জুম্মার দিনে মুসলমানদের জন্য কি করনীয়?
আব্দুল্লাহ্ ইব্নে ইউসুফ (রাঃ) ও আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি জুমার দিন জানাবত গোসলের ন্যায় গোসল করে সালাতের জন্য আগমণ করে সে যেন একটি উট কুরবানী করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় পর্যায়ে আগমণ করে সে যেন, একটি গাভী কুরবানী করল। তৃতীয় পর্যায়ে যে আগমণ করে সে যেন একটি শিং বিশিষ্ট দুম্বা কুরবানী করল। চতুর্থ পর্যায়ে যে আগমণ করে সে যেন একটি মুরগী কুরবানী করল। পঞ্চম পর্যায়ে যে আগমণ করল সে যেন একটি ডিম কুরবানী করল। পরে ইমাম যখন খুতবা প্রদানের জন্য বের হয় তখন ফেরেশতাগণ যিকির শোনার জন্য হাযির হয়ে থাকেন।
আবু নু’আইম (রাহ.) ও আবু হুরায়ারা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, জুমার দিন হযরত ওমর ইব্নে খাত্তাব (রাঃ) খুত্বা দিচ্ছিলেন, এমন সময় এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করেন। হযরত ওমর (রাঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সালাতে সময় মত আসতে তোমরা কেন বাধাগ্রস্ত হও? তিনি বললেন, আযান শোনার সাথে সাথেই তো আমি অযু করছি। তখন হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, তোমরা কি নবী করীম (সঃ) কে এ কথা বলতে শোননি যে, যখন তোমাদের কেউ জুমার সালাতে রওয়ানা হয়, তখন সে যেন গোসল করে নেয়।
জুমার দিনের বৈশিষ্ট্যঃ
ইসলামী শরীয়তের বিধানে জুমার দিনের মাহাত্ম্য সীমাহীন। এই দিন মানব জাতির আদি পিতা- হযরত আদম (আঃ) এর দেহের বিভিন্ন অংশ সংযোজিত বা জমা করা হয়েছিল বলেই দিনটির নাম জুমা রাখা হয়েছে। জুমার দিনকে আল্লাহ্পাক সীমাহীন বরকত দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। এটি সপ্তাহের সেরা দিন। হাদীস শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী এই বরকতময় দিনটি আল্লাহ্পাক বিশেষভাবে উম্মতে মুহাম্মদীকে (সঃ) দান করেছেন।
নবী করীম (সঃ) ইরশাদ করেন, সর্বাপেক্ষা উত্তম ও বরকতময় দিন হচ্ছে জুমার দিন। এই পবিত্র দিনে হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং এই দিনে তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। (মুসলিম শরীফ)
জুমার সমগ্র দিনটিই অপেক্ষারঃ
হাদীস শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ্পাক জুমা দিবসের মধ্যে এমন একটি মুহূর্ত লুকিয়ে রেখেছেন, যে সময়টাতে দোয়া অবশ্যই কবুল হয়। আল্লাহ্র রাসূল (সঃ) বলেন, জুমার সমগ্র দিবসটির মধ্যে এমন একটি মুহূর্ত লুকিয়ে আছে যে সময়টাতে কোন বান্দা যদি নামাযরত থাকে বা- তাসবীহ্-তাহলীল কিংবা দোয়ায় মশগুল থাকে তবে আল্লাহ্পাক তাঁর আকুতি অবশ্যই কবুল করে থাকেন।
এই হাদীসের মর্ম অনুযায়ী বুঝা যায় যে, জুমার দিন সবটুকুই অপেক্ষার। আল্লাহ্র নিকট দোয়া কবুল করানোর জন্য দিনভরই প্রস্ত্ততি থাকতে হবে।
বিশেষ সেই মূল্যবান মুহূর্তটি কখন- এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আলেমগণের বিভিন্ন মন্তব্য রয়েছে। কেউ বলেছেন, ফজরের সময় থেকে সূর্যোদয় সর্যন্ত এই মুহূর্তটি রয়েছে। কারো মতে জুমার সময় শুরু থেকে খুতবা ও জুমার নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই সময়টি হতে পারে। কোরো মতে জুমার দিন আসরের সময় থেকে সূর্যাস্তের সময় পর্যন্ত এই সময় হতে পারে। এই ধরনের আরও কিছু বক্তব্য পাওয়া যায়।
