পাঠ্যবই বাংলাদেশের, সিদ্ধান্ত ওয়াশিংটনে!

প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক ছাপার বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি শিক্ষা প্রশাসন ও বিশ্বব্যাংক। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ্যপুস্তক ছাপার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের আরোপিত শর্তের বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে। শিক্ষামন্ত্রীকে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শর্ত শিথিলের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিস্থ সংস্থার সদরদপ্তর থেকে।

সোমবার সন্ধ্যায় সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে শিক্ষা প্রশাসন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), বিশ্বব্যাংক ও মুদ্রণকারীদের যৌথ বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ছাড়াও বৈঠকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান, গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মেছবাহ উল আলম, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর, শিক্ষা প্রশাসন, এনসিটিবি, বিশ্বব্যাংক ও মুদ্রণকারীদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

এ প্রসঙ্গে বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য বিশ্বব্যাংক নতুন করে কিছু শর্ত দিয়েছিল। আমরা বলেছি, শর্ত বিশ্বব্যাংক আগেই দিয়েছে। এছাড়া মুদ্রণকারীরা যখন ছাপার কাজ পেয়েছে, সেখানে শর্তও উল্লেখ থাকে। এক শর্তের পর আরেক শর্তের প্রয়োজন হয় না। বিশ্বব্যাংকের চাহিদা পাঠ্যবইয়ের ছাপা যেন মানসম্মত হয়, সেটা আমরাও চাই। এ বিষয়ে কোনো আপোষ করা হবে না।’ মন্ত্রী দাবি করেন, বিশ্বব্যাংক নতুন শর্ত নিয়ে আর চাপাচাপি করেনি।

বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে সবপক্ষই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। বিশ্বব্যাংক শর্তের বিষয়ে অটল থাকলে শিক্ষামন্ত্রী তাদেরকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমরা সবপক্ষই চান পাঠ্যবইয়ের ছাপা যেন মানসম্পন্ন হয়। এ বিষয়ে কোনো আপোষ করা যাবে না। কিন্তু পাঠ্যবইয়ের মানের চেয়ে আমাদের কাছে পহেলা জানুয়ারি নতুন পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়াটাই বড়। সেজন্য আমাদের এতটা শক্ত হলে চলবে না।’

শিক্ষামন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা জানান, শর্তের বিষয়ে তাদেরকে ওয়াশিংটন ডিসিতে (বিশ্বব্যাংকের সদরদপ্তর) কথা বলতে হবে। কারণ, সেখানেই সব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। সুতরাং, সেখানকার সিদ্ধান্তের ওপরেই শর্ত শিথিল করা হবে কি না তা চূড়ান্ত হবে।

এর আগে ২০১৬ সালের প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপাতে নতুন করে শর্ত দেয়ায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পাঠ্যবই মুদ্রণকারীদের দ্বন্দ্ব চলছিল গত কয়েকদিন ধরে। এই দ্বন্দ্বে আগামী বছরের পাঠ্যবই ছাপার কাজ বন্ধ হওয়ার জোগার হয়েছিল। পরিস্থিতি এমনই ঘোলাটে হয় যে, ১ জানুয়ারি সরকারের বই উৎসব পণ্ড হওয়ার উপক্রম হয়।

এ সঙ্কট নিরসনে সোমবার দুপুরে মন্ত্রিসভার নির্ধারিত বৈঠক শেষে মতিঝিলে এনসিটিবিতে প্রকাশকদের সঙ্গে আরেকটি বৈঠকে বসেন শিক্ষামন্ত্রী।

দুপুরের বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানায়, প্রকাশকরা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে বিশ্বব্যাংকের শর্তের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, আমরা প্রত্যেকবারই বই ছাপায় ও নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়। কিন্তু এবার বিশ্বব্যাংক যেসব শর্ত দিয়েছে, তাতে আমাদেরকে অপমান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ শর্ত মানলে আমাদের প্রকাশনা শিল্প অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে।

প্রকাশকদের ক্ষোভের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘আমি আপনাদের পাশে রয়েছি। আপনারা পাঠ্যপুস্তকের সঠিক মান নিশ্চিত করেন। সর্বনিম্ন দরদাতারাই বই ছাপাবেন। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করে বই প্রকাশ করলে, আমি সবার বিষয় দেখবো। এ নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসবো ও সমস্যার সমাধান করবো।’

শিক্ষামন্ত্রীর এ আশ্বাসের জবাবে প্রকাশকরা বলেন, ‘আপনি আমাদের অভিভাবক। আপনি যেটা করবেন সেটা আমাদের ভালোর জন্যই করবেন। আপনি বললে, আমরা বিল ছাড়াই পাঠপুস্তক ছাপিয়ে দেবো।’

আগামী শিক্ষাবর্ষ অর্থাৎ ২০১৬ সালে প্রাথমিক স্তরের (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত) পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ পেয়েছে দেশীয় ২২টি প্রতিষ্ঠান। প্রাথমিকের বই ছাপানোর জন্য খরচ হবে ১৯৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে বিশ্বব্যাংক দেবে ৯ শতাংশ, বাকি টাকা দেবে সরকার। কিন্তু এ টাকা দেয়ায় জন্য বেশ কিছু শর্ত বেঁধে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। যার মধ্যে জামানত ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ, কাগজ কেনার পর বিশ্বব্যাংকের কারিগরি শাখায় কাগজের মান ও ফর্মা পরীক্ষা এবং উপজেলা পর্যায়ে যাওয়া বইয়ের মান পরীক্ষার কথা রয়েছে। সেই সঙ্গে বই ছাপানোর কাজের টাকা পরিশোধের বিষয়ে সন্তোষজনক মান পরীক্ষা করারও শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি।

গত ১৭ আগস্ট দেয়া এসব শর্ত আরোপের কারণেই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে গোল বাঁধে মুদ্রণকারীদের। তাদের দাবি, এসব শর্তের কারণে দেশের প্রকাশনা শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। মুদ্রণকারীরা বলেছেন, বিশ্বব্যংকের দেয়া নতুন শর্ত প্রত্যাহার না করলে তারা পাঠ্যবই ছাপার কাজ করবেন না।

এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, শুরু থেকেই প্রাথমিকের সাড়ে ১১ কোটি পাঠ্যবই ছাপানো নিয়ে শুরু হয় জটিলতা। একের পর এক সমস্যার সমাধান করে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এরপর কার্যাদেশ দেয়ার আগ মুহূর্তে এসে মানসম্পন্ন বই ছাপার স্বার্থে বিশ্বব্যাংক বেশকিছু শর্ত জুড়ে দেয়। সেসব শর্ত মানার পরে পাঠ্যপুস্তকের মান যাচাই করে তারপর বিল পরিশোধ করার কথা জানায় বিশ্বব্যাংক।

এ নিয়েই ঘোর আপত্তি মুদ্রণকারীদের। তারা বলেন, প্রতিবছর পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন তারা। বই ছাপার পর যদি বিশ্বব্যাংকের কারিগরি দল মানে সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে ইতোমধ্যে ব্যয় হয়ে যাওয়া অর্থ তাদের কে ফেরত দেবে? তারা আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক সরকারের সফল একটি প্রজেক্টকে বিতর্কিত করতে এখানে অনধিকার চর্চা করছে। বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই