অন্য রকম এক যুদ্ধের ইতিহাস হয়ে থাকল জিহাদ (দেখুন ইনফোগ্রাফিক্সে )

ফায়ার সার্ভিসের দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে শিশু জিহাদকে উদ্ধার করা যায়নি। শেষ পর্যন্ত তার নিথর দেহ তুলে এনেছেন একদল স্বেচ্ছাসেবী।

তখনো আশা ছিল, জিহাদ হয়তো বেঁচে আছে। পাঠানো হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর বালুর মাঠে কান্নায়-ক্ষোভে-বাঁধভাঙা আবেগে ফেটে পড়লেন কয়েক হাজার মানুষ। শিশুটিকে একনজর দেখার প্রবল হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। চিৎকার করে আল্লাহকে ডাকছিলেন অনেকেই।

ভিড় ঠেলে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন শিশুটিকে নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেলে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক জানান, জিহাদ বেঁচে নেই।

একদিকে শিশুটির করুণ মৃত্যু, অপরদিকে তার বাবা নাসির ফকিরকে থানায় ১২ ঘণ্টা আটকে রাখা এবং মামা মনজুরকে নির্যাতনের ঘটনা সাধারণ মানুষকে আরও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। পাইপে পড়া ছেলের জন্য কাঁদারও সুযোগ পাননি বাবা। এমনকি বাসায় স্ত্রী ও অন্য সন্তানেরা কে কেমন আছে, তা-ও জানতে পারেননি। পারেননি এই চরম বিপদের সময় তাদের পাশে থাকতে।

গতকাল শনিবার বিকেলে শাহজাহানপুর রেল কলোনির বাসায় গিয়ে দেখা গেল শত শত মানুষের ভিড়। দেড় কক্ষের বাসা। শয়নঘরে জানালা দিয়ে আসছে ম্লান বিকেলের মৃদু আলো। জিহাদের মা খাদিজা বেগম কেঁদে কেঁদে অবসন্ন হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়। ভেতরে গণমাধ্যমকর্মী আর পাড়ার উৎসুক মানুষে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। মায়ের কথা বলার মতো শক্তি নেই। থেমে থেমে বলেন, শুক্রবার দুপুরে খাওয়ার পর জিহাদকে নিয়ে তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। কখন যেন জিহাদ বিছানা থেকে নেমে বাইরে চলে যায় খেলতে। ঘুম থেকে জেগে শোনেন ছেলে পাইপের গর্তে পড়ে গেছে।

খাদিজা বেগম বলেন, শুক্রবার বিকেলের পর থেকে জিহাদের বাবার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। রাতে বাড়ি ফেরেননি। শুনেছেন, জিহাদ পাইপে পড়ার গুজব ছড়ানো হয়েছে বলে তাঁকে থানায় আটক রাখা হয়েছে। জিহাদের মামা মনজুরকেও পুলিশ নির্যাতন করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

খাদিজাকে সান্ত্বনা দিতে আসা এক নারী ক্ষোভ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের জানান, গত শুক্রবার রাত আটটা থেকে তিনি ঘটনাস্থলে এসেছেন। আর যাননি। একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে এমন রাজনীতির বিচার চান তিনি।

জাতীয় মহিলা পরিষদ থেকে আসা এক নারী বলেন, ‘এটি হত্যা। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যদি কোনো কথা না বলে উদ্ধার কার্যক্রম চালু রাখতেন, অন্তত অক্সিজেন দিয়ে হলেও শিশুটিকে বাঁচানো যেত। সরকারের যদি এ অবস্থা হয় তাহলে আমরা কোথায় যাব!’

জানতে চাইলে শাহজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান বলেন, জিহাদের বাবাকে সকালেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কাউকে মারধর করা হয়নি।

বিক্ষোভ: ক্ষুব্ধ লোকজন ও জিহাদের পরিবারের অভিযোগ, উদ্ধার অভিযানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসার আগে ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্য ছিল এক রকম। কিন্তু স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসার পর শিশুটি পাইপের ভেতর নেই বলে শুরু হয় উল্টো কথা। ক্ষুব্ধ লোকজন ও জিহাদের পরিবার তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার বিচার দাবি করেন। এলাকাবাসী মনে করেন, উদ্ধারকাজে গাফিলতির কারণেই শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। ক্ষুব্ধ জনতা পাম্পের কাছে দুটি টিনের ঘর দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে ছুড়তে থাকে ইটপাটকেল। পুলিশ মৃদু লাঠি চালায়। প্রায় আধা ঘণ্টা এমন পরিস্থিতি চলে।jihad

