অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ

১.

‘কোনোভাবে ইউনিভার্সিটি বন্ধ করা যায় নাকি এটা ভাবেন। ইট স্যুড বি অ্যানি কজ। এটা আরো মাস তিনেক আগে করা উচিত ছিল। ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল হলো, মারামারি হলো ভিতরে। মারা গেল ২/৩ টা। কী করা যাবে? কিন্তু হলো। তারপরে এটা শেক করে ফেলবে সরকারকে। আমি আগেই বলেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে ২/৩টা হল দখল করার জন্য। সরকার সুতার উপর ঝুলছে এখন।’

এটা কোনো সন্ত্রাসীর আলাপ নয়। আমাদের ‘সুশীল সমাজ’-এর একজন প্রতিনিধির মুখের ভাষা। তার নাম মাহমুদুর রহমান মান্না। সম্প্রতি বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এসব কথা বলেছেন। ভয়ঙ্কর। খোকার সঙ্গে মান্নার এমন আলাপের একটি অডিও টেপ ফাঁস হয়েছে। সোমবার তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। অডিও টেপ থেকে মোটামুটি নিশ্চিত, কণ্ঠটি মান্নারই।

সুশীল সমাজকে বলা হয় কোনো রাষ্ট্রের ‘থার্ড স্টেট’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুশীল সমাজে সে দেশে চলমান অনাচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, সাধারণ জনগণের পক্ষে কথা বলেন। একটি সুন্দর সমাজ গঠনে সুশীল সমাজের ভূমিকা অপরিসীম।

মাহমুদুর রহমান মান্নাকেও আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে টক শোতে সুন্দর সুন্দর কথা বলতে শুনেছি। জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সরকারি-বিরোধী দলের সমালোচনা করতে শুনেছি। কিন্তু, আমরা যা দেখেছি, শুনেছি তা পর্দার সামনে। পর্দার আড়ালে আমাদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের চেহারা কেমন, তা ওই অডিও টেপেই স্পষ্ট বোঝা যায়। কত ভয়ঙ্কর মানসিকতার হলে একজন মানুষ লাশ চাইতে পারেন।

২.

খোকার সঙ্গে আলাপকালে ক্যাম্পাসে লাশ চেয়েছিলেন মান্না। গতকাল ছিল বৃহস্পতিবার। কয়েকদিন গত হতে না হতেই মান্নার চাওয়া পূরণ হলো! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে লাশ পড়ল।

বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে দুর্বৃত্তদের হামলায় ব্লগার অভিজিৎ রায় নিহত এবং তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা আহত হয়েছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর রাত ১০টা ২৫ মিনিটে মারা যান অভিজিৎ। তার স্ত্রীর অবস্থাও আশঙ্কাজনক। টিএসসিতে রাজু ভস্কর্যের কাছে বটতলায় এ ঘটনা ঘটে। বইমেলা থেকে বের হয়ে ওই স্থানে আসার পর ওই দম্পতি হামলার শিকার হন বলে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে।

৩.

অভিজিৎ ও বন্যার ওপর কারা হামলা চালিয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিজিৎ রায় মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এবার একুশের বইমেলায় তার দুটি বই প্রকাশ হয়েছে, সে কারণেই তিনি দেশে ফিরেছিলেন। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখালেখির জন্য জঙ্গিবাদীরা অভিজিৎকে হুমকি দিয়ে আসছিল। হতে পারে তারাই হাতের নাগালে পেয়ে অভিজিৎকে হত্যা করেছে। আবার এটাও হতে পারে, মান্নার সাম্প্রতিক অডিও টেপ ফাঁস হওয়ার পর ঘোলাটে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কোনো প্রথম কিংবা দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় পক্ষ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আমি বলছি না, মান্নার লাশ চাওয়াটাই অভিজিতের মৃত্যুর কারণ। তবে ওই চাওয়াটা অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।

৪.

