স্বামীর পথ ধরে অপরাধে নারী

অপরাধে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে মাদক দ্রব্য, অস্ত্র ও ডাকতিতে তাদের সম্পৃক্ততা বেশি দেখা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘সহানুভুতিশীল’ ও ‘সামাজ ব্যবস্থার’ সুযোগে নারীদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার হার ক্রমাগতই বাড়ছে। বিশেষ করে অপরাধী স্বামীর পথ ধরে স্ত্রীরাও জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সমাজ বিজ্ঞানী ও পুলিশ কর্মকর্তারা।

নগরীর আলকরণ এলকায় বোমা মেরে সোনার দোকানে ডাকাতির ঘটনায় বুধবার গ্রেপ্তার হওয়া ডাকাতদের সহযোগী হিসেবে চার নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে ডাকাত মনিরের স্ত্রী জুলেখা বেগম (৩১) ও খোরশেদা আক্তার এবং আবুল কালামের স্ত্রী হাসিনা বেগম (৩৪)। এই তিন নারী বোমা বানানো এবং বহনে বিশেষভাবে পারদর্শী বলে জানিয়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া আরেক নারী রুমা বেগম (২৮) ডাকাতদের সোর্স হিসেবে কাজ করে থাকেন।

কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) নেজাম উদ্দিন বলেন, ‘জুলেখা ও খোরশেদার স্বামী মনির এবং হাসিনার স্বামী কালাম ১৩ ডিসেম্বর রাতে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির সময় বিস্ফোরিত বোমায় গুরুতর আহত হয়। তারা পুলিশ হেফাজতে বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মনির ও কালাম তাদের স্ত্রীদের বোমা বানানো ও বহনের কাজে ব্যবহার করে। স্বামীরা ডাকাতি করে আর স্ত্রীরা বোমা বানিয়ে তা সরবরাহ করে। ওইদিন ডাকাতিতে ব্যবহৃত বোমাও মনিরের স্ত্রী বানিয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।’

Ctg স্বামীর পথ ধরে অপরাধে নারীগত ১৪ অক্টোবর বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল গ্রামে ডাকাতের সোর্স হিসেবে কাজ করার অভিযোগে ফেরদৌস আরা (৩৫) নামে এক নারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এসময় তার কাছ থেকে দু’টি দেশি বন্দুক ও ২০ রাউন্ড গুলি, একটি বিদেশি পিস্তল ও ১২ রাউন্ড গুলি এবং একটি বন্দুকের বাঁট উদ্ধার করে পুলিশ। তিনিও হানিফ নামে তালিকাভুক্ত এক ডাকাতের স্ত্রী। স্বামী তার দল নিয়ে ডাকাতি করার আগে স্ত্রী বিভিন্ন এলাকা ঘুরে রেকি করে এসে স্বামীকে তথ্য সরবরাহ করতেন। তারপর সুযোগ বুঝে তার দেয়া তথ্যেই তারা ডাকাতি সংঘটিত করতো।

গত ১২ ডিসেম্বর নগরীর চান্দগাঁও থানার মোহরা এলাকা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গুলিসহ ছলিমা আক্তার (২২) নামে এক নারী ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এসময় তার কাছ থেকে একটি রাইফেল, ছয়টি একনলা বন্দুক, ২৬ রাউন্ড শর্টগানের গুলি, ৯ রাউন্ড রাইফেলের গুলি, পাঁচটি টর্চ ও পাঁচটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে। তালিকভুক্ত ডাকাত জাফরের স্ত্রী ছলিমার সহযোগী মাহবুবকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া নগরীর বাকলিয়া থানা এলাকা থেকে ইয়াবা বহনের দায়ে বেশ কয়েকজন নারীকে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

নগর পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালি) শাহ মুহাম্মদ আব্দুর রউফ বাংলামেইলকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বেগজনকভাবে অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ছে নারীরা। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে এ কাজটি করছেন নারী অপরাধীরা।’

এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এসি রউফ বলেন, ‘প্রথমত, যে হারে পুরুষ পুলিশ সদস্য আছে, সে হারে নারী পুলিশ সদস্য নেই। কোনো অভিযানে বা তল্লাশির সময়ে সাধারণত নারীদের তেমন তল্লাশি করা হয় না, যে ভাবে পুরুষদের করা হয়। এই সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়ে নারীরা মাদকসহ অস্ত্র বহন করার কাজ করে থাকে।’

Ctg-1 স্বামীর পথ ধরে অপরাধে নারীএ পর্যন্ত নগরীতে বেশিরভাগ নারী অপরাধী ধরা পড়েছে বাকলিয়া থানায়। এ প্রসঙ্গে বাকলিয়ার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘নারীরা অপরাধ করলেও সাধারণত মানুষের দৃষ্টির বাইরে থাকে। তাদের তেমন কেউ সন্দেহ করে না। নারীর প্রতি পুলিশ কিংবা মানুষের সহানুভূতিশীলতার সুযোগ নিয়ে তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।’

চট্টগ্রামে নারী অপরাধীর সংখ্যা ক্রমাগতই বাড়ছে জানিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ছগির মিয়া বলেন, ‘আগের তুলনায় নারী হাজতির সংখ্যা কারাগারে বেশি আসছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই মাদক, ডাকাতি ও অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছে। এদের শতকরা ৯৫ ভাগেরই স্বামী রয়েছে এবং তাদের অনেকের স্বামীও এসব অপরাধে কারাগারের বাসিন্দা।’

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন বলেন, ‘সমাজে নারীদের যেমন অগ্রযাত্রা হচ্ছে, ঠিক তেমনি একটি শ্রেণী অপরাধ জগতেও প্রবেশ করছে। মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের প্রত্যাশা কিংবা চাহিদার সঙ্গে প্রাপ্তির মিল না থাকায় তারাও এক সময় নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। প্রথম দিকে তারা ছোট ছোট অপরাধ করে কিছু লাভবান হয়, সে জন্য পরবর্তীতে বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আর তাদের এসব কাজে ব্যবহার করতে সদা প্রস্তুত সমাজের এক শ্রেণীর মাফিয়া। ফলে এসব নারীদের ফ্যান্টাসিটাও বাড়তে থাকে, আর পাল্লা দিয়ে অপরাধের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। এক সময় মাদক ও অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সমাজের বৃহৎ একটা অংশ জড়িয়ে পড়ে। যার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থার ওপর পড়ছে।’



মন্তব্য চালু নেই