অনিশ্চয়তায় তিস্তা পাড়ের কৃষক
নিলফামারী জেলার উত্তরভিটা এলাকার কৃষক আফতাব উদ্দিন। ২৭ বিঘা জমিতে, বছরে, তিনটি ফসলের আবাদ করেন।
গেল বোরো মৌসুমে, তিস্তা নদীতে পানির প্রবাহ ছিল গত কয়েকবছরের তুলনায় সবচেয়ে কম, তাই সেচের জন্য পানি কিনে বোরো ফসলের আবাদ করেছেন তিনি।
আফতাব উদ্দিন বলছিলেন “এবারে ধানের জমি সব শুকিয়ে গিয়েছিল,ধান গাছ পুরে শেষ, মোটরের পানি কিনে সেচ দিছি।”
লালমনিরহাটের হাতিবান্ধায় তিস্তা নদীর উপর বাধ দিয়ে যে সেচ প্রকল্প করেছে বাংলাদেশ, সেই প্রকল্পের আওতায় খালের মাধ্যমে বাংলাদেশের উত্তরের অন্তত পাঁচটি জেলার কৃষকরা সেচের পানি পেয়ে থাকেন। এই খালগুলোর অন্যতম একটি নিলসাগর।
নিলসাগরের পানির ওপর ভরসা করে রুমি বেগম তার পাঁচ বিঘা জমিতে দুইটি ফসল ফলান। এ বছরটা কেমন যাচ্ছে তার?
রুমি বেগম বলছিলেন “আমার জমি ফাটি গিয়েছিল, কোন পানি পাইনি, এক বিঘা জমিতে হাজার-বারোশো টাকার পানি সেকচি, এই টাকা আমাদের কাছে অনেক।”
আরেকজন কৃষক মোহাম্মদ সোহাগ, খালের পানি মাপা স্কেল দেখিয়ে বলছিলেন এবারে পানির প্রবাহ কতখানি ছিল। তিনি বলছিলেন যেটুকু পানি আসছে তাতে কোন রকমে খাল ভেজে কিন্তু সেচ দেয়া সম্ভব না।
কেন আটকে আছে তিস্তা চুক্তি ?
তিস্তা নদীর ভারতের অংশে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে সেচের কাজে ব্যবহার করছে দেশটি। সেখানে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। আর বাংলাদেশের অংশে রয়েছে তিস্তা বাঁধ। স্থানীয়দের ভাষায় ভারতের তৈরি করা বাঁধের কারণে পানি পাচ্ছে না তিস্তা পাড়ের কৃষকেরা।
তবে এসব বিতর্ক ও সমালোচনার অবসান এবং দুটি দেশই যাতে তিস্তার পানি ব্যবহার করতে পারে সেই লক্ষ্যে কয়েক দশক ধরে ঢাকা ও দিল্লীর মধ্যে চলছে দফায় দফায় আলোচনা। কিন্তু তার পরেও কেন বন্দোবস্ত হচ্ছে না তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তির- আর এখান থেকে বাংলাদেশের চাওয়াটাই বা কি?
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের বাংলাদেশের সদস্য মির সাজ্জাদ আলী বলছিলেন তিস্তা চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশ প্রস্তুত তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ কারণে বিলম্বিত হচ্ছে এর চূড়ান্ত পর্বের কাজ।আলী বলছিলেন, “ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সমঝোতার বিষয়টি এখন প্রধান। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা প্রস্তুত। সেখানকার কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান আগের মতই আছে।”
তিনি আরো বলেন, “দুদেশের কত মানুষ পানির ওপর নির্ভরশীল, পানির প্রবাহ, সেচকাজ কি পরিমাণ জমির ওপর করা হচ্ছে এসব সব কিছু বিবেচনা করে বাংলাদেশের পক্ষে চুক্তির খসড়া অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।” আর এর ভিত্তি ‘সমতা ও ন্যায্যতা’ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তবে এই সমতা ও ন্যায্যতার পরিমাণ কি হবে সে সম্পর্কে পরিষ্কার করেন নি তিনি।
কৃষকেরা কি উপকৃত হবেন ?
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন প্রসঙ্গ আসলেই- তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের কথা আসে।
দুই দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা এই নদীর পানি বণ্টন নিয়ে, দেশ দুটির সরকারের মধ্যে আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন ধরে।
তিস্তার পানি বন্দোবস্তের দোরগোড়ায় এসেও বিষয়টি পিছিয়ে গেছে কয়েকবার।
বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর, নিলফামারী, কুড়িগ্রাম, বগুড়া এসব এলাকার মানুষ মূলত খালের মাধ্যমে পানি পায়।
তবে তিস্তার পানি প্রবাহ না থাকলে খালগুলো শুকিয়ে যায়। সম্পূর্ণ পানি নির্ভর ফসল বোরো ধানের ফলনের সময় তাই সবচেয়ে বিপাকে পরেন কৃষকেরা।
তিস্তা চুক্তি হলে কিভাবে লাভবান হবেন তারা? একজন কৃষক আব্দুল গনি বলছিলেন, “খাল থেকে পানি কিনতে আমাদের প্রয়োজন হয় বিঘা প্রতি ৩০০ টাকা, সেখানে পানি না আসলে শ্যালো মেশিনে তোলা পানি কিনতে লাগে এক হাজার টাকা। অর্থাৎ চুক্তি হলে সেচের পানি সহজে এবং কম খরচে পাওয়া যাবে।”
অপর আরেকজন কৃষক জয়ন্ত কুমার বলেন, “কি পরিমাণ জমিতে আবাদ করবো সেটা বুঝতে পারি না। কারণ আমরা জানি না পানি কতটুকু পাব। যদি আগে থেকে জানা থাকে খালে কি পরিমাণ পানি আসতে পারে তাহলে আমরা পরিকল্পনা করে আবাদ করতে পারি। এতে আমাদের ফসল নষ্ট হবে না এবং খরচ কমবে।”
তিস্তায় এ বছরের পানির প্রবাহ ছিল সবচেয়ে কম- ২৩২ কিউসেক। প্রতিবছর এসব জেলার কৃষকেরা ফসল আবাদ করেন একেবারে অনিশ্চয়তা নিয়ে।
পানির প্রবাহ থাকলে ফসলের ফলন হয় কম খরচে, পানি না থাকলে শ্যালো মেশিনে পানি কিনে ব্যবহার করেন, খরচ বাড়ে কয়েক গুণ।
তাই তিস্তা চুক্তি হলে, অন্তত এসব এলাকার কৃষকেরা পরিকল্পনা করে বছরে ফসলের আবাদ করতে পারবেন সেটা বেশ পরিষ্কার। সূত্র: বিবিসি
মন্তব্য চালু নেই