দীর্ঘ ৩৭ বছর পর হারানো মাকে বাংলাদেশে খুঁজে পেল যুক্তরাষ্ট্রের জামিনা
দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যায়। দিন যায়, যায় মাস, বছর ঘুরে কখন যেন কেটে যায় ৩৭টি পার্বণ। এক অজপাড়াগাঁয়ে দুঃখিনী মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করা জামিলার নাম পরিবর্তন হয়, তিনি হয়ে যান এস্থার জামিনা জডিং। পরিবর্তিত হয়েছে মা-বাবা। বদলে গেছে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি। কিন্তু বদলায় না মাটির প্রতি মমতা। গর্ভধারিণী মায়ের প্রতি টান।
গর্ভধারিণী মা ও নিজের দেশকে দেখার জন্য তার সংগ্রামও কম করতে হয়নি। অবশেষে ব্যাকুল এস্থার জামিনা জডিং সাধ পূরণ হলো। আর তাই তো ৩৭ বছর পর মা-মেয়ের দেখা হলো। ভাষার ব্যবধান হার মানলো মাতৃত্বের কাছে। এ যেন অন্য আনন্দ, অন্য অনুভূতি। হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে কাছে পেয়ে বৃদ্ধারও যেন আর থামছে না। ‘মা আমার মা কলিজার টুকরা। অভাবের তাড়নায় আমার বুক থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল। তোমার সন্ধানে দাকোপ ও মংলার আশপাশে হন্যে হয়ে খুঁজেছি। তোমার বাপ বলেছে, মেয়েটিকে চোরে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমি আল্লাহর কাছে বারবার বলেছি যেথায় থাক না কেন আমার বুকের ধন যেন বেঁচে থাকে। শুনেছি গরীবের কথা আল্লাহ তায়ালা ফেলে না। দেখছি তাই হলো, তুমি বেঁচে আছো।’ ঘটনাস্থলে উপস্থিত অনেকেই নীরবে দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরেছে।
মায়ের কান্নায় নিজেকেও স্বাভাবিক রাখতে পারেনি আমেরিকা প্রবাসী এস্থার জামিনা জডিং। বাংলায় কথা বলতে না পারলেও মা মা বলে বারবার চিৎকার করে হারানো মাকে কাছে পেয়ে বুকে চেপে ধরে রেখেছিল।
মাকে ফিরে পাওয়ার জন্য গত দুই বছর যাবত তার চেষ্টা ছিল বিরামহীন। এ ধরনের ঘটনার অবতারণা হয় রোববার খুলনা মহানগরীর ৬৮/৪ ভৈরব স্ট্যান্ড রোডস্থ আবু শরীফ হুসেন আহমেদের বাসায়।
১৯৭৭ সালের জুন মাসে খুলনার দাকোপ উপজেলার গুনারী গ্রামের নূরজাহান বেগম ও মোহন গাজী দম্পতির পঞ্চম সন্তান জামিলা জন্ম গ্রহণ করেন। তারা থাকতেন চালনায়। অভাবের সংসার। শারীরিকভাবে অসুস্থ মোহন গাজী মেয়েটিকে কাউকে দত্তক হিসেবে দিতে চাইলেন। জামিলার জন্মের পাঁচ দিন পর চালনায় ইট ভাঙার কাজ করতে যান নূরজাহান বেগম। বাড়িতে ফিরে এসে তিনি আর মেয়েকে পাননি।
স্বামী তাকে জানান, মেয়েকে বারান্দা থেকে কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। মোহন গাজী স্ত্রীর কাছে মিথ্যা বলেন। আসলে তিনি মেয়েকে খুলনার এজি মিশনে নিয়ে ৫০০ টাকায় বিক্রি করে দেন। এর প্রায় আট মাস পর মেরি ও পেট দম্পতি এজি মিশনে আসেন। তারা জামিলাকে দত্তক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে যান। ওই পরিবারে জামিলা নাম হয় এস্থার জামিনা জডিং। বর্তমানে জামিনা জডিংয়ের তিন ছেলে। স্বামী ল্যান্স জডিং। পেশায় একজন কেমিস্ট।
