মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির ৬ নম্বর রাস্তার দুই পাশে গরু-ছাগলের রক্ত আর মাংসের কাটাকুটি দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই রাস্তার শেষ প্রান্তে। এখানেই একটি বাড়ির নীচ তলায় বাস করেন বাংলা চলচ্চিত্রের একসময়কার জনপ্রিয় এবং ব্যস্ততম অভিনেত্রী রানী সরকার। একটা বড় কামিনী গাছের ডাল নুয়ে পড়েছে রানী সরকারের বাড়ির দরজার সামনে। দরজার আকাশি রঙের পর্দা খানিকটা ফাঁক করে একজন দেখছেন তারই বাড়ির সামনে সবেমাত্র দুটি ছাগল কোরবানি করা হয়েছে। সে দৃশ্য খুব মন দিয়ে যে মানুষটি দেখছিলেন কাছে যেতেই আবিষ্কার হয় তিনিই রানী সরকার।
সংবাদকর্মীদের তিনি জানান, ঈদে কোরবানির মাংসের অপেক্ষায় থাকি কখন মানুষ একটু মাংস দিবে তারপর সেটা রান্না করে খাবো। পথ চেয়ে থাকি। আমার বাসার আশপাশের মানুষ যে মাংস দেয় তাই দিয়ে আমার হয়ে যায়। কিন্তু মানুষের অপেক্ষায় থাকতে কার ভালো লাগে বলো।
বলা ভালো, রানী সরকার প্রায় ২৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, চান্দা, তালাশ, বন্ধন, সঙ্গম, তিতাস একটি নদীর নাম, চন্দ্রনাথ, শুভদা, দেবদাস, কাঁচের দেয়াল, ঘর ভাঙা ঘর, কে তুমি, বেহুলা, আনোয়ারা, অরুণ বরুণ কিরণ মালা, দস্যুরানী, সাইফুল মুলক বদিউজ্জামাল, সিরাজ উদ দৌলা, মলুয়া, সখী তুমি কার, স্বামী স্ত্রী, চোখের জলে, রেশমি চুড়ি, নোলক, আয়না, মৎস্য কুমারী, পথে হলো দেখা, সেই তুফান, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, মায়ার সংসার, সুতরাং, ভানুমতি, টাকার খেলা, কাঁচ কাটা হীরা ও নাচঘর ও থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার।
রাস্তায় ফুল বিক্রি করেন অভিনেত্রী বনশ্রী:
এক বন্ধুকে বলছিলাম, বনশ্রীকে খুঁজে পাচ্ছি না। বন্ধুটি রসিকতা করে জবাব দিলো, ‘রামপুরা টেলিভিশন ভবনের কাছে গিয়ে রিকশা নিয়ে বনশ্রী চলে যান।’ কিন্তু রামপুরা যেতে হয়নি কষ্ট করে, ঢাকার শাহবাগেই খুঁজে পাওয়া গেল বনশ্রীকে। এখানেই এখন ফুল বিক্রি করেন বনশ্রী। হলদে গাঁদা, লাল গোলাপ, সাদা দোলনচাঁপা, রজনীগন্ধা, বেলিসহ নানা ফুলঘেরা পরিবেশে বসে আছেন বনশ্রী।
এতক্ষণ শুধু নামটাই বলছি, পরিচয়টা বলা হলো না। বনশ্রী বাংলা চলচ্চিত্রের এক সময়কার জনপ্রিয় এবং পরিচিত এক অভিনেত্রীর নাম। বাবা মার হাত ধরে ৭ বছর বয়সেই শিবচর থেকে ঢাকায় আসেন। বাবা ঠিকাদারি কাজ করতেন। দুই বোন আর এক ভাই তারা। বনশ্রী ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে ছিলেন। উদীচীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ভালো গান করতেন। অভিনয় শেখার জন্য সুবচন নাট্য সংসদে যোগ দেন, মহিলা সমিতি মঞ্চের দর্শকের কাছেও পরিচিত মুখ বনশ্রী। তারপর বিটিভির ‘স্পন্দন’ অনুষ্ঠানে নিয়মিত আবৃত্তি করেছেন। প্রায় দশটির মতো বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেলও হয়েছিলেন তিনি।
এরপরই চলচ্চিত্রে পা রাখেন। ‘সোহরাব-রুস্তম’ চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে তার বাংলা ছবির দুনিয়ায় অভিষেক হয়। আর প্রথম ছবিতেই হিরো ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন। এসব গল্প শুনছিলাম বনশ্রীর মুখে, ফুলের ঘ্রাণে মুগ্ধ হয়ে।