অভিজিৎকে কারা হত্যা করেছে, তা খুঁজে বের করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। আমরা আশা করি, এ ক্ষেত্রে তারা ইলিয়াস আলী গুম কিংবা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, তা দেখাবেন না। অচিরেই্ এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হয়ে আড়ালে থাকা দুষ্কৃতিকারীদের চেহারা জনসম্মুখে প্রকাশ পাবে।

তবে মান্নার সাম্প্রতিক এমন লোমহর্ষক আলাপের পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে লাশ পড়াটা স্বভাবতই মানুষের মনের মধ্যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এমন ঘটনার পর আতঙ্কিত ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও।

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ পড়ার মতো ভয়ঙ্কর আলাপচারিতা ফাঁসের পরও টিএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় এমন হত্যাকাণ্ড ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা দিতে সরকারের ব্যর্থতাকেই ইঙ্গিত করে। ক্যাম্পাসে লাশ ফেলার মতো ষড়যন্ত্রমূলক আলাপচারিতার পরও কেন ক্যাম্পাসে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না? সাম্প্রতিক সমযে ক্যাম্পাস নিয়ে এত আলাপচারিতার পরও কেন ক্যাম্পাসে এ হত্যাকাণ্ড ঘটল? অভিজিতের অকাল মৃত্যুর জন্য কি রাষ্ট্র দায়ী নয়?

মান্নার অডিও টেপ ফাঁস হওয়ার পর ক্যাম্পাসে গোয়েন্দা নজরদারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলে হয়তো অভিজিৎকে প্রাণ দিতে হতো না।

৫.

বইমেলা চলাকালীন ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার থাকার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা একাডেমী ও এর আশপাশের এলাকায় বইমেলা উপলক্ষে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বহু মানুষ ক্যাম্পাসে আসেন। বইমেলার নিরাপত্তার খাতিরেও ক্যাম্পাসে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর সতর্ক অবস্থান থাকার কথা। এমন নিরাপত্তা থাকলে আজ হয়তো অভিজিৎকে প্রাণ দিতে হলো না।

ক্যাম্পাসে বইমেলা চলাকালীন এ ধরনের হামলা এটিই প্রথম নয়। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে একইভাবে লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপরও হামলা হয়েছিল। সেবার অবশ্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন হুমায়ন আজাদ। তবে এবার অভিজিৎ বাঁচতে পারলেন না। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে ভবিষ্যতে হয়তো বইমেলা থেকেই মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে।

৬.

সম্প্রতি বুয়েট থেকে পাশ করা আমার এক বন্ধু যুক্তরাজ্য চলে গেল। যাওয়ার আগে তাকে বললাম, ‘এই চার/পাঁচ বছর ধরে বুয়েটে পড়াশোনা করে বিদেশে চলে গেলে চলবে? তোদের মতো মেধাবীরা বিদেশে চলে গেরে দেশের কী হবে? দেশে থেকে দেশের জন্য কিছু কর।’

জবাবে বন্ধু বললো, ‘দেশে থাকলে সঠিক মূল্যায়ন পাব না? তা ছাড়া দেশের যা অবস্থা। এখানে তো স্বাভাবিক মৃত্যুরই কোনো গ্যারান্টি নেই।’ কথা শুনে ওকে খুব স্বার্থপর মনে হলো। তবে অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের পর আর মনে হচ্ছে না।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অভিজিৎ বাংলাদেশে এসেছিলেন কেবল প্রাণের বইমেলার টানে। বিশ্বের সর্বাধুনিক একটি দেশে বাস করেও তিনি মাতৃভাষা, মাতৃভূমিকে ভুলে যাননি। ইংরেজির সমুদ্রে বসবাস করেও বাংলার ভেলায় চড়ে সাহিত্যচর্চা করেন। এবার একুশের বইমেলায় তার দুটি বই প্রকাশ হয়েছে, সে কারণেই তিনি দেশে ফিরেছিলেন। কিন্তু কেন? লাশ হওয়ার জন্য? দেশের প্রতি তার ভালবাসার মূল্য আমরা দিতে পারলাম কোথায়?

৭.

অভিজিতের মৃত্যু আমাদের সামনে কয়েকটি বিষয় আবারও বেশ স্পষ্ট করে তুললো- আমরা এমন এক দেশে বাস করছি যেখানে সাধারণ মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি নেই। এমন দেশ যেখানে আমরা বিকেলে হাসিমুখে সস্ত্রীক প্রাণের মেলা বইমেলায় ঘুরতে এসেও সন্ধ্যার পরে বাসায় ফেরার পথে মেলার বাহিরে গেটের কাছাকাছিই ধারালো ছুরি, চাপাতির কোপে রক্তাক্ত হই, প্রাণ দিতে হয়।

আমরা এমন এক রাষ্ট্রে বসবাস করছি, সেখানে হয় আমাদের বাসে পেট্রোল বোমায় পুড়ে মরতে হবে, নয়তো সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারাতে হবে। যে দেশে প্রিয়জনের স্নেহাতুর চাহনি সামনে রেখে স্বাভাবিক মৃত্যু কামনা করাটাও যেন ঘোরতর অন্যায়।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক।



মন্তব্য চালু নেই