ত্রুটিপূর্ণ পে স্কেল, মন্ত্রীরা আমলাদের দুষছেন

ত্রুটিপূর্ণ পে স্কেল করে সরকারকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট আমলাদের দুষছেন মন্ত্রীরা। গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় পে স্কেল নিয়ে মন্ত্রীরা অসন্তোষ প্রকাশের পর সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট সচিবদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক আলোচনার পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ পে স্কেল নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এত বেতন বাড়ালাম, তার পরও শিক্ষকরা ক্লাস ছেড়ে আন্দোলনে। এই অবস্থায় আমাদের বুঝতে হবে কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’ এ পর্যায়ে কথা বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘নতুন স্কেলে বেতনবৈষম্য দূর করার জন্য মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমি ওই কমিটিতে আছি। একটি বৈঠকও হয়েছে। সেই বৈঠকে সব বিষয়েই আলোচনা হয়েছিল এবং সমাধানের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিলাম। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল আরো একটি বৈঠক

হবে। কিন্তু তার আগেই পে স্কেলের গেজেট জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়।’ কেন তা করা হলো, সে প্রশ্ন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।

এ প্রশ্ন কেবল বাণিজ্যমন্ত্রীই করেননি। মন্ত্রিসভা কমিটির প্রায় সব সদস্যই বিষয়টি তুলেছেন। গত ১ নভেম্বর বেতনবৈষম্য নিরসনসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির একমাত্র বৈঠকটি হয়। এরপর প্রায় সব সেক্টরই আশাবাদী হয়েছিল জটিলতা অবসানের বিষয়ে। আরো একটি বৈঠকের সিদ্ধান্ত থাকলেও তা আর হয়নি। এ অবস্থায় গত ১৪ ডিসেম্বর পে স্কেল জারি করা হয়। তার আগে এ বিষয়ে ভেটিং নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মতবিরোধে জড়ায় অর্থ মন্ত্রণালয়। একমত না হওয়ায় আইনমন্ত্রী পে স্কেলের ফাইল অনুমোদন না করে নিজের কাছে রেখে দেন। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের লাগাতার চাপে শেষ পর্যন্ত ফাইল অনুমোদন করেন তিনি। গতকালের মন্ত্রিসভা বৈঠকে আইনমন্ত্রী বলেন, যেভাবে পে স্কেলের গেজেট করা হয়েছে তার সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের বৈসাদৃশ্য রয়েছে।

একজন সিনিয়র মন্ত্রী এসব ঘটনা জানিয়ে বলেন, ভেটিং হচ্ছে অবলিগেটরি লিগ্যাল কনসালটেশন বা বাধ্যতামূলক আইনগত পরামর্শ। আইন মন্ত্রণালয় যে পরামর্শ দেবে তা মানতে বাধ্য অন্যরা। তাহলে বৈসাদৃশ্য হয় কী করে? নিশ্চয়ই এখানে কেউ প্রভাব খাটিয়েছেন। কোনো কোনো আমলা হয়তো তাঁদের কোটারি স্বার্থে সরকারকে ব্যবহার করছেন। তিনি আরো জানিয়েছেন, মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা সচিবের পদমর্যাদা চান। সচিবরা চাকরি থেকে ৫৯ বছরে অবসরে যান। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও ৫৯ বছরে অবসরে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৬৫ বছর পর্যন্ত চাকরি করেন। সচিবরা পার্টটাইম জব করতে পারেন না, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা করতে পারেন। সচিবদের সমান সুযোগ চাইলে তো তা করা যাবে না। সচিবদের মতো তাঁরা ৯টা ৫টা অফিস করেন না। অধ্যাপকদের বিষয়টি আসলে মর্যাদার। এটাকে টাকা-পয়সা দিয়ে মূল্যায়ন করা ঠিক নয়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মর্যাদা সচিবদের চেয়ে অনেক বেশি। তাঁর সঙ্গে কি কোনো সচিবের তুলনা চলে?

এ পর্যায়ে একজন মন্ত্রী বলেন, অষ্টম পে স্কেলের আরেকটি বড় সমস্যা হলো, প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে যোগদানের স্কেল নির্ধারণ। এ ক্ষেত্রে ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য অষ্টম ও নন-ক্যাডারদের জন্য নবম গ্রেড করা হয়েছে। এ নিয়ে ফরাসউদ্দিন কমিশন বা সচিব কমিটিতে কোনো আলোচনা হয়নি। জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রকৃচি এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নতুন করে এ বৈষম্য কেন হলো, যাঁরা নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, তাঁদেরটাও অষ্টম গ্রেডে হলে সমস্যা কোথায়?