এরপর তিনি ‘নেশা’, ‘মহাভূমিকম্প’, ‘প্রেম বিসর্জন’, ‘ভাগ্যের পরিহাস’ নামের চলচ্চিত্রগুলোতে অভিনয় করেন। তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্রে যখন কাজ শুরু করি, তখন থেকেই আমার টার্গেট ছিল জনপ্রিয় হিরোদের সঙ্গে কাজ করবো। তাই আমি মান্না, অমিত হাসান, রুবেল এদের নায়িকা হয়ে কাজ করেছি।’
চলচ্চিত্র প্রযোজক ফারুক ঠাকুরই তাকে ঢাকাই চলচ্চিত্রে ব্রেক দিয়েছিলেন। সব কিছু ভালোই চলছিল। আলিশান বাড়ি, জীবন-যাপন। কিন্তু ফারুক ঠাকুর একটি খুনের মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপন করলে একে একে সবাই সরে যান বনশ্রীর পাশ থেকে। ধীরে ধীরে বনশ্রীও শ্রীহীন হয়ে পড়েন রূপালী জগৎ থেকে। তারপর শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবনের পথচলা। নতুন এক গল্প।
নিষ্ঠুর দুনিয়া নামে একটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। কিন্তু ছবিটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। একসময়কার সেই ব্যস্ততম অভিনেত্রী এখন ফুটপাতে বসে ফুল বিক্রি করেন। কেন এই ফুল বিক্রি? বনশ্রী বলেন, ‘দেখুন আমি এর আগে বাসে বাসে বই বিক্রি করে সংসার চালাতাম। সংসার বলতে আমি আর আমার সাড়ে তিন বছরের ছেলে আপন [মেহেদী হাসান আপন]। কিন্তু ছেলেকে কোলে নিয়ে বাসে বাসে বই বিক্রি করাটা কষ্টের। এত কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই ছেলেকে এতিমখানায় দিয়ে, এখন ফুল বিক্রি করছি। আমি যখন নায়িকা ছিলাম, তখন প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা ক্লাবে আসতাম কাজ না থাকলে। সেই ঢাকা ক্লাবের টেনিস মার্কার হিসেবে কাজ করতেন জীবন ভাই। তিনি একদিন আমাকে রাস্তায় দেখে বললেন, ‘আরে ম্যাডাম আপনি কেন বাসে বাসে বই বিক্রি করবেন। তখন তিনি আমাকে ফুল বিক্রি করার কাজ দেন।’
নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট, সংসারও টিকলো না, মেয়ে বৃষ্টিকে হারালেন, এখন একমাত্র সম্বল শিশু সন্তান আপনকেও ঠিকমত লালন পালন করতে পারছেন না। এসব নানা কারণে বনশ্রী এর মাঝে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। পরে তিনি মানিকগঞ্জের আসক্তি পুনর্বাসন নিবাস আপনে চারমাস মানিসক চিকিৎসা নেন। আর ছেলেকে দিয়ে দেন সাভারের একটি এতিম খানায়।
বনশ্রী বই বিক্রেতা থেকে ফুল বিক্রেতা, এক সময় থাকতেন আলিশান ফ্ল্যাটে এখন শেখের টেকের বস্তিতে। ছেলে থাকে এতিমখানায়, তিন বেলা খাবারের নিশ্চয়তা নেই। এই পরিস্থিতির জন্য কাকে দায়ী করবেন আপনি? ফুলের রাজ্যে বনশ্রী উত্তর খুঁজে বেড়ান। তিনি বলেন, ‘দেখুন আমার আসলে সঠিক কোনো গাইড ছিল না বা আমাকে বুদ্ধি পরামর্শ দেয়ার লোক ছিল না। ফারুক ঠাকুর যখন ঝামেলায় পড়েন আমি তখন একা হয়ে যাই। আমার কোনো ব্যাকআপ ছিল না। আমার বাবা মার কাছ থেকেও আমি কোনো সঠিক দিক নির্দেশনা পাইনি। এই শহরে একা একটি মেয়ে টিকে থাকার জন্য যে কী লড়াই করতে হয় তা আপনাদের জানা নেই।’
