অবরোধে জীবনের ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা, বিপর্যস্ত শিক্ষা
মিনহাজুল ইসলাম অনিক এসএসসি পরীক্ষার্থী। ২ ফেব্রুয়ারি শুরু হতে যাওয়া পরীক্ষা জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কথা থাকলেও সে আছে হাসপাতালে। ফেনীর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল তার। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে সে। কোনো রোগে নয় অবরোধকারীদের বোমার আঘাতে এখন চোখ বাঁচানো দায় হয়েছে অনিকের।
এই চিত্র এক অনিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। গত ৫ জানুয়ারি ফেনীতে শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে বন্ধু হৃদয়ের সঙ্গে ফেনীর হাড্ডাবাড়ি এলাকায় বাসায় ফিরছিল অনিক। দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া বোমায় ঝলসে যায় অনিক ও হৃদয়ের মুখ।
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে দুই চোখের আলো হারানোর শঙ্কায় থাকা চারজনই ছাত্র। তারা বিভিন্ন সময়ে অবরোধে হামলায় আহত হয়েছে।
আহতদের অবস্থা প্রসঙ্গে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘অবরোধে হামলার শিকার হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তাদের চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে পাওয়া কঠিন। তাদের কারো কর্নিয়ার মধ্যে স্প্লিন্টার ঢুকেছে, কারো পুড়েও গেছে। অবশ্য দীর্ঘ সময় চিকিৎসা নিলে কিছু ফল পাওয়া যেতে পারে।’
১৮ জানুয়ারি ইডেন কলেজ থেকে ফেরার পথে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের রাস্তায় একটি বাসে ছোঁড়া পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হন ইডেন কলেজের দুই ছাত্রী। দ্রুত নামতে গিয়ে পায়ে আঘাত পান ইডেনেরই আরেক ছাত্রী। সাথী ও যুঁথি নামের দুই ছাত্রীর পা ঝলসে গেছে। আর আতঙ্কে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছেন মাইমুনা। তারা সবাই ইডেন কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী।
বছরের প্রথম দিনেই ছিল জামায়তে ইসলামীর হরতাল। সেই দিন প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত চার কোটি ৪৪ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৪ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয়েছে ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৩ বই। কিন্তু নতুন বই পেয়েও অবরোধে ক্লাস করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ৫০ শতাংশেরও নিচে নেমেছে। বিশেষ করে যাদের বাড়ি থেকে স্কুল দূরে তাদের স্কুলে পাঠাতে সাহস পাচ্ছেন না অভিভাবকরাই। শ্রেণী কক্ষে শিক্ষার্থীদের কম উপস্থিতির কারণেও পাঠ্দান ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে উদ্বিগ্ন আসন্ন এসএসসি পরিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। এসএসসি ও সমমানের প্রায় ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীদের আগামী ২ ফেব্রুয়ারি থেকে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
অন্যদিকে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের অবরোধের মধ্যেই গত ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে ‘এডেক্সেল’ কারিকুলামের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলের পরীক্ষা। গত বৃহস্পতিবার এই পরীক্ষা হরতালের কারণে নিতে হয়েছে মধ্যরাতে। রাত ৩টা পর্যন্ত পরীক্ষা দিতে হয় শিক্ষার্থীদের।
ব্রিটিশ কাউন্সিল জানায়, আগামী ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত পরীক্ষা চলবে। কেউ যদি একটি পরীক্ষা না দিতে পারে কিংবা কোনো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হয় তবে তা হবে এক বছর পর।
এমন পরিস্থিতি শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য হতাশার বলেই উল্লেখ করলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন। তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমরা যেখানে চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছি সেখানে এমন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড খুবই হতাশজনক। সারাদেশে বই পৌঁছে গেলেও ক্লাস বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অবরোধ-হরতালে। যারা হরতাল দেন তাদের উচিৎ এই শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করা। অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে আহত হয়েছে বোমা-আগুনে এই দায় কার? সারা জীবন তারা এই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চিহ্ন বয়ে বেড়াবে।’
সোমবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ অবরোধের পেট্রোল বোমায় দগ্ধ চিকিসাৎরতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যান। তিনি ঘটনার বিমর্ষতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ‘এমন ঘটনা দেশের জন্য শুভকর নয়। যারা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ তারা আজ হামলার শিকার হচ্ছে। অবরোধের নামে এমন কর্মকাণ্ড মেনে নেয়া যায় না। আন্দোলনের নামে আগুনে পোড়া মানুষদের জীবন ধ্বংস করা হচ্ছে। অনতিবিলম্বে এসব বন্ধ করা উচিৎ রাজনৈতিক নেতাদের।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর ক্যাম্পাসের দিবা শাখার এক শিক্ষার্থীর বাবা আবদুল আহাদ বলেন, ‘আমার বাসা মিরপুরে। মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে সাহস পাই না। অনেক দিন স্কুলে যেতে না পারায় তার পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। আর বাবা হিসেবে আমি তো আগুনের মুখে মেয়েকে ঠেলেও দিতে পারি না।’
এই স্কুলের বসুন্ধরা শাখার এক শিক্ষার্থীর বাবা শাহজাহান মিঞা বলেন, ‘অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পর রামপুরা থেকে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে সব সময় উদ্বেগের মধ্যে থাকি। কখন না আবার তাদের স্কুলবাস অবরোধকারীদের কবলে পড়ে! মেয়ে বাসায় না ফেরা পর্যন্ত শান্তি পাই না।’
স্কুলের বাসগুলোয় পুলিশের নিরাপত্তা দেয়া যায় কি না সে ব্যাপারে সরকার ও স্কুল কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখার অনুরোধ জানান তিনি।
শিক্ষার্থীদের উপস্থিত কম বলেও স্বীকার করলেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন। তিনি বলেন, ‘চারদিকে অনেক বাচ্চা আহত হচ্ছে। অভিভাবকরা ভয়ে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে চান না। এমন আতঙ্কের মধ্যে অনেক বাচ্চাদের দূর থেকে অভিভাবকরা সঙ্গে নিয়ে আসতেও ভয় পান। আর ক্লাসে না থাকায় তারাও পিছিয়ে পড়ছে।’
প্রায় একই কথা বললেন আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের (মতিঝিল) অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম। তিনি বলেন, ‘বড় সমস্যা হচ্ছে অনেক বাচ্চা আসছে না স্কুলে। ফলে তাদের বাদ দিয়ে সিলেবাসও শেষ করা যাচ্ছে না। যারা আসছে না তারাও পিছিয়ে যাচ্ছে। এক প্রকার অনিশ্চয়তার মধ্যেই আছি।’
এমন পরিস্থিতিতে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের জ্বালাও-পোড়াওয়ে জাতির মঙ্গল নেই। শিক্ষার্থীদের বাসে আগুন দিয়ে, বোমা মেরে সুফল আসবে না। এসব গুপ্ত হামলা, নাশকতা ও ভয়ভীতি সৃষ্টি করে শুধু দেশেরই ক্ষতি হচ্ছে। জাতির ভবিষ্যৎ নস্যাৎ করার চক্রান্তে লিপ্ত অবরোধকারীরা। আমি আহ্বান জানাই এমন কর্মকাণ্ড ছেড়ে উন্নয়নের রাজনীতিতে ফিরবেন সবাই।’
মন্তব্য চালু নেই