সর্বস্বান্ত শত শত মানুষ : ভয়ে যার নামও মুখে নিতে সাহস পেতেন না অনেকে

সেই জ্বীনের বাদশা শাহ আলমের গলাকাটা লাশ উদ্ধার

জ্বীনের বাদশা খ্যাত সেই শাহ আলমের লাশ মিলেছে তার গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুরের নৈকাঠিতে। কে বা কারা গলা কেটে তাকে হত্যা করে লাশটি বাড়ির অদূরে ফেলে রেখে গেছে। পারিবারিক সূত্র বলেছে, ঢাকার বাসা থেকে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেয়ার পরে গতকাল ভোরে তার লাশটি পাওয়া যায়। এ দিকে লাশ উদ্ধারের খবর শুনে তার হাতে নির্যাতিত ও প্রতারিত শত শত মানুষ তার লাশ দেখার জন্য জড়ো হন ঘটনাস্থলে।

ভুক্তভোগীরা বলেছেন, এই শাহ আলমের খপ্পরে পড়ে শত শত পরিবার আজ সর্বস্বান্ত। অনেকে হয়েছেন পথের ভিখারি। অপর দিকে, জ্বীনের বাদশা শাহ আলম রাজধানীতে বহুতল ভবন, একাধিক ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান, গ্রামের বাড়িতে বহুতল ভবন, ইটের ভাটা, ছাগলের খামার ও পরিবহন ব্যবসাসহ নানা ব্যবসা পেতে বসেছিলেন। বেশ কয়েকটি হত্যারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বাবু মোল্লা হত্যায় নিম্ন আদালতে তার ফাঁসির দণ্ড হলেও তিনি উচ্চ আদালতে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। আরো দু’টি হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলা বিচারাধীন।

ঝালকাঠির রাজাপুরের নৈকাঠিতে বাড়ি জ্বীনের বাদশা শাহ আলমের। বাবার নাম ওয়াজেব আলী খান। অশিক্ষিত এই শাহ আলম ছোটবেলায় ছিলেন একজন সিদ্ধ চোর। সর্বশেষ ছাগল চুরি করে শাহ আলম এলাকার মেম্বরের পিটুনি খেয়ে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। অভিযোগ রয়েছে ঢাকায় এসেই তিনি প্রতারণা শুরু করেন। সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এভাবে চালিয়ে আসছিলেন প্রতারণা। জ্বীন দিয়ে মানুষের সর্ব সমস্যার সমাধানের ভাওতাবাজি দিয়ে তার প্রতারণা শুরু। তার প্রতারণার বিরোধিতা করে নিজ দলের সদস্যরাও রেহাই পাননি।

তাদেরও ডেকে এনে নানা কৌশলে হত্যা করেছেন এই শাহ আলম। জীবনে অসংখ্যবার গ্রেফতার হয়েছেন। জেল খেটেছেন টানা চার-পাঁচ বছরেরও বেশি। প্রতিবার জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি আবারো নতুন করে প্রতারণা শুরু করেন। জ্বীনের মাধ্যমে মানুষের ভাগ্য বদল করার কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। সর্বশেষ গত বছর বংশালের ওসমান গনি রোডের ঢাকা হোটেল থেকে র‌্যাব ২-এর সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তার বিরুদ্ধে বাবু মোল্লা হত্যা, মিঠু হত্যা, বাদল হত্যা ও মনসুর হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরেও নৈকাঠি গ্রামের সুরেন সুতার হত্যার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ আছে সুরেন সুতারকে হত্যার পরে তার ছেলেদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ভারতে পাঠিয়ে তাদের প্রায় ১০ বিঘা সম্পত্তি দখল করে নেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, সুরেনকে হত্যার পর তার বাড়িতেই মাটি চাপা দেয়া হয় মৃত দেহটি। ওই বাড়িতেই এখন শাহ আলম গড়ে তুলেছেন নিজের থাকার জন্য তিন তলা বাড়ি, দ্বিতল ছাগলের ও হাঁস-মুরগির খামার। রাজধানীর বনশ্রীর সি ব্লকের ১ নম্বর রোডে তার রয়েছে সাত তলা একটি বাড়ি। নৈকাঠিতে রয়েছে ইটের ভাটা ও গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রির ব্যবসা। গাজীপুরে রয়েছে শতাধিক অটোরিকশাসহ পরিবহন ব্যবসা। প্রতারণা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে তার রয়েছে বিশাল বাহিনী। রাজাপুরের শুক্তাগড় ইউনিয়ন পরিষদের একবার চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন এই শাহ আলম।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে রাজধানীর মিরপুরের ১১ নম্বর সেকশনে এক বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে ছয় সন্ত্রাসী। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২১ রাউন্ডগুলিসহ হ্যান্ডকাপ ও নানা সরঞ্জাম। গ্রেফতারকৃতরা পরে আলমের নাম বলে দেয়। গত বছর রাজধানীর কোতয়ালি এলাকায় অপহরণ করা হয় কালাম নামের এক ব্যক্তিকে। ওই ঘটনায় কোতয়ালি থানায় মামলা দায়েরের পর ডিবি মামলায় আলমসহ কয়েকজনের নামে চার্জশিট প্রদান করে। কিন্তু পরে কালামকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই মামলায় আপসরফা করা হয়। পরে এই কালামকে আরো কয়েক দফায় অপহরণ করে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। তারই এলাকার এক ব্যক্তিকে মিষ্টির প্যাকেটে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার অভিযোগসহ অসংখ্য মানুষকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

