বাসভবনের নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে অপরুপ সৌন্দর্যে ঘেরা ফলিং ওয়াটার!

বিয়ার রান উপত্যাকার ছোট একটা ছিমছাম এক পাহাড়ী ঝর্ণা কলকল শব্দে আপনমনে বয়ে চলছে। উপত্যাকার চারপাশে ঘন সবুজ বনের আধিক্য। নিশ্চিন্তে বন্য প্রানীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাছপালা চারদিক ঘিরে রেখেছে। পাতা আর ডালের আড়াল কেটে চোখে পড়ে বিশাল এক খোলা বারান্দা।

খোলা বারান্দায় দাড়ালে চোখে পড়বে পানির ধারা আর কানে আসবে পড়ন্ত পানির সুরেলা ধ্বনি। ঝর্নার উৎস খুজতে গেল চমকে উঠবে যে কেউ কারন এ যে একদম বারান্দার নিচ দিয়েই বয়ে চলছে। পায়ের কাছে জমা হয়ে আছে বিভিন্ন বর্নের নুড়ি পাথর। সবমিলিয়ে পাহাড় কেটে তৈরী করা একটি বাড়ি বলেই ধরে নেবেন যে কেউ।

প্রকৃতিকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে স্থপতি যেন একদম প্রকৃতির মাঝে বিলীন হয়ে গিয়েছেন। প্রকৃতি আর স্থাপনা একে একাকার। চোখের দেখায় যা মনে আসবে বাড়িটির নাম আসলে তাই ‘ফলিং ওয়াটার’।

ফলিং ওয়াটার স্থপতি ফ্রাঙ্ত লয়েড রাইটের একটি অমর সৃস্টি যা তাকে বিশ্বব্যাপী মাস্টার আর্কিটেক্ট হিসেবে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। দক্ষিন পশ্চিম পেনসিলভানিয়া একটি গ্রামীন এলাকায় ১৯৩৫ সালে সালে স্থপতি ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট ডিজাইন এবং তত্বাবধানে নির্মিত ছোট্ট পাহাড়ী কুটির।

kolahalblog-1443331787-77c6c9c_xlarge

একটি জলপ্রপাতের উপরে আংশিকভাবে নির্মিত হয়েছিল ফলিং ওয়াটার আসলে এমনই একটা স্থাপত্য কর্ম যা দেখলে মনে হবে পাহাড়ের চুড়ায় কংবা ঝর্নার উৎসমুখে বসে থাকা বিভিন্ন সাইজের কয়েকটি প্লেট। আড়াআড়ি এবং লম্বলম্বি চুপচাপ বসে আছে। স্থপতির দেয়া নাম ফলিং ওয়াটার হিসেবে পরিচিত হলেও বাড়ির মালিক কফম্যানের নামে এর নাম কফম্যান হাউজ

কফম্যান ডিপাটর্মেন্টাল স্টোরের স্বত্তাধিকারী মি কফম্যান ব্যবসায়ী হলেও সৈাখিন রুচির মানুষ। মডার্ণ আর্ঠ এবং ডিজাইন বিষয়ে পড়াশোনা করতেন। তার ছেলে জুনিয়র কফম্যানকে স্হাপত্যে পড়াশোনার উঃসাহ দিয়েছন তিনি। এবং তিনি আশা করতেন তার জন্য এমন একটি কুটির ত্যরী হবে যা আগে কখনো কেউ তৈরী করেনি। তারা এজন্য রাইটকে পছন্দ করলেন কারন তারা জানতেন রাইট প্রকৃতি নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন।