শিশুটিকে উদ্ধারের পর ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক আলী আহমদ খানের কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চান শিশুটিকে উদ্ধার করতে না পারা তাঁদের ব্যর্থতা কি না। উত্তরে তিনি বলেন, ‘না, আমরা অপারেশন সম্পূর্ণ স্থগিত করিনি। সীমিত করা হয়েছিল। আমরা জীবিত উদ্ধার করতে পারিনি। কিন্তু মৃত উদ্ধার করার কাজ তখনো চলছিল।’

আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব ছিল কি না, জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, এ ধরনের ঘটনা প্রথম হওয়ায় এ রকম উদ্ধার অভিযানে যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে।
অভিযানের আদ্যোপান্ত: তিন ভাইবোনের মধ্যে জিহাদ সবার ছোট। বয়স চার বছর। বাবা নাসির ফকির মতিঝিলের একটি স্কুলের নিরাপত্তাকর্মী। শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে অন্য শিশুদের সঙ্গে বাসার পাশেই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত পানির পাম্পের কাছে খেলতে যায় সে। একপর্যায়ে পাম্পের একটি দেড় ফুট ব্যাসের পাইপে পড়ে যায় সে। চলে যায় গভীরে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ওই পাইপের গভীরতা ৫০০ ফুট। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ৪০০ ফুট। কেউ বলে ৬০০ ফুট।

পাইপের ভেতর শিশুটি পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। শুরু হয় উৎকণ্ঠা, প্রার্থনা। বালুর মাঠে চলছিল ওয়াজ মাহফিল। সেখান থেকেও মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়, তার জন্য দোয়া করা হয়। ছুটে যান ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ কয়েক শ কর্মী। শুরু হয় উদ্ধার তৎপরতা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর রাত, ভোর, সকাল, দুপুর—কিন্তু ছেলেটি উদ্ধার হয় না। পাইপে সরবরাহ করা হয় অক্সিজেন। রশি ফেলে আবার টানা হয়। একটু ভারী ভারী মনে হলেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আশপাশের শত শত মানুষ পড়তে থাকেন দোয়া-দরুদ। কিন্তু রশি কিছুক্ষণ ওপরে ওঠানোর পর আবার হালকা হয়ে যায়। হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে চলে দীর্ঘ অভিযান।

শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে উদ্ধার অভিযানে থাকা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, পাইপের ভেতরে শিশুটির সাড়া পেয়েছেন তাঁরা। রশি ফেলার পর তাঁরা বেশ কিছুক্ষণ টেনে ভারী ভারী অনুভব করেছেন। তাঁদের ধারণা, শিশুটি রশি ধরতে পারলেও শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে না পারায় আবার ছেড়ে দিচ্ছে। জুস ও টর্চ লাইটও ফেরত এসেছে।

শুক্রবার রাত নয়টার দিকে উদ্ধার অভিযানের সঙ্গে থাকা এক যুবক পাইপে মাথা ঢুকিয়ে ডাকতে থাকেন শিশুটিকে। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর এবার ওই যুবক মাথা উঠিয়ে বলেন, আর কোনো সাড়া পাচ্ছেন না তিনি। এরপর তড়িঘড়ি করে রশি দিয়ে তোলার কৌশল বাদ দেয় ফায়ার সার্ভিস। আনা হয় ক্রেন। ক্রেন দিয়ে কেটে কেটে তোলা হয় ওই পাইপের মধ্যে থাকা আরেকটি লম্বা লোহার দণ্ড। এটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০ ফুট। ওই দণ্ডটি তোলার কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস তখন জানায়, লোহার দণ্ডটির শেষভাগের নিচে একটি যন্ত্র বাঁধা আছে। শিশুটি সম্ভবত ওই যন্ত্রের ওপর আছে। তাই ওই যন্ত্রসহ শিশুটিকে তোলার চেষ্টা করছেন তাঁরা। কিন্তু রাত প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে পুরো যন্ত্র তুলে দেখা গেল, সেখানে কোনো শিশু নেই।

এলেন মন্ত্রী-কর্মকর্তারা: ওই সময় ঘটনাস্থলে যান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাঁদের উপস্থিতিতে এক যুবক স্বেচ্ছায় পাইপের ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ঝুঁকি মনে হওয়ায় তাঁকে আর পাঠানো হয়নি। একে অপরের সঙ্গে কথা বলে চলছিল বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনা। শেষমেশ ওয়াসার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি ভিডিও ক্যামেরা (বোরহোল ক্যামেরা) পাইপে ঢুকিয়ে প্রায় ৩০০ ফুট নিচে নামানো হয়। ওপরে ল্যাপটপে ভিডিও ফুটেজ দেখছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ কর্মকর্তারা। ঘটনাস্থলে যায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি বিশেষজ্ঞ দলও। সরাসরি সম্প্রচারের কারণে গণমাধ্যমেও দেখছিলেন সারা দেশের মানুষ।

