সৎ মায়ের স্বীকারোক্তি

ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানোয় মুখে কাপড় চেপে সন্তানকে হত্যা করল মা!

শারীরিক অসুস্থ্যতার কারণে রাতে ভালো ঘুম হতো না শিশু মাইমুনা আক্তারের সৎ মা সুমাইয়া ইসলাম শারমিনের। এ কারণে তিনি তিনটি ঘুমের ট্যাবলেট সেবন করে ঘুমাতে যান। ঘুমানোর আগে মাইমুনাকে তিনিই নিয়ে আসেন নিজের বিছানায়। তবে গভীর রাতে মাইমুনা বাথরুমে যাওয়ার জন্য জেগে ওঠে। সে শারমিনকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। চোখে বেশি ঘুম থাকার কারণে শারমিন না উঠে মাইমুনাকে একাই যেতে বলেন। মাইমুনা একা যেতে ভয় পায় বলে দাঁড়িয়ে থাকে। এক পর্যায় কান্নাকাটি শুরু করে। মাইমুনার চিৎকারে শারমিনের দেড় মাস বয়সী মেয়ে মারিয়া ইসলাম কিপতিয়াও ঘুম থেকে জেগে কান্না শুরু করে। তখন ক্ষেপে যান শারমিন। বিছানা থেকে উঠে ওড়ানা দিয়ে চেপে ধরেন মাইমুনার মুখ। অনেকক্ষণ পর নিজেই টের পান নিস্তেজ হয়ে গেছে শিশুটি। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে বাথরুমে নিয়ে ড্রামের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে ফেলে রাখেন।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ধলপুর এলাকায় ছয় বছরের শিশু মাইমুনা আক্তার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত সৎ মা শারমিন সোমবার আদালতে স্বীকারেক্তিমূলক জবানবন্দিতে এভাবেই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন। দুই দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম স্নিগ্ধা রানী চক্রবর্তীর আদালতে হাজির করা হলে আদালত তার স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন।

হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে শারমিন বলেছেন, ‘আমি তার (মাইমুনা) মুখে ওড়না দিয়ে জোড়ে চেপে ধরি। কিছুক্ষণ পরে দেখি আমার হাতের মধ্যে ও নিস্তেজ হয়ে গেছে। তখন বুঝতে পারি সে মরে গেছে।’

জবানবন্দিতে শারমিন দাবি করেন, তিনি শিশু মাইমুনাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেননি। ঘুমের ওষুধ সেবন ও ঘুম থেকে জাগানোর কারণে উত্তেজিত হয়ে তিনি ঘটনাটি ঘটিয়েছেন। আর হত্যার পর তিনি কী করবেন তা বুঝে উঠতে পারেননি। এই জবানবন্দিতে শারমিন ঘটনার সঙ্গে অন্য কেউ জড়িত নয় বলেও জানিয়েছেন।
তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, শারমিন প্রায়ই মাইমুনাকে নির্যাতন করেছেন। পুলিশের কাছে দেয়া স্বীকারোক্তিতে একটি হত্যার বর্ণনা পাওয়া গেলেও কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শারমিন আদালতের কাছে দেয়া স্বীকারোক্তিতে নিজের দোষ কমানোর চেষ্টা করলেও হত্যার দায় এড়ানোর চেষ্টা করেননি।

শারমিন বরেছেন, মাইমুনার বাবা আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হওয়ার পর শিশু মাইমুনাকে তিনি আদরই করতেন। নিজের মেয়ের মতোই লালন-পালন করেছেন। দেড় মাস আগে সিজার অস্ত্রপচারে তার ঔরসজাত ছোট মেয়ে কিপতিয়ার জন্ম হয়। এখনো তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি। কয়েক রাত তার ভালো ঘুম হচ্ছিল না।

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তার স্বামী আব্দুর রাজ্জাক গ্রামের বাড়ি যান। একা ঘুমাতে ভয় পান বলে মাইমুনাকে তিনি নিজের কাছে নিয়ে আসেন। তা-না হলে মাইমুনা তার দাদি ফুলমতির কাছে ঘুমাতো। রাতে তিনটি ঘুমের ওষুধ (ট্যাবলেট) সেবন করে তিনি ঘুমাতে যান। বাচ্চারাও ঘুমিয়ে পড়ে। রাত সাড়ে ৩টার দিকে মাইমুনা জেগে ওঠে। সে বাথরুমে যাওয়ার জন্য শারমিনকে ডেকে তোলে।

শারমিনের দাবি, তখন ঘুমে ঢলঢল করছিল তার দুই চোখ। তিনি মাইমুনাকে একাই বাথরুমে যেতে বলেন। মাইমুনা ভয় পায় বলে একা যেতে রাজি হয় না। একপর্যায় মাইমুনা কান্না শুরু করে। তখন বিছানা থেকে উঠে হাত দিয়ে মাইমুনার মুখ চেপে ধরেন শারমিন। এ সময় মাইমুনা মুখ ছাড়িয়ে নিয়ে জোড়ে চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকারে কিপতিয়াও ঘুম থেকে জেগে ওঠে এবং কান্না শুরু করে।

হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে শারমিন বলেন, এ পর্যায়ে প্রচণ্ড রেগে যান তিনি। এবার বিছানা থেকে উঠে মাইমুনার মুখে ওড়না দিয়ে জোরে চেপে ধরে রাখেন। তখন মাইমুনা হাত-পা নাড়িয়ে তার হাত থেকে ছোটার চেষ্টা করে। একপর্যায় সে চেষ্টা বন্ধ হয়ে যায়। শারমিনের হাতের মধ্যেই মাইমুনার পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখন শারমিন বুকে হাত দিয়ে এবং হাতের পালস পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন মাইমুনা মারা গেছে।

শারমিনের ভাষ্য, তখন তিনি কী করবেন বুঝতে পারিছিলে না। প্রথমে সিদ্ধান্ত নেন স্বামী আব্দুর রাজ্জাককে মোবাইল ফোনে ঘটনাটি জানিয়ে ক্ষমা চাইবেন। কিন্তু শারমিনের মোবাইল ফোনে কল করার মতো ব্যালেন্স (টাকা) ছিল না। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন অন্য কারো কাছে ঘটনাটি প্রকাশ করবেন না। তখন মাইমুনার নিথর দেহটিকে টেনেহেচরে বাথরুমে নিয়ে যান। সেখানে একটি ড্রামে সামান্য পানি ছিল। ওই পানির মধ্যে মাইমুনার মাথাটি ডুবিয়ে তাকে ফেলে রাখেন শারমিন। এরপর কখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তা মনে নেই।

পুলিশের কাছে দেয়া ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে শারমিন বলেছেন, তিনি বিছানায় গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ভোরে কিপতিয়ার চিৎকারে তার ঘুম ভাঙে। তবে আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবাবনবন্দিতে তিনি কোথায় জ্ঞান হারান এবং কখন, কীভাবে জ্ঞান ফিরে তা উল্লেখ করেননি।

শারমিন আদালতকে জানান, জ্ঞান ফেরার পর তিনি আর ঘুমাতে পারেননি। ভোরেই শ্বাশুড়ি ফুলমতি এসে নাতনির খোঁজ করলে শারমিন তাকে বলেন, মাইমুনা বাথরুমে গেছে। এরপর ফুলমতির সঙ্গে তিনিও বাথরুমে খুঁজতে যান। সেখানে মাইমুনাকে মৃত্যু পড়ে থাকতে দেখে শারমিনও চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পুলিশ আটক করার আগে প্রাথমিকভাবে কেউই ঘটনাটি শারমিন ঘটিয়েছে বলে ধারণা করেনি। স্বীকারোক্তিতে শারমিন ঘটনার সঙ্গে তিনি ছাড়া অন্য কেউ জড়িত নয় বলেও উল্লেখ করেছেন। তবে প্রতিটি বক্তব্যের অংশে শারমিন হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত নয় বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।

এদিকে মাইমুনা হত্যার পর পুলিশের সুরতহালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তার বাম হাতটি ভেঙে গিয়েছিল। এছাড়া তার বাম পায়ে একটি কামড়ের দাগও ছিল। তবে শারমিনের বক্তব্যে এ ধরনের নির্যাতনের বর্ণনা পাওয়া যায়নি। শুধু একটি অংশে শারমিন উল্লেখ করেন, ‘চেপে ধরার কারণে সামন্য আঘাত পেয়েছে।’
মাইমুনার চিৎকারে ছোট মেয়ে কিপতিয়া উঠে গেছে বলা হলেও দুই বছরের বড় মেয়ে মাইশা ইসলাম লামিয়া ঘুম থেকে জেগেছে কি-না এবং দাদি ফুলমতি কান্নার শব্দ পাননি কেন? এমন প্রশ্নের জবাব মিলেনি শারমিনের বক্তব্যে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মনিমুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের কাছে জবানবন্দিতে শারমিন অনেক বিষয় ক্লিয়ার করেননি। আদালতের কাছে হয়তো করেছেন। আমরা এসব বিষয় পর্যালোচনা করে তদন্ত করছি।’

যাত্রাবাড়ী থানার ওসি অবনি শংকর কর বলেন, ‘আমাদের তদন্তে দেখা গেছে শারমিনের ঔরসজাত দুই ছোট কন্যার চেয়ে মাহারা মাইমুনাকে বাবা রাজ্জাক বেশি আদর করতেন। এছাড়া মাইমুনার জন্য ব্যাংকে চার লাখ টাকাও রেখেছেন রাজ্জাক। এ কারণে শারমিনের প্রতিহিংসা থাকতেই পারে। শারমিন মাইমুনাকে আগে মারধরও করেছেন। স্বীকারোক্তিতে তুচ্ছ কারণে হত্যার কথা বলা হলেও এটি পরিকল্পিত হত্যা কি-না তা আমরা খতিয়ে দেখব।’

প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার ধলপুর খালেকুজ্জামান গলির ভাড়া বাসা থেকে স্থানীয় হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) মাহিলা মাদরাসার শিশু শ্রের্ণীর ছাত্রী মাইমুনার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধারের সময় তার মাথা ছিল ড্রামের ভেতরে এবং হাত-পায়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন। ওই দিনই মাইমুনার সৎ মা শারমিনকে গ্রেপ্তারের পর শনিবার থেকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।



মন্তব্য চালু নেই