অবিলম্বে ‘সুলতান সুলেমান’র সম্প্রচার বন্ধের দাবি
শনিবার রাত দশটা। দীপ্ত টিভির পর্দায় শুরু হল বাংলায় ডাবিং করা তুর্কি সিরিয়াল ‘সুলতান সুলেমান’। শাহজাদা মুস্তফার জন্য হেরেমখানায় আনা হয়েছে এক দাসীকে। সাজিয়ে-গুছিয়ে তাকে রাত্রিযাপনের জন্য পাঠানো হয় শাহজাদার কাছে।
বৈবাহিক কোনো সম্পর্ক ছাড়াই তারা একসঙ্গে রাত্রিযাপন করেন। সকালের দৃশ্যে দেখানো হয় সেই দাসী এবং শাহজাদা বিছানায় শুয়ে একই চাদরের নিচে অন্তরঙ্গ আলাপ করছেন। শাহজাদার গভবর্তী স্ত্রী কেঁদে কেঁদে যখন তার শাশুড়িকে দাসীর সঙ্গে এভাবে রাত্রিযাপন নিয়ে অনুযোগ করেন তখন শাশুড়ি উল্টো তার বউমাকে ভর্ৎসনা করেন।
আর এক দৃশ্যে দেখা যায়, সুলতান সুলেমানের এক স্ত্রী সুলতানা তার খাসবাঁদীকে হত্যার চেষ্টা করছেন। কারণ সুলেমান এখন এই খাসবাঁদীর প্রেমে পাগল এবং তার সঙ্গেই বেশি রাত্রিযাপন করেন। আর এটা সহ্য করতে পারছেন না সুলতানা।
এছাড়া সিরিয়ালটির শুরুর দিকে দেখানো হয়েছে, সুলতান সুলেমানের মাও এভাবে ছেলের ঘরে দাসীদের পাঠাতেন। তিনি নিজে এবং তার পিতাও বিয়ের আগে বহু দাসীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করেন।
এভাবে প্রায় প্রতিদিনই হেরেম থেকে নারীদের (যারা দাসী নামে পরিচিত) শাহজাদা ও সুলতানের মনোরঞ্জনে রাত্রিযাপনের জন্য পাঠানো হয়। এই ধরনের নেতিবাচক কুরুচিকর কাহিনীতে ভরপুর দৃশ্যই দেখানো হচ্ছে দীপ্ত টিভির নিয়মিত সিরিয়াল ‘সুলতান সুলেমান’-এ।
তাই ইসলাম ধর্ম ও দেশের সংস্কৃতিবিরোধী এই সিরিয়াল বন্ধের দাবি উঠেছে দেশের বিশিষ্টজন, ইতিহাসবিদ, সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন দর্শকদের মহল থেকে। তারা বলছেন, দেশীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এই সিরিয়াল। কেউ কেউ মনে করেন, এটিও দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র।
শুধু তাই নয়, প্রশ্ন উঠেছে শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে একজন মুসলমান শাসকের জীবনের এই ধরনের চরিত্র উপস্থাপন করা সিরিয়াল সম্প্র্রচারের যৌক্তিকতা নিয়েও। এছাড়া এর সত্যতা নিয়ে তো প্রশ্ন রয়েছেই।
দর্শকদের অনেকে অভিযোগ করেন, ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের অন্যতম দিকপাল সুলতান সুলেমানকে নিয়ে মেরাল ওকেয় ও ইয়িল্মায শাহিন রচিত সুলতান সুলেমান নির্মাণের সময় বিনোদন উপস্থাপন করতে গিয়ে শাসক সুলতান সুলেমানকে অনেকটাই আড়ালে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
বিপরীতে হেরেমের কূটচাল, যৌনতা, দাস-দাসীদের দৈনন্দিন জীবনাচার এবং সুলতানাদের স্নায়ুযুদ্ধ দিয়ে বিনোদন জোগান দেয়ার স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। বিশেষ করে হেরেমের নানা বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে খোলামেলাভাবে।
সিরিজজুড়ে অন্দরমহলের প্রাধান্যের কারণে একজন সুশাসক সুলতানকে আড়াল করে রমণীকাতর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। আর এসব দেখে শুরুর দিকে দর্শকের অনেকে এক ধরনের বিনোদন অনুভব করলেও এখন তা ক্ষোভ-অসন্তোষে রূপ নিয়েছে।
বেসরকারি চ্যানেল দীপ্ত টিভিতে গত বছর নভেম্বর মাসে শুরু হওয়া এই সিরিয়ালটি এবং পরে আরও কিছু ডাবিং করা সিরিয়াল দেশের অভিনয় শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকৌশলীদের আরও বেশি ক্ষুব্ধ করে তোলে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দেশের শিল্পী কলাকৌশলীদের যে আন্দোলন গণজাগরণ তৈরি করেছে তার পেছনে এসব সিরিয়াল অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া জানা গেছে, সিরিয়ালটি নিয়ে খোদ তুরস্কে নানা অভিযোগের পাহাড় জমা হয়েছে।
সুলতান সুলেমান প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘তুর্কি শাসনের অন্তরালের জগৎ নৈতিকতার দিক থেকে নানাভাবে এমনিতেই প্রশ্নবিদ্ধ। সেগুলোর প্রতিফলন সুলতান সুলেমান নামের এই সিরিয়ালে রয়েছে, আমি দেখেছি। কিন্তু এটা কোনো রুচিশীলতার পরিচয় বহন করে না। আমার কাছে অন্তত ভালো লাগেনি। সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য অনেক কিছুকেই বাণিজ্যিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এখানে।’
