পাড়ার মাঠ থেকে উঠে আসা তিন ক্রিকেটার
মুস্তাফিজুর রহমান, সৌম্য সরকার ও সাব্বির রহমান। আজকে যাঁরা ক্রিকেট বিশ্ব কাঁপাচ্ছেন, একদিন তাঁরাও খেলেছেন পাড়ার মাঠে। কেমন ছিল তাঁদের সেই জীবন? তাঁদের ক্রিকেট জীবনের শুরুর গুরুরাই বা কারা?
মুস্তাফিজুর রহমান যখন দুর্বোধ্য স্লোয়ার বা কাটার দিয়ে টপাটপ ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের উইকেট তুলে নিচ্ছিলেন তখন কী করছিলেন মুফাচ্ছিনুল ইসলাম ও আলতাফ হোসেন? কিংবা সাব্বির রহমান যখন ভারতীয় বোলারদের বাউন্ডারির ওপারে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন নির্বিকার ভঙ্গিতে, কী করছিলেন আবদুর রশিদ?
হয়তো কেউ বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। কেউবা স্বভাবসুলভ রাশভারী চেহারায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সাবেক শিষ্যের কীর্তি দেখছিলেন। যেভাবেই দেখুন না কেন, হৃদয়ে যে আনন্দের প্লাবন বয়ে যাচ্ছিল, বলার অপেক্ষা রাখে না। এই মুফাচ্ছিনুল ইসলাম, আলতাফ হোসেন কিংবা আবদুর রশিদ কে? তিনজনই কোচ। দুজন জড়িয়ে আছেন মুস্তাফিজ ও সৌম্যের সঙ্গে, আরেকজন সাব্বিরের।
দুই ‘দেশি’র একই গুরু
ভারত-সিরিজে একের পর এক কীর্তি গড়ে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন মুস্তাফিজ। ১৩ উইকেট নিয়ে হয়েছেন সিরিজসেরা। অন্যদিকে এ সিরিজে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ১২৮ রান করেছেন সৌম্য। দুজনই উঠে এসেছেন সাতক্ষীরা থেকে। এ কারণে নাকি একে অপরকে ডাকেন ‘দেশি’ বলে! দুজনের গুরু আবার এক। মুস্তাফিজ ও সৌম্য দুজনের শুরু আলতাফ হোসেনের কাছে।
বছর তিনেক আগের কথা। সাতক্ষীরা অনূর্ধ্ব–১৪ দলের বাছাইয়ের আগে জেলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাহী সদস্য আলতাফ গিয়েছিলেন মুস্তাফিজের গ্রামে। দেখেন মাঠে টেনিস বলে দারুণ খেলছেন মুস্তাফিজ। তিনি তখন মুস্তাফিজকে বাছাইপর্বে অংশ নিতে সাতক্ষীরায় আসতে বলেন।
তবে মুস্তাফিজের আসল ধাপটা শুরু হয় মুফাচ্ছিনুল ইসলামের হাতে। বিসিবির এই সাতক্ষীরা জেলা সহকারী কোচ মুস্তাফিজের মতো প্রতিভা খুঁজে বের করায় কৃতজ্ঞতা জানালেন আলতাফকে। দুজন অবশ্য কাজ করেন একই সঙ্গে। মুস্তাফিজ কীভাবে দারুণ বোলার হয়ে উঠলেন, ২৪ জুন সকালে মুফাচ্ছিনুল মুঠোফোনে সে গল্প শোনালেন এভাবে, ‘ওর শুরুতে ব্যাটিংয়ে ঝোঁক ছিল। তবে তার বোলিং দেখে বেশ ভালো লাগল। বললাম, তুমি বল করো। ভালো করবে। এরপর ওকে নিয়ে আলাদা কাজ করতাম। যেটা বলতাম, সেটাই ঠিকঠাক করত।’ মুফাচ্ছিনুলের নিজের একাডেমি ‘সাতক্ষীরা ক্রিকেট একাডেমি’তে দীর্ঘ দিন অনুশীলন করেছেন মুস্তাফিজ। আয়ত্ত করেছেন ভয়ংকর সব স্লোয়ার-কাটার। এ ডেলিভারিগুলো কীভাবে শিখলেন মুস্তাফিজ? মুফাচ্ছিনুল বললেন, ‘কিছু কিছু জিনিস সে জন্মগতভাবেই পেয়েছে। ছোট বেলা থেকেই বল সামনাসামনি করত। আমরা উৎসাহিত করতাম। ও যখন এ ধরনের বোলিং প্র্যাকটিস করত, নিষেধ করতাম না। স্বাধীনভাবে বোলিংয়ের সুযোগ দিতাম।’
