রেঞ্জ কর্মকর্তাসহ সাসপেন্ড ৩

উখিয়া সরকারি গাছ লুট : ঠেকানো যাচ্ছে না বনভূমি লোপাট

কক্সবাজারের বৃহত্তম অভয়ারণ্য হিসাবে পরিচিত উখিয়ার সরকারি বনভূমি দখল ও গাছ লুটপাট অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছারিতার অভিযোগে রেঞ্জ কর্মকর্তাসহ ৩ বন কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হলেও ঠেকানো যাচ্ছে না বনভূমির পরিবর্তন করে পাহাড় কেটে মাটি পাচার বাণিজ্য। নদী বাচাঁও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দরা দাবী করছেন বিভিন্ন বনবিটের দায়িত্বরত বিট কর্মকর্তা ও ভিলেজার হেডম্যান নামদারি কতিপয় বনবিভাগের আসাধু কর্তাব্যক্তির পরোক্ষ সহযোগীতার সুযোগে রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনভূমি সরকারের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

সূত্রমতে, এ উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত উখিয়া রেঞ্জের আওতায় ২১ হাজার একর রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনভূমি কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থাকলেও বাস্তবে তা নেই। কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প ও তৎসংলগ্ন অবৈধ রোহিঙ্গা বস্তি দখল করে নিয়েছে প্রায় ৫শ’ একর বনভূমি। অথচ ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জ কর্মকর্তা মির আহমদ বলছেন, ২৬০ একর বনভূমি রোহিঙ্গাদের জন্য নির্ধারিত থাকলেও এসব রোহিঙ্গারা দিন দিন বস্তি সম্প্রসারিত করে বনভূমি দখল অব্যাহত রাখায় সংকুচিত হয়ে পড়ছে সরকারি মোট বনভূমির আয়তন। এছাড়া এ উপজেলার থাইংখালী, পালংখালী, হলদিয়া, ভালুকিয়া, রাজাপালং, ওয়ালা ও উখিয়ার ঘাট, বালুখালী বন বিটের আওতায় রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনভূমিতে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার অবৈধ স্থাপনা। অথচ তৎকালীন রেঞ্জ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইব্রাহিম মিয়া ৫ হাজার অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরি করে তাদেরকে উচ্ছেদের আওতায় আনার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করার কথা স্বীকার করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

ইতিপূর্বে উখিয়ার ঘাট বনবিটের পুরাতন গর্জন বাগানের আড়াই শতাধিক গাছ লুটপাটের অভিযোগে বিট কর্মকর্তা মোঃ শাহজাহান কে সাসপেন্ড করা হয়েছে। গত মার্চ মাসে উখিয়া সদর বিটের আওতায় রক্ষিত ও সংরক্ষিত সরকারি বনভূমি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিট কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক সরকার ও উখিয়া সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ ইব্রাহিম মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও গাছলুট ও বনভূমি দখল করে পাহাড়ের শ্রেণি পরিবর্তন সহ মাটি পাচার বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা কমেনি। গত মঙ্গলবার সদর বিটের টিভি রিলে কেন্দ্র এলাকা থেকে বনভূমির গাছ লুটপাটের সময় বাধাঁ দিতে গেলে বনকর্মীদের সাথে সংঘর্ষ হয়। পরে উখিয়া থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রায় ২৫ ঘনফুটের ২টি গর্জন গাছ উদ্ধার করে। সদর বিটের ভারপ্রাপ্ত বিট কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মিয়া জানান, এ ঘটনায় ৪জনকে আসামী করে উখিয়া থানায় একটি মামলা রুজু করা হয়েছে।

এদিকে এ উপজেলার পর্যটন স্পট হিসাবে পরিচিত ইনানী রেঞ্জের আওতাধীন ১৯ হাজার একর বনভূমি সংরক্ষণে এনজিও সংস্থা শেড ২০১০ সাল থেকে বন উন্নয়নের কাজ করলেও স্থানীয়দের অভিমত তা লোক দেখানো। প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্ধে ১০ হাজার একর বনভূমিতে জাতীয় উদ্যান করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করলেও গত ৫ বছরেও তা লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ইনানী সহায়ক বনরক্ষা কমিটির আওতায় স্থানীয় বন নির্ভর হতদরিদ্র পরিবারদের নিয়ে কমিটি করে তাদের আত্মনির্ভরশীলতার লক্ষ্যে পরিবার পিছু অনুদান প্রদান করলেও তা কাজে আসেনি বলে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিমত।

অভিযোগ উঠেছে উক্ত বননির্ভর পরিবার গুলো আগের নিয়মে জাতীয় উদ্যানের গাছ লুটপাট ও পাহাড় কেটে শ্রেণি পরিবর্তন অব্যাহত রাখায় এনজিও সংস্থা শেডের মহাপরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন ইনানীর চোয়াংখালী বনবিটের আওতায় এক কোটি ২০ লক্ষ টাকা ব্যয় বরাদ্ধে একটি ন্যাশনাল পার্কের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হলেও পর্যটকদের আকর্ষিত করার মতো উল্লেখ্যযোগ্য উন্নয়ন করা হয়নি। ৪/৫টি সেমি পাকা টিন সেট ঘর নির্মাণ ও ন্যাশনাল পার্ক থেকে বন অভ্যন্তরে এক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রাস্তা নির্মাণ করে সংশ্লিষ্টরা দায়িত্ব শেষ করতে দেখা গেছে।

সম্প্রতি বন অধিদপ্তর বাংলাদেশ প্রধান বন সংরক্ষক মোহাম্মদ ইউনুছ আলী টেকনাফ ন্যাশনাল পার্ক পরিদর্শন শেষে উখিয়ার চোয়াংখালী ন্যাশনাল পার্ক পরিদর্শন করে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তার এ সংক্ষিপ্ত সফরের ১৫ দিনের মাথায় কক্সবাজার বনবিভাগীয় কর্মকর্তা আব্দুল আওয়াল সরকারকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। চোয়াংখালী ন্যাশনাল পার্ক ও ইনানী ১০ হাজার একর বনভূমিতে গড়ে তোলা জাতীয় উদ্যানের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে ইনানী রক্ষিত বনাঞ্চলের ফিল্ড সুপারভাইজার আবু সরওয়ার জানান, ন্যাশনাল পার্ক তাদের আওতাভুক্ত করার জন্য প্রক্রিয়া চলছে।

এছাড়া জাতীয় উদ্যানের প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন হয়েছে বলে দাবী করে তিনি আরো বলেন, জাতীয় উদ্যানের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে। ইনানী সহায়ক বনরক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী জানান, তিনি অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন এলাকায় অনুপস্থিত ছিলেন, বিধায় জাতীয় উদ্যানের কি হয়েছে না হয়েছে তা তার জানা নেই। উখিয়ার সহকারি বন সংরক্ষক রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, রেঞ্জ ও কতিপয় বিট কর্মকর্তা কারণে বনভূমির জায়গা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তারা নিজেদের অপকর্ম ঢাকা দেওয়ার জন্য সত্যতা গোপন রাখায় যথাসময়ে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। তথাপিয়; সরকারি ভাবে আইনগত যেসমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা গ্রহণ করা হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই