জল্পনা- জটিলতায় প্রাণচাঞ্চল্য
বিএনপিতে ফিরছেন অলি- বি.চৌধুরী!
ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে দলকে নতুন প্রাণ দেয়ার চেষ্টা করছেন নেতারা। নতুন এই প্রক্রিয়াকেই এ মুহূর্তে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে এগুচ্ছে বিএনপি।
জানা গেছে, এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দলত্যাগী বা বহিষ্কৃত নেতা ও সংগঠকদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছেন খোদ বিএনপি চেয়ারপারস বেগম খালেদা জিয়া। বিশেষ করে দলের প্রতিষ্ঠালগ্নের যেসব সংগঠক রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে দল ছেড়েছেন, নতুন দল গঠন করেছেন তাদের ফিরিয়ে এনে দলকে চাঙা করতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য ড. অলি আহমেদসহ অনেককে শিগগিরই বিএনপিতে ফেরানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
যদিও রমজান মাসের শুরু থেকেই এ নিয়ে গুঞ্জন চলছিল। তবে গুঞ্জনকে এবার অনেকটা সত্য বলেই স্বীকার করলেন বিএনপির একটি সূত্র। সব ঠিকঠাক থাকলে সেপ্টেম্বরেই ডা. বি চৌধুরী ও অলি আহমেদ নিজেদের দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে ফিরতে পারেন।
এদিকে বিএনপিতে এ দুই নেতার প্রত্যাবর্তনের খবরে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। চলছে নানা হিসাব-নিকাশও।
২০০২ সালের ২১ জুন দলের অন্য নেতাদের চাপে বি চৌধুরী রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বি. চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে ২০০২ সালের ৩০ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সমাধিতে না গিয়ে তার প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানোর অভিযোগ তোলা হয়। এ নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যেও চরম ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
এর জেরেই ছেলে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য মাহি বি চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে দল থেকে বেরিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল বিকল্প ধারা গঠন করেন বি. চৌধুরী। সেই সময় বিএনপির অনেক নেতা বি. চৌধুরী ও তার ছেলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনেন। সংসদে তার বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাবেরও পরিকল্পনা চলে। নিজ দলের মধ্যে বিরাজমান ক্ষোভ ও ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন এবং পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।
পরবর্তীকালে মুন্সীগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচিত মাহি বি চৌধুরী ও বিএনপির আরেকজন এমপি মেজর (অব.) মান্নান সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৪ সালের মার্চে বি. চৌধুরীর উদ্যোগে তারা সমন্বিতভাবে বিকল্প ধারা বাংলাদেশ গঠন করেন। বি চৌধুরী দলের সভাপতি ও এমএ মান্নান মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উপ-নির্বাচনে দলটি মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে জয় লাভ করে।
ড. অলি আহমেদ বর্তমানে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির সভাপতি। জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করলে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি যোগাযোগমন্ত্রী হন। বঙ্গবন্ধু সেতুর কাজ (যমুনা সেতু) তার সময়েই শুরু হয়।
দীর্ঘকাল বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত থাকার পর ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি গঠন করেন। এক পর্যায়ে এলডিপি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে একত্রে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। পরে মতবিরোধের জেরে বি চৌধুরী আবার বিকল্প ধারার হাল ধরেন। আর অলি আহমেদ এলডিপিতেই থেকে যান।
এই দুই নেতার বিএনপিতে ফেরার গুঞ্জনে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেউ মনে করছেন, বি চৌধুরী, অলি আহমেদ পার্টির পুরনো ও জ্যেষ্ঠ নেতা। তারা দলে ফিরলে দলের ইমেজ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এই দুই নেতা দলে কোন পদে আসীন হবেন? এ নিয়ে জটিলতা দেখা দেবে বলে অনেকে মনে করছেন।
সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করছেন, বিএনপিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে এই দুই নেতা বিএনপি ছেড়ে গিয়েছিলেন। তারা চলে যাওয়ার পর দলের দুর্দিনে অনেকে নানাভাবে দলের হাল ধরেছেন। এখন যদি বি চৌধুরী-অলি আহমেদরা দলে ভিড়েন তবে ত্যাগী অন্য নেতারা সঠিকভাবে মূল্যায়িত হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দেবে।
জানা গেছে, এই দুই নেতা বিএনপির অন্যতম মিত্র জামায়াতের ঘোর বিরোধী। তাহলে কি বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে তাদের কাছে ডাকছেন কি না- এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে অনেকের মনে। আবার কারো কারো প্রশ্ন- বি চৌধুরী এবং অলি আহমেদ এর আগে যেসব অভিযোগ তুলেছেন সেসব কি মেনে নিচ্ছেন খালেদা জিয়া? নাকি তারাই রাজনীতিতে পাকাপোক্ত অবস্থান করতে ভুল স্বীকার করছেন?