হাদীস শরীফে জুমার দিনকে সাপ্তাহিক ঈদের দিন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জুমা তোমাদের পারস্পরিক দেখা সাক্ষাত ও সাপ্তাহিক ঈদের দিন। তাই এই দিনটি রোযার জন্য নির্ধারিত করা সমীচীন নয়। জুমার আগের রাত্রিটিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, জুমার পূর্ববর্তী রাতে বনী আদমের সমস্ত আমল মহান আল্লাহ্র দরবারে পেশ করা হয়।
(বুখারী, আহমদ)
জুমার দিনের ফজর নামজ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, যারা এই নামাজের জামাতে শরীক হন আল্লাহ্পাক তাদের সকল গোনাহ্ মাফ করেন এবং অফুরন্ত নেয়ামতের ভাগী করেন। একমাত্র সম্পর্ক ছিন্নকারীদের ছাড়া। অর্থাৎ ঐ হতভাগ্যদের কোন আকুতি জুমার দিনের ফজরের শুভক্ষণেও আল্লাহ্র নিকট কবুল হয় না। (বুখারী)
হাদীস শরীফে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, জুমার দিন ফজরের নামাজ জামাতের সাথে আদায়কারীর মত সৌভাগ্যবান আর কেউ হতে পারে না। কারণ, বান্দা যখন এই নামাজের পর হাত তোলে মুনাজাত করে তখন মহান আল্লাহ্পাক কোন অবস্থাতেই তা ফিরিয়ে দেন না।
(বাইহাকী শরীফ)
জুমার দিনে কুরআন তেলাওয়াতঃ
জুমার দিন ফজর থেকে মাগরীবের মধ্যবর্তী সময়ে পবিত্র কুরআনের সূরা ইয়াছিন, সূরা হুদ, সূরা কাহাফ এবং সূরা দোখান তেলাওয়াত কর, এই সূরাগুলিতে বর্ণিত বিষয়বস্ত্ত- অনুধাবন ও চিন্তাভাবনা করার বিশেষ ফযীলতের কথা হাদীস শরীফের বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে। বাইহাকী শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন, জুমার দিন সূরা হুদ পাঠ করো। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, যে ব্যক্তি জুমার দিনে সূরা কাহাফ তেলাওয়াত করবে, তার জন্য এক জুমা থেকে অন্য জুমা পর্যন্ত বিশেষ নূরের বাতি জ্বালানো হবে। তিবরানী শরীফের এক বর্ণনায় রয়েছে যে, যে ব্যক্তি জুমার দিনে বা রাতে সূরা দোখান তেলাওয়াত করে, আল্লাহ্পাক তার জন্য জান্নাতে একটা বিশেষ মহল নির্মাণ করেন।
জুমার দিনে ও রাতে দরূদ শরীফ পাঠের ফযিলতঃ
জুমার দিনে ও রাতে বেশি করে দরূদ শরীফ পাঠ করার বিশেষ ফযীলতের কথা বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) ইরশাদ করেছেন, জুমার দিনে ও রাতে আমার প্রতি বেশি করে দরূদ শরীফ পাঠ করো। যে ব্যক্তি এরূপ দরূদ শরীফ করবে, হাশরের ময়দানে আমি তার জন্য আল্লাহ্র সামনে সাক্ষ্য প্রদান করব। এবং সুপারিশ করব। (বাইহাকী শরীফ)
নবী করীম (সঃ) এর সুসংবাদের ভিত্তিতেই সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আবেদ যাহেদ বান্দাগণ জুমা দিবসে সর্বাধিক দরূদ শরীফ পড়ে আসছেন। অত্যধিক দরূদ পঠিত হয় বলেই জুমার দিনকে ইয়াওমুজ্জাহারা অর্থাৎ ফুলেল দিবস এবং জুমার রাতকে লাইলাতুজ জাহরা বা ফুলেল রজনী নামে অভিহিত করা হয়। দুনিয়ার জীবনে হেদায়তের পথ প্রদর্শক এবং আখেরাতের চিরস্থায়ী শান্তি ও মুক্তির ঠিকানা জান্নাতের জিম্মাদার হযরত নবী করীম (সঃ) এর প্রতি দরূদ শরীফ ও সালাম পেশ করতে থাকা প্রত্যেক মু’মিন নরনারীদের জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। বিশেষ সময় ও দিনক্ষণের প্রতি লক্ষ্য রেখে দরূদ শরীফ বেশি করে পড়ার চেষ্টা করা সবারই একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।