বিশিষ্ট নাট্যজন ও নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, ‘ইসলামের নাম দিয়ে অশ্লীলতা প্রদর্শন করা হচ্ছে। মা আর মেয়ে একসঙ্গে হেরেমখানায় প্রবেশ করছে। এটা কি আমাদের সংস্কৃতি? এটা কোনোভাবেই আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। এসবের খুব বাজে প্রভাব পড়ছে সমাজে। ডিভোর্সের পরিমাণ বেড়ে গেছে। কিশোর-তরুণরা এগুলো দেখে বিপথগামী হচ্ছে। অবিলম্বে সুলতান সুলেমানসহ ডাবিং করা সব সিরিয়ালের সম্প্র্রচার বন্ধের দাবি জানাচ্ছি।’
নাট্যজন আতাউর রহমান বলেন, ‘সুলতান সুলেমানে আমাদের সংস্কৃতি শেকড়ের কিছু নেই। তবে সব ডাবিং সিরিয়াল বন্ধ করার কথা আমি বলছি না। ডাবিং করা ভালো, কিছুও তো আমরা দেখেছি। মনে রাখতে হবে আমাদের ভালো নাটক দিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে পারি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমাদের নাটকের মান পড়েছে। সেখানেই ভালো করার ব্যাপারে আমাদের জোর দেয়া উচিত।’
এ ব্যাপারে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আমি একটি কথাই বলব, দেশে মানসম্মত প্রযোজনা থাকলে এই ধরনের ডাবিং করা সিরিয়াল দেখা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। সেজন্য আমাদের কোয়ালিটি প্রডাকশনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
এদিকে দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ সুলতান সুলেমানের মতো সিরিয়াল কিভাবে সম্প্রচারের অনুমতি পেল সে ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানার চেষ্টা করলে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করা হলে কেউ কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
তবে সিরিয়ালটি প্রচারে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার দিকনির্দেশনা লঙ্ঘন করা হচ্ছে। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪-এর তৃতীয় অধ্যায়ের সংবাদ ও অনুষ্ঠান সম্প্রচার অধ্যায়ের ৩.৪.১ অনুচ্ছেদে বলা আছে, দেশীয় সংস্কৃতি, ঐহিত্য ও ভাবধারার প্রতিফলন এবং এর সঙ্গে জনসাধারণের নিবিড় যোগসূত্র স্থাপন ও আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ধারাকে দেশপ্রেমের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে সংস্কৃতি বিকাশের প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে।
আরেক জায়গায় ৩.৬.৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দেশী-বিদেশী ছবি অনুষ্ঠানে অশ্লীল দৃশ্য, হিংসাত্মক, সন্ত্রাসমূলক এবং দেশীয় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। ৫.১.১২ এর অনুচ্ছেদে বলা হয়, অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন দেশের প্রচলিত আইন, রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। কিন্তু সুলতান সুলেমানের ক্ষেত্রে এসবের অনেক কিছুই মানা হচ্ছে না
ধানমণ্ডি এলাকার বাসিন্দা সাবরিনা মিশু নামে একজন গৃহিণী কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘শুরুতে সুলতান সুলেমান দেখতাম। কিন্তু পরে যখন দেখলাম এখানে নারীকে ভোগ্য পণ্যের মতো হেরেমের মধ্য দিয়ে দেখানো হচ্ছে তখন দেখা বন্ধ করে দিই। আরও ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে এই সিরিয়ালে একাধিক স্ত্রী রাখার বিষয়টিকে উৎসাহ দিয়ে দেখানো হয়েছে।’
এদিকে এসব অভিযোগের ব্যাপারে দীপ্ত টিভির সিইও কাজী উরফি আহমদ বলেন, ‘আমরা দর্শকদের পছন্দের ওপর গুরুত্ব দিয়ে এই সিরিয়ালটি প্রচার করছি এবং মানুষ স্টার জলসা বা ভারতীয় অন্যান্য চ্যানেল না দেখে এটি দেখছে। তবে আমি স্বীকার করছি, আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে কিছু কিছু বিষয় যায় না।’
তিনি দাবি করেন, বাস্তবতা হচ্ছে, ইতিহাসে এমন তথ্যই রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নাটকীয়তা আনতে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা এসেছে, এটা ঠিক। তবে একটি সিরিয়াল সংস্কৃতিসহ সব ধ্বংস করছে আমি এমনটা মানতে নারাজ।’-যুগান্তর
মন্তব্য চালু নেই