অভিনব ভিক্ষুক সিন্ডিকেট, ঈদে আয় ৬শ কোটি টাকা
ডান হাতের কব্জিটি একটু বাঁকা রফিকুল ইসলামের। প্রথম দেখায় প্রতিবন্ধী ভেবে তার প্রতি সহানূভুতি প্রকাশ করেন সবাই। আর এ সহানুভূতি আকর্ষণই তার অস্ত্র! কাওরানবাজারের সিগন্যালে সিএনজি অটোরিকশার যাত্রী লাবনী আক্তার দয়াপরবশ হয়ে পাঁচ টাকার একটি কচকচে বাড়িয়ে দিলেন তার দিকে। কিন্তু কী আশ্চর্য! নোট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রফিকুল বলেন, ‘ওই বুড়িরে ২০ ট্যাকা দিলেন। আর আমি ল্যাড়া, আমারে দেন পাঁট ট্যাকা?’
শুক্রবার দুপুরে যানজটে হাত বাড়িয়ে দেয়া ভিক্ষুকদের মধ্যে বেছে বিবেচনা করে টাকা দান করছিলেন গৃহিনী লাবনী। বিজয় সরণির সিগন্যাল থেকে কাওরানবাজার পর্যন্ত শতাধিক ভিক্ষুকের মধ্যে যাদের দেখে সহানুভূতি জাগছিল প্রতিবন্ধী রফিকুল ইসলাম তাদেরই একজন। তবে এই সহানুভূতির মূল্য যে এভাবে পাবেন তা কল্পনা করেননি। রফিকুলের আচরণে বিব্রত লাবনী ২০ টাকা দিতে বাধ্য হলেন।
বনানী থেকে বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের উদ্দেশে যাওয়া এ গৃহিনী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘রমজান মাসে দান-খয়রাত করা সওয়াবের কাজ। তবে ঢাকায় কাকে দান করব তা নিয়ে আমরা বিপাকে পড়ি। শুনি অনেকেই ব্যবসা করছে। কে যে গরিব আর কে যে প্রতারক বোঝা যায় না। এখন টাকা কম দিলেও নিতে চায় না। বোঝেন, ভিক্ষুকও ডিজিটাল হয়ে গেছে…!’
রফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় ফিতরাসহ যাকাতের টাকার আশায় তিনি এসেছেন ময়মনসিংহ থেকে। শবে-কদরের রাতে আজিমপুরে ভিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু জায়গা পাননি তিনি। এরপরও আশা করছেন ঈদের আগে বাড়িতে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ফিরতে পারবেন।
শুধু রফিকুল ইসলামই নয়, প্রায় ৫০ হাজার মৌসুমী ভিক্ষুক ভারি করে তুলেছে রাজধানীর রাজপথ। রমজানে, শবে কদর ও ঈদের সময় ভিক্ষার উদ্দেশ্যে ঢাকায় জড়ো হওয়া এসব মানুষের কারণে বিব্রত গৃহিনী লাবনীর মতোই লাখ লাখ নগরবাসী।
জানা গেছে, রমজানে প্রতিদিন রাজধানীতে অন্তত ২০ কোটি টাকার ভিক্ষা বাণিজ্য হচ্ছে। পুরো মাসে এই ভিক্ষার টাকার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ছয়শ’ কোটি টাকা। ভিক্ষুক সিন্ডিকেটের সংঘবদ্ধ চক্রগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও এলাকাভিত্তিক প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে চালায় ভিক্ষা বাণিজ্য। আর এ কারণেই উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভিক্ষায় প্রকাশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে শিশুদের।
এদিকে রাজধানীর ভিআইপি এলাকাসহ সাতটি এলাকায় গত বছর ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আবারও এসব এলাকায় ভিক্ষা বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তবে এ সিদ্ধান্তটিও কার্যকর হবে ঈদের পরে।
রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ভিক্ষুক দেখা যায়- বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, হাইকোর্ট মাজার ও মসজিদ, মিরপুর শাহ আলী মাজার ও মসজিদ, গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজার, গুলশান-১ ও ২ গোলচত্বর, কাকরাইল মসজিদ, মহাখালী রেলগেট মসজিদ, চকবাজার মসজিদ, আজিমপুর কবরস্থান, মতিঝিল, গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদ, উত্তরা ও বনানীর মসজিদগুলোর কাছে।