রাইট জানতেন মানুষ প্রকৃতির স্রস্টা না হলেও প্রকৃতিকে পূনর্জন্ম দেয়ার ক্ষমতা তার আছে। এজন্য তার প্রাথমিক আইডিয়া ছিলো এরকম যে তিনি প্রকৃতিকে কোন বিরক্ত করবেন না বরং মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আরো কাছে নিয়ে আসবেন।প্রকৃতি চিরন্তন কিন্তু মানুষ স্বল্পস্থায়ী, একসময় হারিয়ে যাবে। সুতরাং মানুষের জন্য তৈরী স্থাপনাও হবে তেমনই।যদিও ফলিং ওয়াটার হচ্ছে চতুর্দিকে খোলা তবুও একটু কম উচ্চতায় বিস্তৃত তল হবার কারনে ফলিং ওয়াটাররে মধে ঢুকলে এক ধরনের গুহার মত মনে হয়।পাহাড়ী উপত্যকায় যেভাবে মানুষ আশ্রয় নেবার চিন্তা করে ঠিক তেমনি। ফলিং ওয়াটাররের ফর্ম কে দুটি বিশেষ কারনে আলাদা করা যায়। একটি চচ্ছে ডায়নামিজম এবং অপরটি হচ্ছে প্রকৃতির সাথে এক ধরনের একাত্বতা। জাপানিজ স্থাপত্য ধারার অর্গানিক ফিলোসফির ব্যপারে রাইট বেশ আগ্রহী ছিলেন্ এবং বেশ একটা প্রভাব লক্ষ করা যায় এর স্হাপত্য চিন্তায়। বিশেষ করে বহিরাংশের সকল প্রাকৃতিক বৈশিস্ট গুলোকে এমনকি আন্ত পরিসরে বজায় রাখার চেস্টা আছে ।

মানুষ এবং প্রকৃতির মধে্য ঐকতান তৈরীকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রথম পরিদর্শনে গিয়ে রাইট খেয়াল করেছিলেন যে পাহাড়ের দুটো পাথুরে পা একটি আরেকটিকে সমকোনে অতিক্রম করে গিয়েছে এর মধে উপরের পা বেশ খানিকটা ঝুলন্ত অবস্থায় রয়ে গেছে। তিনি তার ̄স্থাপত্যকে ঐ দুটো পায়ের উপরে বিশেষভাবে ভারমুক্ত করার পরিকল্পনা নেন।

পাথরের সাইজ এবং আকৃতি থেকে ধারনা নিয়ে একাধিক মুক্ত তলের চিন্তা এবং একই জিনিষ বারবার ব্যবহার করেন। দুটো পাহাড়ী পায়া এবং তাকে অনুসরন করে দুটো করে মুক্ত তলের এই অদ্ধুত নৃত্য তার ডিজাইনের সবচেয়ে দৃশ্যমান ফিচার। এই দুটোর পুন: পুন: ব্যবহার করে তিনি তার ডিজাইনকে বাস্তবে রূপ দান করেন।

ফ্রান্ক লয়েড রাইটকে নিেয়াগ দের্য়ার ঘটনাটি বেশ চমকপ্রদ। জুনিয়র কফম্যানের শিক্ষক হিসেবে কফম্যানের বাড়িতে বেড়াতে আসেন তিনি। La Tourelle নামে এই বাড়িটিও একজন স্থপতির হাতেই ডিজাইন করা। সবাই মিলে চমৎকার পাহাড়ী উপত্যাকা আর ঝির ঝির শব্দে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্নার সৈান্দযর্ উপভোগ করতে করতে কিছু একটা করার স্বপ্ন দেখতে থাকেন ।

সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া, আড্ডা গল্প আর ঘুরে বেড়ানোর ফাকে রাইট তার ছাত্রকে উদ্দেশ্য করে বলে বসেন এই বাড়িটি সুন্দর তবে তোমার পিতামাতার বসবাসের জন্য যথেস্ট নয়। সিনিয়র কফম্যান কথাটা সিরিয়াসলি ধরে বসেন। স্পস্টতই বুঝতে পারেন। রাইট তার উপত্যাকার দিকে ইঙ্গিত করছেন এবং তিনিও খুব আগ্রহী হয়ে রাইটের সাথে বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলা শুরু করে দেন।জানান তার ইচ্ছার কথা। এমন একটি বাড়ি করতে চান যেখানে বসে তিনি দেখতে চান এই ঝর্নাকে।

