দৃষ্টিহীনদের জন্য হাসপাতাল বানালেন অন্ধ জুঁই

জন্মের পর ভালোই কাটছিল কোহিনুর আক্তার জুঁইয়ের জীবন। আর দশজন শিশুর মতো আনন্দময় ছিল তার ছোটবেলা। কিন্তু সাত বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান জুঁই। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও ফিরে পাননি দৃষ্টিশক্তি। কিন্তু সমাজে আলো ছড়াচ্ছেন তিনি। দীর্ঘ সংগ্রাম আর পরিশ্রম করে একটি হাসপাতাল করেছেন দৃষ্টিহীনদের চিকিৎসার জন্য।

তার এই কাজের স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছেন জুঁই। জয়িতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। আজ শনিবার আরও ৬৪ জনের সঙ্গে তাকে জয়িতা সংবর্ধনা দেবে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়।

ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় থেকে পাওয়া জয়িতা নির্বাচিত নারীদের জীববৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, ছোটবেলাতেই দৃষ্টিশক্তির পাশাপাশি বাবা-মাকে হারান সাভারের জুঁই। তারপর থেকে তার কঠোর সংগ্রামের জীবন। ১২ বছর বয়সে ছোট বোনকে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে আসেন ঢাকার আজিমপুরে। সেখানে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকার সময় সাক্ষাৎ হয় একজন বিদেশিনী বিক্যামনেলের সঙ্গে, যিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নারীদের নিয়ে কাজ করেন। তিনি জুঁইকে নিয়ে যান বকসিবাজারে। সেখানে হস্তশিল্পের কাজ দেখান। পরে বিক্যামনেল তাকে অন্ধদের স্কুলে বিনা বেতনে ভর্তি করে দেন। এরপর মিরপুর গার্লস ল্যাবরেটরী ইনিস্টিটিউট থেকে ১৯৮৬ সালে এসএসসি, ১৯৮৮ সালে মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন জুঁই। ১৯৯৪ সালে ডিগ্রি এবং ১৯৯৮ সালে মিরপুর বাঙলা কলেজ থেকে এমএ পরীক্ষা দেন তিনি।

যেভাবে শুরু জুঁইয়ের হাসপাতাল

লেখাপড়া শেষে জুঁই মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের আওতাধীন অন্ধ মহিলা সমিতি নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সেখানে তিনি অন্ধদের নিয়ে কাজ করেন। পরে গড়ে তোলেন অন্ধদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল। ‘কোহিনুর অন্ধ হাসপাতাল’ নামের চিকিৎসালয়টি সাভারের জোড়পুল বাসস্ট্যান্ডের পাশে সরকারি লিজকৃত জমিতে অবস্থিত। আধাপাকা তিনটি রুমে চলছে তার এই চিকিৎসা কার্যক্রম।

মূলত চোখের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয় এই হাসপাতালে। বিশেষ করে চোখে পানি পড়া, ছানি ইত্যাদির। তবে ছানি অপারেশনটা করা হয় আগারগাঁওয়ের চক্ষু হাসপাতালে। বিনা খরচেই এসব করা হয়। জুঁইর স্বপ্ন একদিন এখানেই হবে চোখের বড় বড় চিকিৎসা।

তার হাসপাতালের জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান পেয়ে থাকেন জুঁই। এই অনুদান দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে হাসপাতালটি। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে ঘুরে হাসপাতালের উন্নয়নের জন্য অর্থের সন্ধান করছেন।

লেখালেখিও করেন জুঁই। তার লেখা বইও বাজারে বের হয়েছে। তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে কবিতা ও গান লিখছেন। ‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান’-এর জন্য জয়িতা সংবর্ধনা দেয়া হবে জুঁইকে।

জয়িতা নির্বাচনে কাজ করেছেন ঢাকা জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা আয়শা নার্গিস। তিনি বলেন, ‘আমরা মাঠ লেভেলে জায়িতা অন্বেষণে কাজ করেছি। কাজ করতে গিয়ে অনেক ঘটনাই চোখে পড়েছে। জুঁইয়ের বিষয়টি আমাদের অবাক করেছে। দৃষ্টিশক্তি না থাকলেও মানুষের চোখের সমস্যা সমাধানে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে কোহিনুর আক্তার জুঁই।’

আয়েশা নার্গিস বলেন, ‘প্রায় ১০ বছর ধরে কোহিনুর চোখের হাসপাতালটি পরিচালনা করছেন। সংসারে তিনি সবার বড়। বাবা ছিলেন খুবই দরিদ্র। অনেক সংগ্রাম করে এ পর্যায়ে এসেছেন কোহিনুর। সবার সহযোগিতা পেলে স্বপ্ন সত্যি করতে পারবেন তিনি।’

ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় সূত্র জানায়, এবার ঢাকা বিভাগের ১৩টি জেলা থেকে পাঁচ ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত ৬৫ জন নারীকে জয়িতা সংবর্ধনা দেয়া হবে। এর মধ্যে আছেন কোহিনুর আক্তার জুঁইও। এ ছাড়া আজ শনিবার অনুষ্ঠানের দিন সেরা ১০ জন জয়িতা থেকে পাঁচ ক্যটাগরিতে শ্রেষ্ঠ পাঁচজন বাছাই করা হবে।

এই জয়িতা সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়বে উল্লেখ করে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার হেলালুদ্দীন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ে অনেক নারী সংগ্রাম করে সফল হয়েছেন। বিভিন্নভাবে সফলতা পেয়েছেন তারা। কেউ অর্থনৈতিকভাবে সফল হয়েছেন। কেউ হয়েছেন সফল জননী। এসব সফল নারীকে নির্বাচিত করেছি আমরা।’



মন্তব্য চালু নেই