অপহরণের টোপ সুন্দরী তরুণী
রাজধানী ঢাকা সহ সারাদেশে অপহরণের নেপথ্যে টোপ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে সুন্দরী রমনী। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে চাকরিজীবী, ছাত্র এমনকি রাজনৈতিক নেতাদের অপহরণের জন্য সংঘবদ্ধ চক্র সুন্দরী রমনীদের কাজে লাগাচ্ছে। টার্গেট করা ব্যক্তি সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য নিয়ে প্রথমে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করা হয়। সম্পর্ক গভীর হলে ওই ব্যক্তিকে খবর দিয়ে আনা হয় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। সেখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় অপহরণকারীরা। তারপর মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাবিকৃত টাকার জন্য শারীরিক নির্যাতন এমনকি অপহৃতকে খুনও করা হয়।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম ও রাজধানীর বংশালের ব্যবসায়ী মো. আব্দুল হাকিমকে অপহরণের ঘটনায় জড়িত ৩ নারীসহ ৬ জনকে আটকের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব তথ্য পেয়েছে বলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এসব অপহরণের ঘটনা ঠেকাতে গঠন করা হয়েছে ৪০ সদস্যের অ্যান্টি কিডনাপিং স্কোয়াড। এ ইউনিট রাজধানীতে অপরহণ ঠেকাতে কাজ করবে। পাশাপাশি ঢাকার বাইরে কেউ অপহরণ হলে সেক্ষেত্রে অপহৃত ব্যক্তিকে জীবিত উদ্ধারের পাশাপাশি সংঘবদ্ধ চক্রকে গ্রেপ্তারে দ্রুত কাজ করবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ ৭ জনকে একযোগে অপহরণ করা হয়। এর আগে ও পরেও আরো বেশকিছু অপহরণের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলামকে অপহরণ এবং গত ১ মে রাজধানীর বংশাল থেকে অপহরণ করা হয় আব্দুল হাকিম নামে আরো এক ব্যবসায়ীকে। এ দু’টি অপহরণের ক্ষেত্রে সুন্দরী রমনীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করার প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দারা।
তিনি আরো জানান, সাইফুল ইসলামকে অপহরণের ২৬ ঘণ্টা পর সাভারের নবীনগর এলাকা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করে র্যাব। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে শুক্রবার রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে নুরজাহান নামে এক নারীকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর তার স্বামী মো. ইউনুস মিয়াকেও আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
নুরজাহানের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল অপহৃত ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলামের। মূলত সাইফুল ইসলামকে অপহরণের নেপথ্যে নুরজাহানকে ব্যবহার করা হয়েছে টোপ হিসেবে। একই কায়দায় বংশাল থেকে ব্যবসায়ী আব্দুল হাকিমকেও আরেকটি চক্র অপহরণ করে। নিশি নামে এক সুন্দরী রমনীকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয় তাকে অপহরণ করার জন্য।
নিশির ফোন পেয়ে অপহৃত আব্দুল হাকিম তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাকে রাজধানীর জুরাইনে একটি বাসায় আটক রাখা হয়। তার কাছ থেকে প্রথমে বিকাশের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা নেয়া হয়। এরপর অপহরণকারীরা মুক্তিপণ হিসেবে আরো ৫ লাখ টাকা দাবি করে আব্দুল হাকিমের পরিবারের কাছে। অভিযোগ পেয়ে নিশিসহ মোট ৫ অপহরণকারীকে আটক করে বংশাল থানা পুলিশ ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম। উদ্ধার করা হয় অপহৃত আব্দুল হাকিমকেও।
গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা প্রথমে টার্গেট করে যাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ রয়েছে। পরে এসব ব্যক্তিদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত আচার-আচরণ সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য নিয়ে অভিনব কৌশলে সুন্দরী ও সুন্দর কণ্ঠের নারীদের দিয়ে বিভিন্নভাবে মোবাইলে যোগাযোগ তৈরি করে। অপরিচিত নম্বরের নারী কণ্ঠের ফোন পেয়ে অনেকে ব্রিবতও হন। রং নম্বরে চলে গেছে বললেও খুবই কৌশলে আবার ফোন করে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে সুন্দরী রমনীরা। বার বার নারী কণ্ঠের ফোন পেয়ে অনেক ব্যক্তি উৎসাহ নিয়ে কথা বলেন।
দীর্ঘদিন কথা বলতে বলতে এক সময় এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। সম্পর্কের এক পর্যায়ে ওইসব রমনীদের সঙ্গে দেখা করার জন্য এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়। এরপর দেখা করতে গিয়ে পড়েন ফাঁদে। প্রতারক রমনীরা কখনো বাসায় কখনো কোনো পার্কে বা অপরিচিত স্থানে দেখা করতে বলে নিয়ে যায়। আশেপাশেই থাকে তাদের চক্র। এক পর্যায়ে কয়েকজন যুবক এসে ওই ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যায়। অনেক সময় সুন্দরী রমনীদের সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় ছবি ও ভিডিও ক্লিপ তৈরি করে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করে অপহরণকারীরা।
সূত্র আরো জানায়, কয়েক বছর আগে একজন সংসদ সদস্যও এরকম প্রতারণর ফাঁদে পড়েছেন। ওই সংসদ সদস্যকে এক নারী ফোন করে। পরে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে আপত্তিকর ছবি তৈরি করে মোটা অংকের টাকা দাবি করে এ চক্র।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানীতে পৃথক পৃথক ১০ থেকে ১২টি সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে যারা সুন্দরী রমনীদের ব্যবহার করে অপহরণ করছে বিভিন্ন ব্যক্তিদের। রাজধানীর মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় এ চক্রগুলো সক্রিয়। এয়াড়া টঙ্গী এলাকায়ও রয়েছে এ চক্রের তৎপরতা। ইতোমধ্যে তারা এসব চক্রের সদস্যদের খোঁজখবর পেয়েছে। চক্রটির একটি ডাটাবেজও তৈরি করা হয়েছে। এখন তাদের গ্রেপ্তারে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমন্ডার এটিএম হাবিবুর রহমান জানান, অনৈতিক সম্পর্কের জের ধরে বেশিরভাগ অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। অপহরণের সময় অপহরণকারীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে অপহরণ করে থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ অপহরণের ঘটনা অনুসন্ধান করে নারীঘটিত কারণ অনুসন্ধান করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। র্যাব বিভিন্ন সময়ে যেসব অপহৃতদের উদ্ধার করেছে সেগুলোর বেশিরভাগেই নারীদের ব্যবহার করা হয়েছে বলেও তথ্য প্রমাণ পেয়েছে। এ চক্রকে সনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে র্যাব।
মন্তব্য চালু নেই