আরেকজন মন্ত্রী বলেন, বেতনবৈষম্য নিরসন সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তার সব বাস্তবায়ন করা হয়নি। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওই কমিটির বৈঠকে যেসব সচিব উপস্থিত ছিলেন, আমি আজই তাঁদের সঙ্গে বসব। কিভাবে এসব সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে পারি, দেখব।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত অষ্টম পে কমিশন প্রতিবেদন দেওয়ার পর থেকেই আন্দোলনে নামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। কারণ কমিশনই টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে। সেই সুপারিশ সমর্থন করে সচিব কমিটি। দীর্ঘ প্রায় আট মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। এর মধ্যেই সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দিয়ে নতুন পে স্কেল কার্যকর করে সরকার। ফলে শিক্ষকরা আন্দোলন তীব্র করেছেন। তাঁদের অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু হবে ১১ জনুয়ারি থেকে। পাশাপাশি চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, ২৬ ক্যাডার, বিভিন্ন ফাংশনাল বডির আন্দোলন চলছে। তাঁরাও ১১ জানুয়ারি থেকে এক সপ্তাহ দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করবেন। সরকারি কলেজ শিক্ষকরাও আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।

অথচ অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলের বেশ কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। আন্দোলনকারীরাও এ বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। আগে সাধারণত সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ বেতন বাড়ত। এবারই প্রথম ৮০ শতাংশ থেকে কোনো কোনো গ্রেডে শতভাগের বেশি বেতন বেড়েছে। আগে প্রতিটি গ্রেডে নির্ধারিত অঙ্কের ইনক্রিমেন্ট নির্ধারিত ছিল। এবারই তার পরিবর্তে ক্রমপুঞ্জীভূতভাবে নির্দিষ্ট হারে ইনক্রিমেন্ট ব্যবস্থা চালু করা হলো। প্রথমবারের মতো পহেলা বৈশাখের ভাতা চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া পিআরএলের মেয়াদ ১৮ মাস হওয়ায় এর সুফল সবাই পাবেন।

পাট আইনের খসড়া অনুমোদন

আগের তিন বছর কারাদণ্ডের সঙ্গে এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান করে পাট আইন প্রণয়নের খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে মন্ত্রিসভা। বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, সামরিক শাসনামলে প্রণীত আইন বা অধ্যাদেশ নতুন করে বাংলায় প্রণয়নে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। আগের পাট অধ্যাদেশটি অনুসরণ করেই নতুন আইনের খসড়া করা হয়েছে। পাট ও পাটজাত পণ্য উত্পাদন, গবেষণা, পাটজাত পণ্য ব্যবসায় সরকারের ক্ষমতা, লাইসেন্স দেওয়া, উন্নয়ন ফি আরোপ, উন্নয়ন তহবিল গঠন, পাটখড়ি থেকে পণ্য উত্পাদন, বিক্রয়, নিষিদ্ধকরণের ক্ষমতা, হিসাব বই আটকের ক্ষমতা দেওয়া ছাড়াও আইনের ধারা লঙ্ঘন করলে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আগের অধ্যাদেশে আইন লঙ্ঘন করলে তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও কত টাকা জরিমানা করা যাবে, তা ঠিক ছিল না।

মন্ত্রিসভা বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিমান চলাচল বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদের সচিব বলেন, দুই দেশের মধ্যে কোনো চুক্তি করতে হলে আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিতে হয়। এর মাধ্যমে উভয় দেশ যেকোনো বিমান সংস্থাকে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য মনোনয়ন দিতে পারবে।

যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য এখন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির দরকার হয়, যা আগে ছিল না। মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়ায় এখন দুই দেশের মধ্যে নতুন করে চুক্তি হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার ট্রাফিকের বিধিবিধানের আলোকেই এ চুক্তিপত্র হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লাইট পরিচালনায় আগে যেসব বিধিনিষেধ ছিল, এই চুক্তিপত্রের ফলে তার সব বাতিল হয়ে যাবে।



মন্তব্য চালু নেই