ভারতবর্ষের প্রাচীন উৎসব সত্যায়নি ব্রতকথা

অগুণতি উৎসবের লীলাক্ষেত্র প্রাচীন ভারতবর্ষ। পাশ্চাত্যকে তার উৎসবের ভিত্তি খুঁজতে হয় বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে। কিন্তু প্রাচ্যের এই প্রাচীন ভারতবর্ষ গোড়া থেকেই ছিল হরেক রকমের উৎসবের তীর্থক্ষেত্র। মানবজীবনের হাসি-আনন্দ-কান্না কিংবা সুখ-দুঃখকে দার্শনিক ভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে নানান উৎসব চালু ছিল এখানে। প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশের নীতি অনুযায়ী মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে ছিল নিবিঢ় সম্পর্ক। আর এই সম্পর্কের মাঝে গভীর বুনন হিসেবে কাজ করতো এক একটি উৎসব। মূলত সনাতন ভারতবর্ষ যখন প্রথাভিত্তিক ধর্মরীতিতে অর্থাৎ হিন্দুধর্মে রূপান্তরিত হলো তখন থেকেই মানব আর প্রকৃতির সম্পর্কে আরোপিত কিছু বিষয় চলে আসে।

BRATA-KATHA

আরোপিত কোনো কিছুই প্রকৃতি যেমন মেনে নিতে পারে না। তেমনি প্রকৃতির মানবও আরোপিত কোনো বিষয় নিতে পারেনি, তবে সময় আর জাগতিক চাহিদার এক পর্যায়ে মানুষ যন্ত্র সভ্যতার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। এই বাধ্য হওয়ার কারণে ভারতবর্ষের প্রাচীন মানবশরীর হারায় অনেক উৎসব। এতোদিন যা ছিল প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশের অংশ, যন্ত্রসভ্যতায় এসে তা হয়ে যায় অবশ্য পালনীয়। আর এই অবশ্য পালনীয় বাধ্যগত উৎসব পালন করতে গিয়ে মানুষের মাঝে চলে আসে বীতশ্রদ্ধ মনোভাব। যে কারণে ক্রমশ অনেক উৎসবই আমাদের মানবজীবন থেকে হারিয়ে যায়। তেমনি একটি উৎসব সত্যায়নি ব্রতকথা।
BRATA-KATHA3 BRATA-KATHA4প্রাচীন ভারতবর্ষের নারীদের মাঝে মূলত এই উসবের প্রচলন ছিল। শীতকালের শেষের দিকে অর্থাৎ মাঘ মাসের শুরুর দিকে কিংবা ইংরেজি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে এই উৎসবটি পালিত হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহাদেবতা শিবের পত্নী সত্যায়নির নামে এই বিশেষ আয়োজন। পুত্র সন্তান কামনা কিংবা ভালো স্বামী প্রার্থনা করে পবিত্র পানিতে গোসল করে শুদ্ধ বস্ত্র/পোশাক পরিধান করে নারীরা। তবে প্রাচীন আখ্যা অনুযায়ী এই কাহিনীর শুরু হয় মূলত দেবতা শিবের পুত্র কুমার এবং অগস্ত্য মুনির মাধ্যমে। উৎসবটি যেহেতু নারীকেন্দ্রিক তাই একে বলা হতো ব্রতকথা। কারণ শিবকে কেন্দ্র করে সমাজের নারী/প্রকৃতি অংশের যে আশা-আকাঙ্ক্ষা তা বিভিন্ন শ্লোকের মাধ্যমে বয়ান করাই নারীদের কাজ। হিন্দুদের স্কন্ধপুরাণে এবিষয়ে বিস্তারিত লিখিত আছে।

এযাবৎ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সত্যায়নি ব্রতকথার লিখিত রুপটি পাওয়া যায় নেপালি ভাষায়। তবে অনেক বিশ্লেষক এবং বিশেষজ্ঞই মনে করেন যে, নেপালি ভাষায় লেখার আগে সত্যায়নি ব্রতকথা লেখা হয়েছিল ‘নেওয়ারি’ ভাষায়। ভারতের সাঙ্কু অঞ্চলের বাসিন্দারা এখনও নেওয়ারি ভাষার চর্চা করেন। অবশ্য ভাষাকেন্দ্রিক এই বিতর্কের সুযোগও সত্যায়নি ব্রতকথার বিভিন্ন আখ্যান থেকেই সৃষ্ট। কারণ নেওয়ারি ভাষারীতিতে ব্রতকথা পড়লে এর মানে এক দাড়ায় আর নেপালি ভাষায় পড়লে মানে দাড়ায় কিছুটা ভিন্ন।
BRATA-KATHA7 BRATA-KATHA9এই ব্রতকথাকে সামনে রেখে গোটা দিন উপবাস রাখেন হিন্দু নারীরা। এবং উপবাস থাকাকালীন সময়ে সত্যায়নি ব্রতকথা পড়েন তারা। এসময় দেবতার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য ও ধূপবাতি জ্বালানো হয়। তবে বিশেষ আয়োজন হিসেবে থাকে ডালের লাড্ডু। উপবাস শেষে নারীরা এই লাড্ডু খেয়ে উপবাস ভাঙেন। বর্তমান ভারত এবং বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এখন এই উৎসবের প্রচলন দেখা যায় না বললেই চলে। তবে, সম্প্রতি নেপালে বেশ আড়ম্বরেই এই উৎসব পালিত হয়। নেপালি আলোকচিত্রী নবীশ চিত্রকরের কল্যাণে সেই উৎসবের কিছু ছবি পাওয়া গেছে, যা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

BRATA-KATHA5 BRATA-KATHA6 BRATA-KATHA8



মন্তব্য চালু নেই