রাজধানীর গুলশান, বারিধারা, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা- এসব অভিজাতপাড়ায় যাকাত-ফিতরার টাকা তুলনামূলক বেশি পাওয়া যায়। এজন্য টাকা আদায়ে ছিন্নমূলদের প্রধান টার্গেট থাকে এসব এলাকা। এখন শহরের বিপণিবিতানের সামনে এবং ট্রাফিক সিগন্যালে যানবাহন আটকে গেলে ঘিরে ধরে ভিক্ষুকের অসংখ্য হাত। প্রধান সড়কসহ অলিগলিতে বেড়েছে ভিক্ষুকের আনাগোনা।
সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকায় ৫০ হাজার নিয়মিত ভিক্ষুক আছে। তবে রমজান ও ঈদ উপলক্ষে এ সংখ্যা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। তবে ভিক্ষুকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীতে বর্তমানে এ সংখ্যা অন্তত দেড় লাখ। এবার রমজান ও ঈদে মৌসুমী ভিক্ষুকের সংখ্যা অন্তত ৫০ হাজার।
হাইকোর্ট মাজার এলাকার ভিক্ষুক নেতা আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘রমজানে, ২৭শা (শবে কদর) আর ঈদের সময় আওরা (মৌসুমী) ভিক্ষুকেগো লেইগ্যা আমরা কোনো টাকা-পয়সা পাই না। এখন বেশিরভাগই আওরা ভিক্ষুক।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, ফরিদপুর, মাদারিপুর, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আনা হয়েছে বেশিরভাগ মৌসুমী ভিক্ষুক। তাদের থাকার জন্য রাজধানীর মিরপুর দিয়াবাড়ি বেড়িবাঁধ, বাউনিয়া বাঁধ, গাজারিবাগ বেড়িবাঁধ, কামরাঙ্গীর চর, মোহম্মদপুর বেড়িবাঁধ, শনির আখড়া, আব্দুলাহপুর ও টঙ্গীর বিভিন্ন খুপরি ঘর ভাড়া নেয়া হয়েছে। সিন্ডিকেটকে নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে এরা ঈদের মৌসুমটা রাজধানীতে ভিক্ষা করছে।
শাহবাগ এলাকার ভিক্ষুক মোবারক হোসেন ও ফাহিমা খাতুন দাবি করেন, রমজানে একজন ভিক্ষুকের প্রতিদিন গড় আয় দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। আরও কয়েকজন ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন রাজধানীতে অন্তত ২০ কোটি টাকার ভিক্ষা বাণিজ্য হয়। পুরো মাসে যার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ছয়শ’ কোটি টাকা।
ফার্মগেট ওভারব্রিজের নিচে বাসস্ট্যান্ডে বাবুল নামে এক মৌসুমী ভিক্ষুক জানান, তার বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে। এবারই প্রথম ঢাকায় এসেছেন। তাকে ঢাকায় একটি রিকশা গ্যারেজে নাইটগার্ডের কাজের কথা বলে আনা হয়। কাজে নামানোর আগে ভিক্ষার কথা জানানো হয়েছে। প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু কিছু করার ছিল না। এখন প্রতিদিনের ভিক্ষার অর্ধেক টাকা দিতে হয় লাইনম্যানকে।
ভিক্ষুকরা জানান, ভিক্ষাবৃত্তিকে কেন্দ্র করেও চলে চাঁদাবাজি। অন্তত ৩০০ পয়েন্টে একজন করে লাইনম্যান ভিক্ষুকদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আছে আলাদা সিন্ডিকেট।
স্থানীয় কয়েকজন ভিক্ষুক জানান, খিলগাঁও ডিসিসি মার্কেট এলাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করে ভিক্ষুকদের একটি সিন্ডিকেট। টুণ্ডা আমান উল্লাহ ও কানা ফজলুর নেতৃত্বে ২০ জন এসব দলের প্রধান। পবিত্র শবে বরাত ও দুই ঈদে বাড়তি আয়ের লক্ষ্য নিয়ে তারা নানা প্রলোভনে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে নারী- পুরুষ ও শিশুদের অগ্রীম টাকা দিয়ে ঢাকায় নিয়ে এসেছে। ভিক্ষার অর্ধেক টাকা দিতে হয় এ চক্রের তহবিলে।
শিশুদের দিয়ে ভিক্ষা