ভিডিও ফুটেজে বস্তাসদৃশ বস্তু, টিকটিকি দেখা গেলেও কোনো মানবদেহ দেখা যাচ্ছিল না। এক ঘণ্টা এভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলে ওঠেন, পাইপে শিশু পড়ার ঘটনা একটি গুজব। রাত পৌনে তিনটার দিকে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার যুগ্ম পরিচালক আবু সাইদ রায়হান সাংবাদিকদের বলেন, ‘শিশু পড়ার ঘটনা গুজবও হতে পারে।’ প্রায় একই সময়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, কোনো শিশুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হবে না।

পরিত্যক্ত ঘোষণা না করা হলেও ওই সময় থেকেই কার্যত বন্ধ হয়ে যায় ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযান। ওই সময় একটি বেসরকারি বিশেষজ্ঞ দলও পাইপের ভেতরে ক্যামেরা পাঠায়।

গতকাল থেকে: গতকাল সকাল থেকেই ঘটনাস্থলে লোকজন আসতে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে উৎসুক জনতার ভিড়। বেলা ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী উপপরিচালক আবদুল হালিম সাংবাদিকদের জানান, পাইপে কোনো শিশুর সন্ধান মেলেনি। তাঁরা কোনো উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন না। বেলা পৌনে তিনটায় রেলওয়ে কলোনি মাঠে প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে ফায়ার সার্ভিস।

প্রেস ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক আলী আহমদ খান বলেন, দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়েও শিশুটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তাই উদ্ধার কার্যক্রম আপাতত স্থগিত করা হলো। এখন পাম্পটি রেলওয়ের দায়িত্বে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। রেলওয়ে যদি পরে ওই পাইপ তোলা কিংবা নিচে পানি সরবরাহ করে কোনো ব্যবস্থা নেয়, সে ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস তাদের সহযোগিতা করবে।

পাইপে শিশুটির সাড়া পাওয়া, জুস পাঠানোসহ শুক্রবার দেওয়া ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে আলী আহমদ বলেন, এ ধরনের ঘটনা দেশে এই প্রথম। তাই অভিজ্ঞতার একটি ঘাটতি আছে। তা ছাড়া কোনো পাইপে কেউ শব্দ করলে তা প্রতিধ্বনিত হয়। তাই আগের ধারণা ভুল ছিল। কিন্তু এ ভুল ইচ্ছাকৃত নয়।
তবে মহাপরিচালক বলেন, তাঁদের ক্যামেরা প্রায় ২৮০ ফুট পর্যন্ত নিচে নামানো সম্ভব হয়েছিল। এরপর শক্ত কোনো কিছু থাকায় তা আর নিচে নামানো সম্ভব হচ্ছিল না। এখন নিচে শিশুটি আছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ ছিল। উদ্ধারকাজ স্থগিত ঘোষণার পর সুযোগ দেওয়া হয় সাধারণ লোকদের।

পাওয়া গেছে পাওয়া গেছে চিৎকার: প্রেস ব্রিফিং শেষ হওয়ার ১০ মিনিট পরই পাম্পের আশপাশে থাকা লোজজন একযোগে ‘পাওয়া গেছে’ ‘পাওয়া গেছে’ বলে চিৎকার শুরু করে। দেখা যায়, কয়েকজন সাধারণ যুবক তাঁদের তৈরি খাঁচা ব্যবহার করে পাইপ থেকে বের করে এনেছেন শিশুটিকে। শিশুটির পরনে ছিল হলুদ রঙের একটি হাফ প্যান্ট। খালি গা। চোখ বন্ধ। মুখের কিছু কিছু জায়গায় কাদামাটি মাখা। সাদা হয়ে আছে হাত-পা।

দৌড়ে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা শিশুটিকে কোলে তুলে নেন। এরপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন মানুষ ও গণমাধ্যমকর্মীরা। অনেকে মাটিতে গড়াগড়ি করেও কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর নিয়ে যাওয়া হয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। জিহাদ আপাতত আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হিমঘরে। আর এক গভীর বিষাদে ডুবে আছে সারা দেশ।



মন্তব্য চালু নেই