[চোখের কোনে বনশ্রীর পানি। তিনি কান্না আড়াল করেন ওড়নায় মোছেন। কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে তার] তিনি আবার বলা শুরু করেন, ‘আমার এখন কুত্তা বিলাইয়ের মতো জীবন যাপন করতে হচ্ছে। এটা কি আমার অপরাধের জন্য। নাকি আমাদের চারপাশের সিস্টেমের জন্য? আমার সংসার, আমার সন্তান, স্বামী কিছু নেই এখন আমার।’
[আবার চুপ হয়ে যান বনশ্রী]
আচ্ছা এর মাঝে শুনেছিলাম আপনাকে নায়ক অনন্ত জলিলসহ অনেকেই সহযোগিতা করেছেন। তারা অর্থ সহায়তা দিয়েছেন…
এবার যেন একটু রেগে গেলেন বনশ্রী, ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘অনেকেই টাকা দিয়েছে, অনন্ত জলিল দিয়েছেন ১৩ হাজার টাকা, ইলিয়াস কাঞ্চন দশ হাজার টাকা, চ্যানেল আই থেকে এবং আরো একটি প্রতিষ্ঠান কিছু টাকা দিয়েছিল। কিন্তু তা খুবই সামান্য। আমার এ টাকার দরকার নেই। আমি গেলাম অনন্ত জলিলের অফিসে, গিয়ে তাকে বললাম, আমাকে চাকরি দেয়ার জন্য। কারণ আমি সেলাইয়ের কাজ জানি। তিনি আমাকে চাকরি দিলেন না। তার অফিসের দারোয়ান আর ড্রাইভার আমার সঙ্গে অভদ্র আচরণ করেছে, অপমান করেছে। এরপর একদিন অনন্ত জলিল আমাকে বললেন, তিনি প্রতি মাসে আমাকে এক হাজার টাকা দেবেন আর ১৫ কেজি চাল। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি তা পাইনি। আমি তো ভিক্ষা চাই না। আমাকে কাজ দেন। তাও কেউ আমাকে কাজ দিচ্ছে না। তাই আমি ফুলের ব্যবসায় নেমেছি। এখানে যদি আমাকে সবাই সহযোগিতা করে আশা রাখি ফুলের ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারবো। আমি সবাইকে অনুরোধ করবো আমার ফুলের দোকান থেকে ফুল নিতে। সব রকমের ফুল আমি সরবরাহ করবো।’
বনশ্রী আরো জানান, তার ফুলের দোকানের নাম ঠিক করেছেন চন্দ্রমালিকা পুষ্প কুঞ্জ। শাহবাগের ফুল মার্কেটেই তিনি একটি ফুলের দোকান নিতে চান। কিন্তু তার অর্থ নেই। তাই এখন ফুটপাতেই বসে ফুল বিক্রি করছেন। বনশ্রীর স্বপ্ন ফুলের দোকানটা দাঁড় করাতে পারলে শিশু সন্তান আপনকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন। তিনি বলেন, ‘ছেলেটা এতিমখানায় গিয়ে সব সময় মনমরা হয়ে থাকে। বুকটা ফেটে যায় ছেলের মুখ দেখলে। ছেলের জন্য অশান্তি লাগে। টাকা হলেই ভালো থাকার জায়গা পেলেই ছেলেকে নিয়ে আসবো।’
আপনি তো এর মাঝে ‘মাটির পরী’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অভিনয়টা কি করতে চান না আর?
একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বনশ্রী বলেন, ‘মাটির পরী চলচ্চিত্রে আমাকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে ফকিরের মতো এক হাজার টাকা ধরিয়ে দিছে। এরকম হলে কি কাজ করা যায় বলেন। আমার মনে প্রাণে তো অভিনয়। আমি তো অভিনয় করতেই চাই কিন্তু ভালো সুযোগ পাচ্ছি না। আর অভিনয় করতে গেলেও তো খরচ লাগে। সেটাও তো আমার কাছে নাই।’
ফুল মার্কেটে বনশ্রীকে সবাই আপন করে নিয়েছেন। কিন্তু বনশ্রী কি ফুল ক্রেতা না বিক্রেতা এটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বসে ফুল বিক্রি করতে সমস্যা হয় তার। তাই টাকার অপেক্ষায় আছেন। টাকা জমিয়ে দোকান দিবেন তিনি। ছেলেকে নিয়ে আসবেন। বনশ্রীর এই ছোট্ট স্বপ্ন পূরণ হোক সেই কামনা থাকলো। ফুলের ঘ্রাণে ফুলের রঙে ভরে উঠুক বনশ্রী আর তার শিশু সন্তান আপনের জীবন।
মন্তব্য চালু নেই