২০১৩ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে জামিনা জডিংয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশী নওরীন ছায়রার। সেই সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগের আরেক মাধ্যম ফেসবুকে নওরীন ছায়রার ছোট বোন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শিক্ষিকা নাহিদ ব্রাউনের সঙ্গে পরিচয় হয় জামিনা জডিংয়ের। এরপর শুরু হয় শিকড়ের সন্ধান।
জামিলার সেই সময়ের বাংলাদেশী পাসপোর্টের সূত্র ধরে তারা নিশ্চিত হন তার বাড়ি খুলনার কোন এক গ্রামে। নাহিদ তার ফুফাতো ভাই খুলনায় কর্মরত আবু শরীফ হুসেন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি (শরীফ) প্রায় এক বছর চেষ্টা করে জামিনা জডিংয়ের মা নূরজাহানের সন্ধান পান মংলায়। শরীফ হুসেন আহমেদের মাধ্যমে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নূরজাহান বেগমের নমুনা পাঠান আমেরিকায়। গত বছরের জানুয়ারি মাসে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে জামিনা জডিংয়ের নিশ্চিত হন নূরজাহান বেগমই তার মা।
গত শনিবার ২৭ জুন নাহিদ ব্রাউনের সঙ্গে আমেরিকা থেকে খুলনায় আসেন জামিনা জডিং। রোববার সকালে দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান হয় আবু শরীফ হুসেন আহমেদের বাসায় দেখা হয় মা-মেয়ের দেখার মাধ্যমে। সকাল ৯টার পরে জামিনা জডিং তার মাকে নিয়ে প্রাইভেট কারে করে যান মংলায়। সেখানে সারা দিন মা, তিন বোন ও ভ্যানচালক ভাই আবদুস সাত্তারের সঙ্গে সময় কাটান। সন্ধ্যায় তিনি খুলনায় ফিরে আসেন।
মঙ্গলবার ঢাকায় যাবেন। বুধবারে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাবার কথা রয়েছে।
এস্থার জামিনা জডিং বলেন, ‘আমি ভীষণ খুশি। মাকে দেখার অপেক্ষা আর সইছিল না। বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। ‘দুই বছর চেষ্টার পর মা-মেয়ের মিলন ঘটাতে পেরেছি। দীর্ঘ ৩৭ বছর পর ও শিকড়ের সন্ধান পেয়েছি। সন্তান হিসেবে মায়ের প্রতি যে দায়িত্ববোধ থাকা উচিত তাই আমি করবো। শুনেছি, আমার পাঁচদিন বয়সের সময় বাবা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। আর (১৯৭৮ সালে) সাত মাস পরেই আরেক মা-বাবার সঙ্গে দেশ ছেড়েছি। আজ আমার মাকে পাওয়ার অপেক্ষাটাই ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। মাকে পাওয়ার আনন্দটা শেয়ার করার জন্য শিগগিরই আমার স্বামী-সন্তানদের নিয়ে মংলায় আসবো।
নূরজাহান বেগম বলেন, ‘সব সময় মনে হতো আমার মেয়ে বেঁচে আছে। ওর আসার খবর শোনার পর ঠিকমতো খেতে পারিনি। রাতে ঘুমাতে পারিনি। কখন আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে। আজ যেন আকাশের চাঁদ আমি হাতে পেয়েছি। নূরজাহান বেগম বলেন, দেশে থাকা তিন মেয়ে ও ভ্যানচালক একমাত্র ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি নদীতে রেনু পোনা ধরে বিক্রি করি আর ছেলের ভ্যান চালানোর টাকা দিয়ে আমাদের সংসার চলে।
মন্তব্য চালু নেই