আচরণবিধি সংশোধন চূড়ান্ত

‘শ্বশুর বাড়ির উপহারও ৫০ হাজার টাকার বেশি নয়!’

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপহার নেওয়ার সীমা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী শ্বশুরবাড়িসহ অন্য কোনো জায়গা থেকে ৫০ হাজার টাকা বা তার সমপরিমাণের বেশি উপহার নিতে পারবেন না।

এ ছাড়া সরকারের অনুমতি ছাড়া ৫ লাখ টাকার বেশি স্থাবর সম্পত্তি ও ১০ লাখ টাকার বেশি অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হতে পারবেন না। তবে সরকারের অনুমতি নিয়ে তিনি এর চেয়ে বেশি সম্পত্তির মালিক হতে পারবেন। তবে অনুমতি নেওয়ার সময় আয়ের উৎস সম্পর্কে সরকারকে জানাতে হবে। এমন বিধান যুক্ত করে ‘সরকারি কর্মচারী আচরণবিধিমালা-১৯৭৯’-এর সংশোধনী খসড়া চূড়ান্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরবর্তী কার্যক্রম সম্পন্ন করে শিগগিরই এটি প্রণয়ন করা হবে। আচরণবিধিমালা লঙ্ঘনের অপরাধ ‘অসদাচরণ’ বলে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরি থেকে বরখাস্ত করার বিধান বহাল রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

প্রস্তাবিত বিধিমালায় সরকারি কর্মচারীর স্বামী বা স্ত্রীর রাজনৈতিক সংগঠনে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি সরকারকে জানানো বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বামী বা স্ত্রীর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকলে তা সরকারকে জানানো বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। বিদ্যমান বিধিমালায় সরকারকে জানানোর নিয়ম থাকলেও বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীই তা গোপন রাখতেন।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, সরকারি কর্মচারী আচরণবিধিমালা সংশোধনের কাজ চলছে। এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও হয়েছে। মূলত বিধিমালায় কয়েকটি ধারায় সংশোধনী আসছে। এতে কিছু নতুন বিষয় যুক্ত করার চিন্তা-ভাবনাও রয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যমান বিধিমালায় যে অস্পষ্টতা রয়েছে, তা দূর করার চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অপর একটি সূত্র জানায়, আচরণবিধিমালা সংশোধনীর একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ অর্জন ও উপহার গ্রহণের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। কারণ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে সংশোধনীর যে মতামত পাওয়া গেছে এর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ অর্জন ও উপহার গ্রহণের পরিমান বাড়ানোর পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, বিদ্যমান বিধিমালায় এর পরিমাণ যা রয়েছে তা বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এসব দিক বিবেচনা করে এ পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে।

জানা গেছে, বিদ্যমান সরকারি কর্মচারী আচরণবিধিমালায় অনেক বিষয় অস্পষ্ট। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে অস্বাভাবিক পরিমাণ অর্থ ও সম্পদের মালিক হয়েছেন। বর্তমান বিধিতে বলা আছে, ইমারত নির্মাণ করতে হলে আয়ের উৎস উল্লেখ করাসহ সরকারের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। ফলে সরকারি কর্মচারীরা বাড়ি নির্মাণ করার বদলে বাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনছেন। এতে আয়ের উৎস দেখাতে হচ্ছে না, কিংবা সরকারের অনুমোদন নেওয়া লাগছে না।

সংশোধিত বিধিতে বলা হচ্ছে, বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট নির্মাণ বা কেনার ক্ষেত্রে প্রকৃত বাজারদর উল্লেখ করে বিনিয়োগকৃত অর্থের উৎস জানানোসহ সরকারের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বাস্তবে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি না থাকলে অনুমোদন মিলবে না। আত্মীয়স্বজন কিংবা কারও কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ দেখালে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঋণ প্রদানকারীর পক্ষ থেকে লিখিত প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে। আপন ভাই হলেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। আয়কর রিটার্নেও এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য থাকতে হবে। এ ছাড়া সংশোধনীতে সরকারি কর্মচারীদের সামাজিক দাওয়াত গ্রহণের ওপর নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে।

