অবিশ্বাসে বন্দি জামায়াত-বিএনপি

ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘নরম’ অবস্থানে সন্দেহ আর অবিশ্বাস বেড়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে। তবে জোটের রাজনৈতিক অবস্থান সুবিধাজনক অবস্থায় না থাকায় এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলছেন না। তবে জামায়াতের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ নিয়ে বিএনপি ও জোটের ভেতরে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।

জামায়াতে ইসলামী সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়, নাকি বিএনপির সঙ্গেই থাকবে এসব বিষয় নিয়ে সন্দেহ ও প্রশ্ন উঠে এসেছে তাদের মধ্যে। যদিও শীর্ষ নেতারা জোটের ঐক্যের জায়গায় বিভেদ নেই বলে জানাচ্ছেন, তবুও এই মুহুর্তে জোটের মধ্যে চরম অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি সূত্রের।

সূত্রগুলো বলছে, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের অবনতির শুরু মূলত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে। এ নিয়ে বিএনপি প্রকাশ্যে কোনো অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত থাকায় জামায়াত বরাবরই অসন্তুষ্ট। বিশেষ করে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির পর বিএনপির নীরবতা রীতিমতো ক্ষুব্ধ করে তোলে দলটিকে।

এছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অন্য জামায়াত নেতাদের ব্যাপারেও বিএনপির নীরব অবস্থান ভালোভাবে নেয়নি জামায়াত। জোটের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেও বিএনপি জামায়াতকে কী দিয়েছে, সে প্রশ্ন তোলেন দলের নেতারা। এসব টানাপোড়েনে দুই দলের সম্পর্কে ছন্দপতন ঘটতে থাকে।

তবে বুধবার জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার রায়ের পর নতুন করে জোটে অবিশ্বাস আরো উস্কে দিয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে আওয়ামী লীগ-জামায়াত সমঝোতার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। রায়ের পরে প্রকাশ্যে সন্তুষ্ট নয় জানালেও মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডে বেশ খুশি জামায়াত।

তবে বুধবার রায়ের পরে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। সিনিয়র নেতারাও রায়ের কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে রাজি হননি। আর জামায়াত দুই দিনের হরতালসহ ৪ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করলেও আগের মতোই নীরব ছিলো বিএনপি।

এদিকে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায়ে বিভিন্ন মহলে শুরু হয়েছে সমালোচনা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের নেতারাও বিষয়টিকে আখ্যা দিয়েছেন, আঁতাতের রায় হিসেবে।

তাছাড়া এর আগে সাঈদীর রায়ের সময়ে ব্যাপক সহিংসতা চালালেও শুক্রবারের হরতালে অনেকটা নিরুত্তাপ থেকেছে জামায়াত-শিবির। পুলিশও থেকেছে নীরব অবস্থানে। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের সখ্যতার গুঞ্জনে ক্ষুদ্ধ বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।

দলটির দু’জন প্রভাবশালী নেতা জানান, জামায়াতের অতীতের কিছু ভূমিকা দলটিকে নিয়ে সন্দেহের কারণ। ৯৬’তে বিএনপি সরকারে থাকার সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলন করেছে। প্রয়োজনে আবার সেই দলের সঙ্গে ফিরে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

তবে জামায়াত নেতারা মনে করেন, জোটের মধ্যে ফাটল ধরাতে আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে ‘সমঝোতার নাটক’ মঞ্চস্থ করতে চাইছে। কোনো স্বার্থান্বেষী মহল এসব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে তাদের নেতাকর্মীর মনোবল ভাঙার চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ জানিয়েছেন তারা। সর্বশেষ বিচারপতিদের অভিশংসন আইনের বিরুদ্ধে ২০ দলীয় জোটের সমাবেশে সরকারের ‘ষড়যন্ত্রের’ বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান দলের নেতারা।

ঢাকা মহানগর জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দিন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মতো একজন নিরাপদ মানুষকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যদি আঁতাত হতো তাহলে তো সে নির্দোষ হিসেবে খালাস পেতো। তাই এই রায়ে আতাতেঁর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এটি জোটের সম্পর্কেও ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না।’ জামায়াত-বিএনপির সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টিকে গুজব হিসেবে আখ্যা দেন তিনি।

সূত্র জানিয়েছে, সন্দেহ থাকলেও জামায়াতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার বিষয়টি বিশ্বাস করতে চাইছে না বিএনপির নেতারা। তাদের মতে, বিএনপিকে ঘায়েল করতেই জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখছে আওয়ামী লীগ। সরকারের ধারণা, জামায়াত ছাড়া বিএনপি আন্দোলনে তেমন শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হবে না। এতে সরকারকে খুব বেশি একটা চাপে ফেলতে পারবে না বিএনপি।

তারা বলেন, জামায়াত বিএনপির আদর্শিক পার্থক্য রয়েছে। জামায়াত ছাড়াও বিএনপি ক্ষমতায় গেছে। আর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির কি ভূমিকা ছিলো তা সবারই জানা। আর জামায়াত যদি জোট ছেড়েও দেয় সেক্ষেত্রে তারাই বেশি বিপদে পড়বে। তবে জামায়াতকে জোট থেকে বের করে দিলে আওয়ামী লীগ আবার জামায়াতকে কাছে টেনে নিবে কি না, এই ভয়ও বিএনপিতে রয়েছে।

তবে শরিক দলের নেতারা মনে করেন, সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলেই জামায়াতের ভূমিকা স্পষ্ট হবে। সরকারের সঙ্গে জামায়াত যতই সমঝোতার চেষ্টা করুক না কেন, সরকার দলটিকে কোনো ছাড় দেবে না বলেই মনে করেন তারা।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, জামায়াত নিয়ে সরকার কৌশল প্রয়োগ করছে। তবে মূল কথা হচ্ছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিষয়ে সরকার তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে না পারে, সেক্ষেত্রে প্রমানিত হবে এটি নিয়ন্ত্রিত বিচার। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য এসব করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, গণতন্ত্রের সংকট উত্তরনে বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দল আন্দোলন করছে। জামায়াতের নিজস্ব গঠনতন্ত্র আছে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতকে গুলিয়ে দেওয়া সুযোগ নেই। সামনে সরকারবিরোধী আন্দোলন হবে। তাই আগামীতে সময়ই বলে দেবে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সুসম্পর্ক থাকবে কি না।



মন্তব্য চালু নেই