প্রথম সাক্ষাতের প্রায় নমাস পরে হঠাৎ একদিন কফম্যানের পক্ষ থেকে জরুরী তলব আসে। রাইটকে এখনই যেতে হবে এবং কফশ্যান তার বাড়ির ডিজাইন দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।রাইট তখন চরম বিপাকে। যদিও ডিজাইন নিয়ে তিনি িনেচর মত করে চিন্তা ভাবনা করেছেন কিন্তু কাউকে দেখানোর মত সামান্য কিছু তার হাতে নেই। ওদিকে কফম্যান নাছোড়বান্দা। অবশেষে উপায়ন্তর না দেখে তখনই খাতা খুলে বসলেন। যেতে যেতে দুঘন্টার মধ্যে দাড় করিয়ে ফেললেন প্রাথমিক নকশা।

কফম্যান মনে মনে আশা করেছিলেন যে বিয়ার রানের দক্ষিন তীরে এমন যায়গায় বাড়িটা নিমার্ন করবেন যেখানে থেকে ওয়াটার ফল সবচেয়ে ভালভাবে দেখা যায়। কিন্তু রাইট তাকে চমকে দিয়ে জানান তিনি একদম ওয়াটার ফলের মাথার উপরেই বাড়িটির প্লান করেছন। রাইটের মুল চিন্তা ছিলো এমন মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যৈ একটি অবিচ্ছেদ্য সেতু বন্ধন তৈরী করা। শুধু তাই নয় শব্দের মত একটি অদ্রশ্য উপাদানকেও তিনি তার স্থাপনার একটি উপাদানে পরিনত করেঝিলেন।স্থাপত্য এবং তার পরিবেশের সাথে নিবিড় সম্পর্ক তৈরী খুব কঠিন ব্যাপার।

kolahalblog-1443332590-2b61b1a_xlarge

একটি বিস্তৃত চারপাশের মধ্যে মুল স্থাপনাটি হারিয়ে যেতে পারে অথবা ছোট্ট একটি স্থাপনাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ওটাই হয়ে যেতে পারে পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বিরক্তিকর উপাদান। শুধুমাত্র কন্সট্রাকশন নয় বরং মেটা ফিজিক্যাল এবং সেনসুয়্যল ডাইমেনশন চিন্তা করতে হয়ভ্যাকেশন হাউস হিসিবেই ফলিং ওয়াটারের জন্ম। প্রকলপএর মুল অংশটি মি কফম্যানের ব্যক্তিগত বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নিজেদের প্রয়োজনীয় বেডরুম, ফ্যামিলি লিভিং, ডাইনিং স্টাডি ইত্যাদির পাশাপাশি অভ্যাগত অতিথিদের জন্য একটি গেস্ট জোন তৈরী করা হয়।গেস্ট জোনটির অবস্থান বাড়িতে প্রবেশের সামনের দিকে। বিশাল ড্রয়িং রুম পুরোটাই ঝুলন্ত।

রাইট নিজে দুসাহসের পরিচয় দিয়ে সংশ্লিস্ট প্রকৈাশলীকে নির্দেশনা দিয়ে এই ঝুলন্ত অংশের নির্মান কৌশল ঠিক করেন। মি কফম্যান চাইতেন তার বন্ধু বান্ধব আত্নীয় স্বজন নিয়ে প্রান্বন্ত অবসর কাটাতে। সুতরাং তার বড়সড় লিভিংরুম দরকার ছিলো। লিভিংরুম থেকে একটি ঝুলন্ত সিড়ি নিচে উম্মুক্ত পানির ধারায় নেমে পড়েছে। শীতের সময় পানি জমে বরফের লেয়ার তৈরী হয়ে একটি ভিন্ন অনুভুতির তৈরী হয়।

