৪০ বছরের জন্য রক্ষা পেলো বাংলাদেশ

নেপালে গত শনি ও রোববার কয়েকদফায় আঘাত হানে উচ্চ ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প। এতে দু’ সহস্রাধিক প্রাণহানীসহ ব্যাপক ক্ষতি হয় হিমালয়কন্যার। ভূমিকম্পের বিস্তৃতি ছিল ভারত, ভূটান ও বাংলাদেশ পর্যন্ত। ভূমিকম্পের আঘাতে এ তিন দেশেও কমবেশি প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে। ক্ষতি হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনার। তবে গত দু’দিন আঘাত হানা ভূমিকম্পের মাত্রা ও ক্ষতি আমাদের দেশে কম হলেও সবার মাঝে দেখা দিয়েছে চরম আতঙ্ক। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে শিগগিরই উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানবে- বিশেষজ্ঞদের এমন বক্তব্যের কারণে সিলেট অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে এ আতঙ্ক আরো বহুগুণে ছড়িয়ে পড়ে।

আগাম সতর্কতার ব্যবস্থা বা পদ্ধতি না থাকায় ভূমিকম্প মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতির কোনো সুযোগ থাকছে না। তবে এর জন্য আগাম সতর্কমূলক ব্যবস্থা, তাৎক্ষণিক করণীয় এবং ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করতে পারে মানুষ। ভূমিকম্পের এইসব পূর্বাপর পরিস্থিতি এবং নেপালে সংঘঠিত ভয়াবহ ভূমিকম্পের বিষয়ে রোববার একটি অন-লাইন নিউজ পোর্টালের সাথে খোলামেলা কথা বলেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. জহির বিন আলম।

তিনি বলেন, ‘১৫৪৮ সালে আঘাত হানা ভূমিকম্পে সিলেটসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূমিরূপের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। এরপর ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৮১২ ও ১৮৬৯ সালের ভূমিকম্পে সিলেটের মানচিত্র বদলে যায়। আর সিলেটে এ যাবৎকালের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছি ১৮৯৭ সালের ১২ জুন -যা ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থ কোয়াক‘ নামে পরিচিত। ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে সৃষ্টি হয় বিশাল আকারের পাহাড়-টিলা, হাওর, বিল ও জলাশয়।’

তিনি জানান, ১৯১৮ সালের মাঝারি আকারের একটি ভূমিকম্প হলেও দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হয়নি। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে প্রায় ১শ’ বছর পর পর এ অঞ্চলে আঘাত হেনেছে বড় ধরনের ভূমিকম্প। সে অনুযায়ী ১৯৯৭ কিংবা এর আগে-পরে এ অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা ছিল। আর গত শনিবার নেপালের পার্বত্যাঞ্চলে ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ায় ওই আশঙ্কা আবারও সত্য হলো।

ড. জহির বলেন, ‘প্রকৃতিগতভাবেই ভূ-গর্ভে গ্যাস ও তেলসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ সৃষ্টি হয়। আর তা থেকে উৎপন্ন এনার্জি প্রতিনিয়ত ভূ-গর্ভের বিভিন্ন প্লেটের সংযোগস্থল দিয়ে বের হতে চাপ সৃষ্টি করে। আর যখনই দু’টি প্লেটের মাঝে ফল্ট (ফাঁক) তৈরি করে এনার্জি বের হবে তখন চাপের মাত্রা অনুযায়ী কেঁপে উঠবে অঞ্চল বিশেষ। সিলেট অঞ্চল তথা বাংলাদেশ ইন্দো-বাংলা ও ইউরোশিয়ান প্লেটে অবস্থিত। এসব প্লেটে ভারত-নেপালও রয়েছে।’

