডনে এক নাগরিক সমাবেশেও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঢাকা মহানগর বিএনপির আন্দোলনে ব্যর্থতার প্রতি ইঙ্গিত দেন।

কেন্দ্রীয় বিএনপি পুনর্গঠনের পাশাপাশি মহানগর বিএনপিও ঢেলে সাজানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে তার। জেলা কমিটি পুনর্গঠনের পরপরই ঢাকা মহানগর বিএনপিতে হাত দেবেন তিনি। মহানগর কমিটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করার চিন্তা-ভাবনাও রয়েছে বিএনপির নীতি-নির্ধারকদের।

সে ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতাদের দিয়ে কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে। সূত্রমতে, সর্বশেষ ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় মহানগর বিএনপি নেতারা আত্মগোপনে থাকায় ক্ষুব্ধ হন বেগম জিয়া। ভোটে যাওয়ার আগেই কেন্দ্র ছেড়ে দেওয়াকে ভালোভাবে নেয়নি দলের নীতি-নির্ধারকরা।

ঘনিষ্ঠজনদের কাছে বেগম জিয়া বলেছেন, কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই নীরব ভোট ডাকাতি হয়েছে। তখন কোনো নেতাই মাঠে নামেননি। ভোট শুরু হওয়ার আগেই কেন্দ্র ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিছুটা প্রতিরোধ করতে পারলেও ফলাফল ভিন্ন হতো।

বিশেষ করে ঢাকা মহানগরে বেশকিছু ওয়ার্ড কাউন্সিলর হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। ঢাকা মহানগর বিএনপির এক নেতা বলেন, যেহেতু এখন রাজধানী দুই সিটিতে বিভক্ত, তাই বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামোকেও দুই ভাগে ভাগ করা উচিত। তাহলে নেতৃত্ব আরও গতিশীল হবে।

নতুন নেতৃত্বে সবাই কাজ করতে উৎসাহ-উদ্দীপনা পাবে। প্রয়োজন এখনো যোগ্য লিডারশিপের। মাঠের নেতা-কর্মীরা মার খেতে খেতে এখন সয়ে গেছে। এখন তারা ঘুরে দাঁড়াতে চায়। তারা চায় যোগ্য ও সাহসী নেতৃত্ব।বাংলাদেশপ্রতিদিন



মন্তব্য চালু নেই