kolahalblog-1443332719-3803169_xlarge

শীত শেষ বসন্ত আসা মাত্রই উল্টো চিত্র। ঝুলন্ত বারান্দা, নিচে নেমে আসা সিড়ি, ঝির ঝির পানি আর চারপাশে হাসতে থাকা রং বেরংয়ের ফুলের মিতালী দশর্নার্থীদের জন্য প্রাকৃতিক অভ্যর্থনা দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে।মুল বাড়ির উল্টোদিকে পাহাড়ের ঢালে কারপার্কিং এবং সারভেন্ট কোয়ার্টার। কফম্যান হাউজের অন্তর্গত বিন্যাস মোটামোটি এমনই।।ভবনের নির্মান উপকরনও খুব সাধারন কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ।

কাস্টিং কনক্রিট, স্যান্ড স্টোন, গ্লাস এবং স্টিল এই চারটি প্রয়োজনীয় উপকরন ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক বেশি গ্লাস ব্যবহার করা হয়েছে ফলে একদিকে চতুর্দিকটা সবসময়ই দৃশ্যমান থাকছে। অপরদিকে মাথার উপরে বিস্তৃত মুক্ততলের উচ্চতা কম হবার কারনে পাহাড়ী গুহার অনুভুতি কাজ করছে। বাহিরে এবং এমনকি ভিতরেও কনক্রিট এবং স্যান্ডস্টোনকে যথা সম্ভব কোন রকম আস্তর বিহীন রাখা হয়েছে।প্রয়োজন বোধে ক্রনক্রিটের জন্য একধরনের মেটে রং এবং স্টীলের আস্তরে বসন্তের লালচে রং কে পছন্দ করেছেন। প্রকৃতিকে ঠিক যতখানি সম্মান দেয়া যায় তার সবোর্চ্চ উদাহরন হচ্ছে এই কফম্যান হাউজ।

kolahalblog-1443332899-8f49e61_xlarge

১৯৩৮ সালে টাইম ম্যাগাজিনে ফলিং ওয়াটার এবং ফ্রান্ক লয়েড রাইটকে নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পর দর্শনার্থীর ঢল নামে। টাইম ম্যাগাজিন এটিকে অভিহিত করে স্থপতি রাইটের শ্রেস্ট সৃস্টি হিসেবে।দর্শনার্থী এবং দুরের অতিথিদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়। ভবনের বর্ধিত অংশ নির্মান করা হয় বছর দুই পরেই। মুল বাড়ি থেক একটু সামনে এগিয়ে এসে আলাদা গেস্ট হাউস নির্মান করা হলেও মুল বাড়ির ডিজাইনের সাথে মিল রেখেই এটির কাজ করা হয় যার দরুন একে আলাদা মনে হয় না।১৯৩৭ সালে কাজ সম্পন্ন হবার পর থেকে ১৯৬৩ সাল পযর্ন্ত কফম্যান পরিবারের নিজস্ব আবাস হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। ১৯৬৩ সালে কফম্যান জুনিয়র এটিকে দিয়ে দেন ওয়েস্টার্ন পেনসিলভানিয়া কনজারভেন্সী নামক রাস্ট্রীয় সংস্থার হাতে। ততদিনে এটি খ্যাতি অজর্ন করেছে। ১৯৬৬ সালে এটি জাতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেব গৃহিত হয়। ১৯৯১ সালে আমেরিকান স্থপতি ইন্সটিটিউট এটিকে সবর্কালের সবর্শ্রেস্ট আমেরিকান স্থাপত্য হিসেবে ঘোষনা করে।

প্রয়োজনীয় পরিবধর্ন এবং সংস্কার শেষে পরের বছরই এটিকে উম্মুক্ত করে দেয়া হয় মিউজিয়াম হিসেবে। বিগত ৭৭ বছরে প্রায় ৫০ লক্ষ দর্শনার্থী এ স্থাপত্যটি পরিদশর্ন করেছে।



মন্তব্য চালু নেই