শনিবার নেপালে সৃষ্ট ভূমিকম্পের কারণে ওই অঞ্চলে জমা হওয়া এনার্জি অনেকটা ক্ষয় হয়ে গেছে উল্লেখ করে ড. জহির বলেন, ‘সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ তথা সিলেটে ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানার আশঙ্কা অনেকটা কেটে গেছে। তবে মৃদু আকারের ভূমিকম্প আরো হবে। কারণ এনার্জির চাপে একাধিক প্লেটের মধ্যে যে ফাঁক তৈরি হয়েছে তা ধাপে ধাপে কমে আসবে। আর সেজন্যই ধাপে ধাপে অনুভূত হবে মৃদু ভূ-কম্পন।’

এক প্রশ্নের জবাবে ড. জহির বিন আলম বলেন, ‘শিগগির উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা না থাকলেও মাত্র ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে উৎপত্তিস্থল যদি ইন্দো-বাংলা প্লেটের ডাউকি ফল্টে থাকে তবে সিলেটে প্রাণহানীসহ ব্যাপক ক্ষতি হবে। আর মাত্রা ৭-এর উপরে হলে ধ্বংসের জনপদে রূপ নেবে সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকাসহ দেশের বিশাল এলাকা।’

তিনি বলেন, ‘আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- সিলেটে নতুন করে একাধিক ফল্ট পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো খুবই একটিভ। সিলেট অঞ্চলের মাটির গঠন রূপও ভাল নয়।’

ক্ষয়ক্ষতি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক জহির বলেন, ‘বিষয়টি যেমন নির্ভর করে ভূমিকম্পের মাত্রার উপর আবার তা সেখানকার ভূমির গঠন রূপ এবং জনবসতি ও অবকাঠামোর উপরও নির্ভর করে। আর সিলেটের ভবনগুলোর বেশিরভাগই গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করেই এসব তৈরি করা হয়েছে। ঠিকমতো হয়নি এর মাটি পরীক্ষাও। রাখা হয়নি প্রতিরোধক ব্যবস্থা।’

তিনি ২০০৬ সালে চালিত এক পর্যবেক্ষণ জরিপের তথ্য তুলে ধরে বলেন, ‘সিলেটে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই প্রায় ১৫শ’ ভবন ভেঙে পড়বে। বিশেষ করে নগরীর ২৩টি ভবন খুবই ঝুকিপূর্ণ। এগুলো সংস্কার করে বাসযোগ করার জন্যও বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।’

তবে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত অনেক বাসা-বাড়ি এখনো বাসযোগ্য রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেগুলোর নির্মাণ কাজ ছিল পরিকল্পিত। আর ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে ছোট ছোট কক্ষ রাখা হলে ক্ষতির পরিমাণ কম হয়।’

ড. জহির ভূমিকম্প হলে আতঙ্কিত না হয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে নিরাপদ স্থানে অবস্থান করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘তাড়াহুড়ো করলে বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের দেশে পর্যাপ্ত উপকরণ ও ব্যবস্থা নেই জানিয়ে ড. জহির বিন আলম বলেন, ‘দেশের প্রতিটি দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে। অথচ ওই বিভাগটির এখনো আধুনিকায়ন হয়নি বলে আমার ধারণা। বিশেষ করে তাদের কাছে বড় দুর্যোগ মোকাবেলা করার মতো যন্ত্রপাতিও নেই। তাই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে যেমন বিল্ডিং কোড মেনে সুষ্ঠু পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থাপনা নির্মাণ করা প্রয়োজন তেমনি ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে উদ্ধার কাজের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতিও প্রয়োজন। একইসঙ্গে প্রয়োজন সংশ্লিষ্টদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং জনসচেতনা সৃষ্টি করাও।’

ভূমিকম্পের স্থায়ীত্ব সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ সেকেন্ড থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শনিবারের ভূমিকম্পের স্থায়ীত্ব ছিল প্রায় ৯০ সেকেন্ড। তাই এ বিষয়টি গবেষণা ও ভাবনার অবকাশ রাখে।’



মন্তব্য চালু নেই