জুমার নামাজে হাজিরা ও খুত্বা শ্রবণঃ
মু’মিনের সাপ্তাহিক ঈদ সমাবেশ জুমার নামাজে আগেভাগে হাজির হওয়া এবং মনোযোগসহকারে জুমার বয়ান ও খুত্বা শ্রবণ করার বিশেষ গুরুত্ব ও ফযীলতের কথা বলা হয়েছে। হাদীসের বর্ণনায় আছে যে, জুমার জামাতের সময় মসজিদের দ্বারদেশে রহমতের ফেরেশতাগণ অবস্থান গ্রহণ করে কে কখন হাজির হচ্ছে তা লক্ষ্য করেন। যারা নিতান্ত বিনয়, নম্রতা ও বিশেষ মনোযোগর সাথে জুমার হাজিরা দেন তাদের নাম রহমতপ্রাপ্ত বান্দাদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করে রাখেন। আল্লাহ্ তা’য়ালার পক্ষ থেকে শান্তির একটি আবাহ সৃষ্টি হয়। তাতে ইবাদতে মনোনিবেশ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। হযরত নবী করীম (সঃ) ইরশাদ করেছেন। জুমার দিন শয়তান বাজারগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং লোকজনকে কাজে কর্মে ব্যস্ত করে তোলে। আর ফেরেশতাগণ মসজিদের দরজায় উপস্থিত হয়ে হাজিরা লিপিবব্ধ করতে থাকেন মুসল্লীগণের পর্যায়ক্রমে উপস্থিতি। যারা খুত্বা শুরু হওয়ার পরে এসে তাড়াহুড়া করে সামনে আসতে চেষ্টা করে, হাদীস শরীফে তাদের প্রতি কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। ইমাম তিরমিযী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি জুমার জামাতে পরে এসে লোকজনের কাঁধ ডিঙ্গিয়ে সামনের দিকে স্থান নিতে চেষ্টা করে সে যেন নিজের জন্য জাহান্নামে যাওয়ার একটি সেতু নির্মাণ করলো।
ইমাম আহমদ (রহ.) বর্ণনা করেন যে, একদা রাসূল (সঃ) জুমার খত্বা দিচ্ছিলেন, এ সময় এক ব্যক্তিকে উপবিষ্ট লোকদের কাঁধ ডিঙ্গিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে দেখে অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ওহে! বসে পড় দেরিতে এসেছ এবং অন্যদের কষ্ট দিচ্ছ।
খুত্বা শ্রবণের গুরুত্বঃ
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, যখন জুমার দিন নামাজের জন্য আহবান জানানো হয় (অর্থাৎ আযান দেওয়া হয়) তখন দ্রুততার সাথে আল্লাহ্র জিকির (অর্থাৎ জুমার খুত্বা) শ্রবণের প্রতি ধাবিত হও। আর ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ কর। (সূরা জুমাআ) জুমার দিনে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অর্জনের লক্ষ্যে গোসল করা এবং সাধ্যমত উত্তম পোষাক পরিধান করারও হুকুম দেওয়া হয়েছে। জীবন জীবিকার ধান্দায় যাতে জুমার প্রস্ত্ততি ও খুত্বা শ্রবণে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়, সে দিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে যে, জুমার গুরুত্বের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতি ঝুকে পড়ো না। উত্তম রিযিকদাতা হচ্ছেন মহান আল্লাহ্।
উপরে আলোচিত পবিত্র কুরআনের আয়াত এবং ও হাদীস প্রমাণ করে যে, জুমার দিন এবং এ পবিত্র দিনের ইবাদত বন্দেগীর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান ও জীবন জীবিকার দোহাই দিয়ে এই দিনের গুরুত্ব বিনষ্ট করা কোন ঈমানদার ব্যক্তির কাজ হতে পারে না।
মন্তব্য চালু নেই