অভিজিৎ বন্যার পরিণয় যেভাবে

রাফিদা আহমেদ বন্যা। বাবা ইউনেস্কোতে চাকরি করতেন। বাবা বিশ্বের নানা দেশে চাকরির সুবাদে বাস করেছেন বিভিন্ন দেশে। সেই সুবাদে বিশ্বের নানা দেশে ঘুরে ঘুরে বড় হয়েছেন আর বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অপার জ্ঞান গরিমায় আলোকিত হয়েছেন তিনি।

বাদ যায়নি বাংলাদেশও। বাবার চাকরির সুবাদে বাংলাদেশে কিছুদিন থাকতে হয়েছে তাকে। ওই সময় বন্যা ভিকারুননিছা নুন স্কুলে পড়েছেন। ক্লাস টু থেকে থ্রিতে উঠতেই এখান থেকে চলে যান বন্যারা। আর আসা হয়নি বন্যাদের। বর্তমানে পারিবারিকভাবে সবাই আমেরিকায় বাস করছেন।

মঙ্গলবার সঙ্গে আলাপকালে অধ্যাপক অজয় রায় অভিজিৎ ও পুত্রবধূর ব্যাপারে এভাবেই বর্ণনা করেন। তিনি জানান, তার দুই পুত্র। এর মধ্যে অভিজিৎ রায় বড়। ছোট ছেলে স্ত্রী নিয়ে ঢাকাতেই থাকেন। দুই ভাই-ই অসম্ভব মেধাবী ছিলেন শিক্ষা জীবনে। অভিজিতের মা দীর্ঘদিন ধরে প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে শয্যাশায়ী।

তুখোর মেধাবী অভিজিৎ রায় ১৯৮৮ সালে এসএসসি ও ১৯৯০ সালে এইচএসসি পাসের পর একই বছরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি হন। যন্ত্র প্রকৌশলে লেখাপড়ার পর কর্মজীবন শুরু করেন অটবিতে। চাকরিরত অবস্থায় বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করতে সিঙ্গাপুরে যান অভিজিৎ।

পরে সেখান থেকে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে তিনি জিপিএস প্রযুক্তির গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। অভিজিতের লেখা এক ডজন বই প্রকাশ পেয়েছে। প্রকৌশলী অভিজিৎ রায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন।

অন্যদিকে অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা (৩৫) নিয়মিত ব্লগে লেখার পাশাপাশি এনালিস্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তার একমাত্র কন্যা তৃষা আহমেদ (১৮) লেখাপড়া করেন সেখানে। ‘এ’লেভেল শেষ করার পর সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন তিনি।

কন্যা সন্তান সম্পর্কে জানতে চাইলে অজয় রায় জানান, তিনি শুনেছেন, একমাত্র কন্যা তৃষা অভিজিতের নয়। তৃষা অন্য ঘরের সন্তান। তবে অভিজিতকেই সে বাবা বলে ডাকত এবং মানত। কারণ, একেবারে ছোট থেকেই তৃষাকে দেখভাল করেছেন অভিজিৎ। তাকে বাবার স্নেহ, ভালবাসা ও আদর-যত্ন দিয়ে বড় করে তুলেছেন অভিজিৎ।

অভিজিৎ এবং বন্যার মধ্যে কিভাবে বিয়ে হলো জানতে চাইলে অজয় রায় জানান, অভিজিৎ যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পরও লেখালেখি চালিয়ে যেত। তাদের দুজনের প্রথম পরিচয় হয় ২০০২ সালে ফেসবুকে একটি ব্লগের মাধ্যমে। ওই সময় বন্যার প্রথম বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। সেই সুবাদে একে অপরকে চেনা-জানা ও সখ্য-প্রেম হয় তাদের। এরপরের বছর ২০০৩ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ছয় বছর বয়সের কন্যা তৃষাকে নিয়ে ঘর বাধেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়াতে।

অভিজিৎ ও বন্যা সম্পর্কে অজয় রায় জানান, তারা দুজন দুই ধর্মের হলেও তাদের বিশ্বাস ছিল মূলত মানবধর্মে। নাস্তিকতা, বিজ্ঞান এবং নিরীশ্বরবাদ নিয়ে অভিজিৎ-বন্যা দুজনই লিখেছেন অসংখ্য ব্লগ। তিনি জানান, হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণকারী অভিজিৎ নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশেপাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধু-বান্ধবই মুসলিম। তাদের ওপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোন ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের ওপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। প্যালেস্টাইনে বা কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা।’

অন্যদিকে একমাত্র কন্যা সন্তান তৃষা যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসে বাবা-মায়ের এই বিপদের দিনে পাশে থাকতে না পারলেও তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার বয়স যখন ৬ বছর, তখন আমার মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের শুরু তার। এর পর গেল ১২ বছরে ক্রমে তিনি আমার বন্ধুতে, আমার নায়কে, আমার আদর্শে, বিশ্বস্ত নির্ভরতায়, আমার নাচের সংগীতে এবং আমার বাবায় পরিণত হন।’

১৮ বছর বয়সী তৃষা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বাবার হত্যাকারীদের বিচার হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।’

অনেকটা বাবার মৃত্যুর পর কন্যা তৃষা তার ফেসবুক স্ট্যটাসে বাবার সুরেই লিখেছেন, ‘ইসলামী মৌলবাদীরা তাকে (অভিজিৎ) ছুরির আঘাতে হত্যা করেছে। ওই ঘটনায় আমার মা-ও গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। যদি বলি এই ঘটনায় আমি আতঙ্কিত বা মর্মাহত, তাহলে কম বলা হবে। পরিস্থিতি যত খারাপ হোক না কেন পৃথিবীকে ভালো জায়গায় পরিণত করতে যুক্তির লড়াই শেষ হয়ে যাবে না।’

একই স্ট্যাটাসে তৃষা আরও লেখেন, ‘আমার বাবা ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক। বিজ্ঞান এবং নিরীশ্বরবাদ বিষয়ে লেখার জন্য মূলত তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি আমাকে কখনোই প্রচলিত শান্তশিষ্ট অথবা বিনয়ী হতে বলেননি। তিনি আমাকে শিক্ষিত, উদ্যোগী এবং সাহসী হতে শিখিয়েছেন। তিনি আমাকে যা শিখিয়ে গেছেন, যে ভালবাসা দিয়ে গেছেন তা আমি সবসময় মনে রাখব। আমি তোমাকে খুবই ভালবাসি বাবা। প্রতিটি জিনিসের জন্যই তোমাকে ধন্যবাদ।’

তৃষা তার স্ট্যাটাসে বলেন, ওই ঘটনাটি কেবল যুক্তরাষ্ট্রই শুনতে পারে কারণ বাংলাদেশ পাওয়ারলেস। এটি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং সেখানে কোন আইনশৃঙ্খলা নেই। আমি গভীরভাবে সন্দিহান যে খুনিরা বিচারের আওতায় আসবে কিনা।



মন্তব্য চালু নেই