সচরাচর দেখা যায়, সরকারি কর্মকর্তারা প্রটোকলের বাইরে কর্মস্থল এলাকায় ঠিকাদারসহ সমাজের বিশেষ ব্যক্তিদের বাসায় গিয়ে কিংবা নিমন্ত্রণে যোগ দিয়ে দাওয়াত খেয়ে থাকেন। এতে করে দুর্নীতির নানা পথ প্রশস্ত হয় এবং নিমন্ত্রণদাতারা প্রশাসনিকভাবে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে থাকেন। এ জন্য ডিসি-এসপিসহ সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী তার কর্মস্থলের আশপাশের এলাকায় দাওয়াত খেতে পারবেন না। তবে এক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়দের বিয়ে-শাদি ও সামাজিক অনুষ্ঠান গণ্য হবে না। নতুন এ বিধিমালা প্রণয়ন হলে সরকারি কর্মকর্তারা ইচ্ছা করলেও যত্রতত্র দাওয়াত গ্রহণ করতে পারবেন না।

সংশোধিত বিধিমালার ২৭(বি) ধারাকে আরও স্পষ্ট করা হচ্ছে। এতে সরকারি কর্মচারীর স্বামী বা স্ত্রীর রাজনৈতিক সংগঠনে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি সরকারকে অবহিত করা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। বিদ্যমান বিধিমালায় এ নিয়ম থাকলেও এর খুব একটা প্রতিপালন হতো না। কিন্তু সংশোধনীতে প্রতিপালনের বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রাজনীতিতে বা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনে সম্পৃক্ত হতে পারবেন না। কারও বিরুদ্ধে এ ব্যাপারে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে বরখাস্ত করা হবে।

এ ছাড়া আরেকটি উপধারায় বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীর স্বামী বা স্ত্রী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে সরকারকে অবহিত করতে হবে। এটি কোনো কর্মকর্তা না করলে তার বিরুদ্ধে বিভাগী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সরকারকে অবহিত করে সরকারি কর্মচারীর স্বামী বা স্ত্রী রাজনীতি করতে পারবেন। এ ছাড়া প্রত্যেক বছরের জানুয়ারি মাসের মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক মূল্যায়ন রিপোর্ট (এসিআর) জমা দেওয়ারও বিধান রাখা হচ্ছে সংশোধনী বিধিমালায়।

সূত্র জানায়, বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী শ্বশুরবাড়িসহ যে কোনো জায়গা থেকে ২৫ হাজার টাকার বেশি উপহার নিতে পারতেন না। সংশোধনী বিধিমালায় এটি দ্বিগুণ করে ৫০ হাজার টাকা করা হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ অর্জনের সীমা দ্বিগুণ হচ্ছে। এখন থেকে তাদের ৫ লাখ টাকার নিচে অস্থাবর সম্পত্তি ও ১০ লাখ টাকার নিচে স্থাবর সম্পত্তি কিনতে সরকারের অনুমতি নেওয়া লাগবে না। এর বেশি হলে সরকারের অনুমতি নেওয়া লাগবে। আয়ের উৎস সম্পর্কে জানাতে হবে। বিদ্যমান বিধিমালায় অনুমতি ছাড়াই সরকারি কর্মচারীরা আড়াই লাখ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি ও ৫ লাখ টাকার স্থাবর সম্পত্তির মালিক হতে পারতেন। সরকারি কর্মচারীরা অষ্টম বেতন কাঠামো অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন। নতুন বেতন কাঠামোয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন ৯১-১০১ ভাগ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ভাতাও বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।

গত জুলাই থেকে নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর হলেও ভাতা কার্যকর হবে আগামী অর্থবছর থেকে। বেতন বাড়ার সঙ্গে কর্মচারীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সীমা বাড়ানোরও দাবি উঠেছে। তাদের মতে, বর্তমানে সম্পদ সংরক্ষণের যে সীমা রয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে আচরণবিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিধিমালার খসড়া তৈরিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিয়ে একাধিক বৈঠকের মাধ্যমে খসড়াটি চূড়ান্ত করেছে। -সমকাল



মন্তব্য চালু নেই