শিশু আইন-১৯৭৪-এ বলা আছে, শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে অপরাধী চক্রের যোগসাজশে এখন এটি পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠিত লাভজনক পেশায়। এছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকলেও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) রাজধানীতে বন্ধ করতে পারেনি শিশু ভিক্ষাবৃত্তি। এখনও বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী শিশুদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছে একটি মহল। ঈদ মৌসুমে ভিক্ষায় শিশুদের ব্যবহার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
জানা গেছে, ২০১০ সালের ৩০ জানুয়ারি দেশের বিভিন্ন দৈনিকে রাজধানীর কামরাঙ্গীর চর এলাকার শিশু নিয়ামুলের অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করা হচ্ছে এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২০১১ সালে আদালতের রুল জারির পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শওকত মোস্তাফাকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সরকার। এই কমিটি ভিক্ষাবৃত্তির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া এবং ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনে সুপারিশ করে।
সরকারের এতো উদ্যেগের পরও বন্ধ হয়নি শিশু ভিক্ষাবৃত্তি। হাইকোর্ট মাজার এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের গাড়ি ঠেলছে শিশুরা। এসব শিশু ভাড়া খাটছে। কেউ আছে মাসিক বেতনে। কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ছিন্নমূল শিশুদের এনে গাড়ি ঠেলার কাজে সরবরাহ করছেন মনির নামে এক দালাল।
সিলেটের শিশু হারুন আট বছর ধরে ঢাকায়। কমলাপুরে ছিন্নমূল হয়ে বেড়ে উঠছিল সে। চার বছর আগে মনির তাকে এনে গাড়ি ঠেলার কাজ দেয়। মাসে ছয়শ’ টাকা বেতন এবং দুই বেলার খাবার পায় হারুন। প্রথম দিকে গাড়ি ঠেলতে কষ্ট হলেও এখন অভ্যস হয়ে গেছে বলে জানায় সে।
শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপারসন ওয়াহিদা বানু বলেন, ‘শিশুদের দিয়ে ভিক্ষা করানো অমানবিক কাজ। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করতে পারলে শিশুদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে বন্ধ করা যাবে না।’
কার্যকর ব্যবস্থা নেই
ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সাতটি এলাকা- বিমানবন্দর এলাকা, হোটেল সোনারগাঁও, রূপসী বাংলা, রেডিসন; বেইলী রোড এবং রাজধানীর কূটনীতিক পাড়া ও দূতাবাস এলাকাগুলোয় ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত বছরের ২২ জানুয়ারি এ সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর সভাপতিত্বে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এ সাতটি এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
এ ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, ‘এবার আমরা আর ব্যর্থ হতে চাই না। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনার কথা বিবেচনা করে রোজার ঈদের পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। এমনভাবে করব যেন আর ভিক্ষা না হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানোর আগে ওইসব এলাকায় মাইকিং করা হবে। যারা ভিক্ষাবৃত্তিতে আছেন তাদের পুনর্বাসনেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
মন্তব্য চালু নেই