ভুক্তভোগীরা জানান, আলমের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের হলেও সাক্ষীরা ভয়ে আদালতে যেতেন না। পুলিশ ও র‌্যাব সূত্র জানায়, কখনো জ্বীনের বাদশা, আবার কখনো অন্ধ সেজে প্রতারণার মাধ্যমে নিরীহ মানুষের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়েছেন এই শাহ আলম। সর্বশেষ রেকর্ড অনুযায়ী শাহ আলমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় চারটি হত্যাসহ ১১টি মামলা রয়েছে।

সর্বশেষ গত বছর শাহ আলম নিজের কাছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কয়েক কোটি টাকার দুর্লভ ধাতব মুদ্রা রয়েছে দাবি করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেন। এই মুদ্রা বিক্রির কথা বলে তিনি রাজধানীর সৌখিন ধনী লোকদের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়ে বলেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের নাসা কর্তৃক পরীক্ষিত দুর্লভ ধাতব মুদ্রা। এটি বিক্রি করতে নিজেকে তিনি একজন সৌখিন অভিজাত লোক হিসেবে পরিচিত করানোর জন্য মুদ্রা ক্রয়ে আগ্রহী ক্রেতাদের নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন ফাইভ স্টার হোটেলে বসতেন। একপর্যায়ে মুদ্রাটি তিনি প্রায় ৩ কোটি টাকা মূল্যে ঢাকা সিটি কলেজের এক শিক্ষকের কাছে বিক্রিও করেন। পরে শিক্ষক প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারলেও ততক্ষণে পালিয়ে যান প্রতারক শাহ আলম।

গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডির একটি হাসপাতালের এক ডাক্তারের কাছ থেকে তার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছেলেকে সুস্থ করার কথা বলে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন শাহ আলম। এ সময় তিনি নিজেকে জ্বীনের বাদশা পরিচয় দেন। তিনি জীনের মাধ্যমে সোনার গয়না কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেন বলে অনেক গৃহবধূর সাথে প্রতারণা করে তাদের স্বর্বস্বান্ত করেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এরূপ হাজার হাজার অভিযোগ আছে শাহ আলমের বিরুদ্ধে। প্রতারণা করতে গিয়ে যখনই যাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হতো তখনই তাকে শায়েস্তা করতেন নানা কৌশলে। এলাকার সবাই তাকে ভয় করতেন যমের মতো। অনেকে তার কর্মকাণ্ডকে এরশাদ শিকদারের সঙ্গেও তুলনা করতেন। এলাকায় তার প্রতিপক্ষ বলে পরিচিত ছিলেন এমন অনেক মানুষ বছরের পর বছর নিখোঁজ রয়েছেন।

আমাদের ঝালকাঠি সংবাদদাতা জানিয়েছেন, সেই শাহ আলমের লাশ মিলেছে গতকাল তার গ্রামের বাড়ি নৈকাঠিতে। তার ভাই মাহবুবুর রহমান মেম্বর সাংবাদিকদের বলেন, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তার রামপুরার বনশ্রীর বাসার সামনে থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাকে অপহরণ করা হয়। তারা এ ব্যাপারে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও দায়ের করেন। রাজাপুর থানার ওসি শেখ মনিরুল গিয়াস সাংবাদিকদের বলেছেন, সকালে খবর পেয়ে শাহ আলমের লাশটি উদ্ধার করা হয়। তার বাড়ির পাশেই গলাকাটা অবস্থায় লাশটি পাওয়া যায়। ঘটনাটি এখনো ক্লুলেস বলে ওসি উল্লেখ করেন।



মন্তব্য চালু নেই