কারো কারো ধারণা, খালেদা জিয়া তারেক রহমানকে মাইনাস করে বি চৌধুরীসহ সিনিয়র কিছু নেতা নিয়ে নতুন ধাঁচের বিএনপি গড়তে চাচ্ছেন।
চলতি বছর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩৪তম শাহাদাত বার্ষিকীর আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করা হয় বিকল্প ধারার সভাপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে। সে সময় বি চৌধুরী তার বক্তব্যে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি তখন অভিযোগ করেন, বিএনপি জিয়ার আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এ বক্তব্যে তখন বিএনপিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
অনেকে তার এ বক্তব্য সমর্থন করলেও কেউ কেউ আপত্তি তুলছেন। তারা বলছেন, খালেদা জিয়া-তারেক রহমান কি তাহলে জিয়ার আদর্শ থেকে বিচ্যুত?
শোনা যাচ্ছে, আগামী ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বি চৌধুরী এবং অলি আহমেদকে বিএনপির ব্যানারে দেখা যাবে।
তবে এ বিষয়ে অলি আহমেদ বলেছেন, ‘বিএনপিতে যাওয়া নিয়ে কারো সঙ্গে আমার আলোচনা হয়নি।’ এলডিপি বিলুপ্ত করে বিএনপিতে ফেরার প্রস্তাব পেলে পুরাতন দলে ফিরবেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের অনুমান নির্ভর কোনো বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না।’
অন্যদিকে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের সদস্য আ স ম হান্নান শাহ বলেন, ‘বিভিন্ন সময় দলের যেসব নেতা বিএনপি ছেড়ে চলে গেছেন, তাদের সবাইকেই স্বাগত জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। তিনি প্রত্যেককে সব বিভেদ ভুলে আবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন। বিশেষ করে বি. চৌধুরী এবং অলি আহমেদের মতো নেতাকে দলে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটিও বিএনপি চেয়ারপারসনেরই। এজন্য তিনি দলের কয়েকজন খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীকে দায়িত্বও দিয়েছেন। তারাই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।’
বি চৌধুরী এবং অলি আহমেদের দলে ফেরার ব্যাপারে বিএনপির অন্যতম পরামর্শক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চাইলে অসুস্থতার কারণে কিছু বলতে চাননি তিনি।
এ নিয়ে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্য জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। আমার জানা নেই। এটা আলোচনার ব্যাপার। পুরাতন সিনিয়ররা যদি ফিরে আসে, দল যদি বড় হয় তা ইতিবাচক।’ তারা দলে ফিরলে কোন পর্যায়ের পদ পেতে পারেন এমন প্রশ্নে মাহাবুবর রহমান বলেন, ‘আমি জানি না।’
তবে বি চৌধুরী ও অলিকে দলে ফেরানোর ঘোর বিরোধিতা করছেন বিএনপির সাবেক সহ.প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মহিউদ্দিন খান মোহন। তার মতে, এটা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে মাইনাস করার একটা ষড়যন্ত্র। রাজনীতিতে বি চৌধুরী এবং অলি আহমেদের কোনো প্লাটফর্ম নেই। সুতরাং তাদের নিয়ে বিএনপির কোনো লাভ হবে না।
তার অভিযোগ, বি চৌধুরী, অলি আহমেদরা চাচ্ছেন আদালতে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে দোষী সাব্যস্ত হোন। তাহলে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাদের বের করে দেয়া যাবে। এতে করে বি চৌধুরীর দলীয় প্রধান হওয়ার পথ প্রশস্ত হবে।
মন্তব্য চালু নেই