আজকের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সঙ্গে নববর্ষ উৎসবের কোনো মিলই নেই

সৈয়দ আবুল মকসুদ একজন সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। ১৪১৩ সালে একটি দৈনিক পত্রিকার ১ বৈশাখের ক্রোড়পত্রে তার ছাপা হওয়া একটি লেখার অংশ উদ্ধৃত করছি।

‘আমি আমার নিজের শৈশব ও কৈশোরের পহেলা বৈশাখকে যেভাবে দেখেছি, আজকের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সঙ্গে সেই নববর্ষ উৎসবের কোনো মিলই নেই। তখনকার নববর্ষের উৎসবের মধ্যে ছিল অকৃত্রিম প্রাণের আমেজ, তাতে ন্যূনতম কৃত্রিমতা ছিল না, আয়োজনে বিন্দুমাত্র মেকি বা লোক দেখানো বিষয় ছিল না। যা করা হত, তা হতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে, প্রাণের আনন্দে ও অকৃত্রিম জাতীয়তাবাদী আবেগে।

আজ আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? পহেলা বৈশাখের সকালে ঘটা করে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে খুব বিত্তবান ঘরের মানুষ মাটির শানকিতে পান্তাভাত, খাট্টা ডাল, ইলিশ মাছের ঝোল, মুড়িঘণ্ট, খেজুর গুড়ের ক্ষীর হাপুস-হুপুস করে খাচ্ছে। এই যে রেওয়াজ শুরু হয়েছে, এটি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর প্রবর্তিত আয়োজন। এ জাতীয় জিনিস পহেলা বৈশাখে নববর্ষের চিরকালের চেতনা বিরোধী। কারণ এ সমাজের পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ খুবই দরিদ্র, তারা ক্ষুধার জ্বালায় পান্তাভাত, পঁচাডাল ও অখাদ্য জাতীয় জিনিস যা পায় প্রতিদিন তা-ই খায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে পান্তাভাত আর ইলিশের তরকারি, মুড়িঘণ্ট যারা খায়, তারা বস্ত্তত এক ধরনের সাংস্কৃতিক অপরাধ করে। এসব আচরণের মাধ্যমে তারা আসলে দেশের অগণিত দরিদ্র মানুষকে পরিহাস করে।’

পহেলা বৈশাখের বর্তমান রেওয়াজ ও মাতামাতি সম্পর্কে এ কথাগুলো কোনো মাওলানা সাহেবের বলা নয়। কথাগুলো যিনি লিখেছেন, তিনি কথিত বাঙ্গালি সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম মনে করেন। তারপরও সত্য স্বীকার করে তিনি কথাগুলো লিখতে বাধ্য হয়েছেন।

বর্তমান বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আয়োজিত নানাবিধ আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে চলুন শুনি কি বলছেন বাংলাদেশের আরেকজন গুণী কবি, সংস্কৃতিবিদ। কবি আবদুল হাই শিকদার তার এক বক্তৃতায় বলেন, আজ যে পহেলা বৈশাখ নিয়ে এতো সব আয়োজন, এতো উৎসব করা হচ্ছে কই বাংলা সনের যিনি আবিস্কারক-জনক সেই ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে তো কেউ স্মরণ করেন না। তার এই আবিস্কারের ধন্যবাদ প্রদানমূলক কোনো সভার তো আয়োজন করা হয় না। যেই মানুষটি না হলে বাংলা সনের জন্ম হতো না তার নাম কেউ নেয় না কিন্তু বাংলা সনের দরদে সারাদিন উৎসবে কাটে। উৎসব হয়, উৎসব হোক আমি উৎসবের পক্ষে- উৎসবের মাঝে দোষের কিছু নেই কিন্তু দোষ হয় তখন যখন আমার শালীনতা, আমার সুস্থতা, আমার দেশপ্রেম এবং আমার সার্বভোমত্বকে আঘাত করে এই সব উৎসব-আয়োজন। গণেশ হিন্দুদের দেবতা।

একটি জাতির দেবতা হিসেবে গণেশের প্রতি আমার সম্মান রয়েছে, আমি সম্মান করি হিন্দু ভাই-বোনদেরকেও কিন্তু আমি একজন মুসলামান হয়ে পহেলা বৈশাখে আমার কাধে গণেশ নিয়ে কীভাবে দৌড়াই- এটা কি আমাকে মানায়? এইটা কি শোভন হয়? বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল, ভারতের জাতীয় পাখি ময়ূর। পাখি হিসেবে ময়ূর নিস্পাপ। ময়ূর আমরাও প্রিয় একটি পাখি কিন্তু কথা হলো- পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভা যাত্রায় ময়ূর পাখির মিশিল হয় আমার দোয়েল গেল কই? পহেলা বৈশাখে আমার কাধে গণেশ উঠলো কিন্তু আমার ফতেহ উল্লাহ সিরাজী কোথায় গেল, কোথায় গেল আমাদের মীর মোশাররফ হোসেন, ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ?

মাওলানা মিরাজ রহমান
[email protected]



মন্তব্য চালু নেই