সৌম্যকেও আবিষ্কার করেছিলেন আলতাফ। সৌম্যের বড় ভাই পুষ্পেন সরকার তখন খেলতেন স্থানীয় গণমুখী ক্লাবে। পুষ্পেনের হাত ধরেই ওই ক্লাবে সৌম্যের যাতায়াত। ক্লাবের কর্মকর্তা আলতাফ বললেন, ‘ওই সময় সে তার ভাইয়ের সঙ্গে মাঠে আসত। অনুশীলন করত। দেখতাম তার খেলার স্টাইল অন্যদের চেয়ে আলাদা।’ এরপর কিছুদিন অনুশীলন করেছেন মুফাচ্ছিনুলের একাডেমিতে। অবশ্য সৌম্য বেশি দিন সাতক্ষীরায় থাকেননি। কেননা, এরপরই সুযোগ পেয়ে গেলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপিতে।
এখন একই সঙ্গে দুজন সাবেক ছাত্র খেলছেন জাতীয় দলে। এটা ভাবতেই পারেননি আলতাফ, ‘প্রথম দেখায় ভেবেছিলাম, এদের নিয়ে একটু কাজ করতে পারলে জাতীয় দলে না হলেও অন্তত ভালো জায়গায় খেলবে। কিন্তু দুজনই রীতিমতো চমকে দিয়ে জাতীয় দলে দারুণ খেলছে।’
সাতক্ষীরা থেকে প্রায় একই সময়ে দুজন অসাধারণ প্রতিভা উঠে আসার পেছনে জেলার বর্তমান ক্রিকেট কাঠামোর ভূমিকাও দেখছেন আলতাফ ও মুফাচ্ছিনুল। জেলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাহী সদস্য আলতাফ বললেন, ‘এ মুহূর্তে সাতক্ষীরার ক্রিকেট অবকাঠামোটা বেশ ভালো। আমরা সারা বছরই কাজ করি বয়সভিত্তিক ক্রিকেটারদের নিয়ে। টাকা-পয়সার জন্য কাজ করি না। প্রতিভাবানদের তুলে নিয়ে আসাটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।’
মুফাচ্ছিনুল অবশ্য জানালেন খেলোয়াড় বাছাইয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখাও আরেকটা কারণ, ‘বয়সভিত্তিক খেলোয়াড় বাছাইয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়। কেবল শহরের খেলোয়াড়দের সুযোগ দেওয়া হয়, তা নয়। শহর-গ্রাম যেখান থেকে আসুক না কেন, আমরা প্রতিভাকে গুরুত্ব দিই। সবাইকে সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা করি। সারা বছর ছেলেদের খেলার মধ্যে রাখি। এমনকি বর্ষাতেও কাজ করি।’
নিকট ভবিষ্যতে মুস্তাফিজ-সৌম্যের মতো আরও প্রতিভা কি পাবে বাংলাদেশ? মুফাচ্ছিনুল জানালেন, ‘পাইপলাইনে আরও কয়েকজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় রয়েছে। আশা করি, অনূর্ধ্ব ১৪ ও ১৬ দল থেকে দুই-তিনজন বেরিয়ে আসবে।’
একজন রশিদ ভাই
বিশ্বকাপের আগে সাব্বির রহমান বলছিলেন তাঁর ক্রিকেটার হওয়ার গল্প। অনুরোধ করছিলেন, রশিদ ভাইয়ের কথাটা যেন লেখা হয়। রশিদ ভাই কে? জানতে চাইলে সাব্বিরের চটপটে উত্তর, ‘আমার প্রথম গুরু। ওনার কাছেই ক্রিকেটের হাতেখড়ি।’ বর্তমান দলের অন্যতম সেরা ফিল্ডার তিনি। এর পেছনেও রয়েছে রশিদ ভাইয়ের বিরাট অবদান।
সাব্বির জানিয়েছিলেন, ‘পাড়ার ক্রিকেটে দারুণ একটা ক্যাচ ধরেছিলাম ডাইভ দিয়ে। খেলাটা দেখছিলেন রশিদ ভাই। তিনি পরামর্শ দিলেন উইকেটরক্ষক হতে। পাঁচ-ছয় মাস পর তিনি পরামর্শ দিলেন, পেস বল করতে। তখন পেস বোলার হয়ে গেলাম। এরপর তিনি আবার বললেন, উচ্চতা পেসার হওয়ার জন্য আদর্শ নয়। তিনি স্পিন করতে বললেন। এরপর থেকেই শুরু করলাম স্পিন।’
সাব্বিরের সেই রশিদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলো ২৪ জুন দুপুরে। সাব্বিরের দারুণ ফিল্ডার হওয়ার পেছনে সে ঘটনা মনে করে হাসলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, ওর ফিল্ডিং আমাকে মুগ্ধ করেছিল। রাজশাহীর মডেল স্কুলের কাকলী মাঠে টেনিস বলে খেলছিল। ওখানে দেখেই আমার ফ্রেন্ডস আইডিয়াল ক্রিকেট স্কুলে নিয়ে আসি। একাডেমির নামটা কিন্তু সাব্বিরদের ব্যাচই দিয়েছিল। এরপর দৈনিক বার্তার মাঠে অনুশীলন করাতাম। নিজেও ক্রিকেটার ছিলাম। নিজের খেলোয়াড়ি জীবন বিসর্জন দিয়ে সাব্বিরদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কেবল সাব্বির নয়, তখন আরও কিছু প্রতিভা ছিল আমার অধীনে। দুর্ভাগ্য, তারা নিজেদের এগিয়ে নিতে পারেনি।’
রশিদ অবশ্য কৃতজ্ঞতা জানালেন সাব্বিরের মা-বাবাকেও। বললেন, ‘ওই সময় প্রায় সব ছেলেদের পরিবার থেকেই বাধা আসত। বেশির ভাগই চাইতেন না ছেলে ক্রিকেটার হোক। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সাব্বিরের মা-বাবা। খুব একটা বাধা দিতে দেখিনি। অবশ্য সাব্বিরও খুব জেদি। একবার এগিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার ছেলে নয়। সহজেই হার মানবে না। এ গুণটা ওর ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি।’
সাব্বিরের এই নির্ভীক মনোভাব এখন টের পাচ্ছে প্রতিপক্ষের বোলাররা। ভারতের বিপক্ষে সাব্বির কতটা ধারাবাহিক তার ইনিংসগুলো প্রমাণ—৪১, ২২*, ৪৩। যখন ব্যাট করতে নামেন, বল ও সময় কোনোটাই হাতে থাকে না পর্যাপ্ত। তবু নির্ভারচিত্তে চালিয়ে যান ব্যাট।
১৭ বছর ধরে ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন রশিদ। একসময় খেলতেন ক্রিকেট। খেলোয়াড়ি জীবন ছেড়ে শুরু করলেন কোচিং। তবে মাঝে ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে ক্রিকেট থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। কিছুটা অভিমান ভর করেছিল মনে। বললেন, ‘অনেককে নিয়ে আশা করেছিলাম। ভেবেছিলাম অনেক বড় ক্রিকেটার হবে। কিন্তু প্রত্যাশার প্রতিদান তারা দেয়নি। কেউ কেউ বখে গিয়েছে। এ কারণে ক্রিকেট থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। সাব্বির সে অভিমান ভাঙিয়েছে।’
জানালেন খানিকটা বিরতি দিয়ে আবারও শুরু করেছেন একাডেমির কাজ, ‘আবারও চেষ্টা করছি। একটু সাংসারিক টানাপোড়েন রয়েছে। তবু চেষ্টা করছি কিছু ছেলেকে নিয়ে। বিসিবি অবশ্য আমাকে উত্সাহিত করেছে এ ব্যাপারে।’
নিকট ভবিষ্যতে রাজশাহী থেকে আরও সাব্বির পাবে বাংলাদেশ? রশিদ জানালেন, ‘বর্তমান রাজশাহীর ক্রিকেট-কাঠামোর অবস্থা বেশ ভালোই। অনেক একাডেমি হয়েছে। সবাই চেষ্টা করছে। সমস্যা হচ্ছে, পরিচর্যার অভাবে অনেক প্রতিভা বিকশিত হওয়ার আগে হারিয়ে যায়। তবে সঠিক পরিচর্যা করতে পারলে আশা করি, আরও সাব্বির বেরিয়ে আসবে।’
একই আশা গোটা দেশেরও। আরও মুস্তাফিজ, সৌম্য, সাব্বির উঠে আসুক বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে।
মন্তব্য চালু নেই