ভালো নেই দুই হাসির রাজা

আনিস এবং টেলিসামাদ- আমাদের চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি সময়ের দুই অভিনয়শিল্পী। তাদের অভিনয় দর্শক মনে ফুটে উঠেছে হাসির ফোয়ারা। কিন্তু দুই হাসির রাজা ভালো নেই। বয়স বেড়েছে, তাই বার্ধক্যজনিত সমস্যা তো রয়েছেই। কিন্তু তার থেকেও বড় সমস্যা অবহেলা। গুণী মানুষের সময় ফুরিয়ে গেলে আমরা কি খোঁজ রাখি! প্রশ্নটা বিরাট বিস্ময়ের।

রাজা আনিস
কথা ছিল প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে ঘটা করে আগামী বছর ৫০তম বিবাহবার্ষিকী পালন করবেন হাসির রাজা আনিস। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। তার আগেই আনিসকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন স্ত্রী কুলসুম আরা বেগম। গত ঈদুল আজহার তিন দিন আগে হঠাৎ করেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। স্ত্রীকে হারানোর শোকে মুহ্যমান কৌতুক অভিনেতা আনিস আর কখনো ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

১৯৬৫ সালে খালাতো বোন কুলসুম আরা বেগমকে ভালোবেসে বিয়ে করেন আনিস। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে এতটুকু ছেদ পড়েনি তাদের ভালোবাসায়। দুই মেয়ে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। অসময়ে স্ত্রীকে হারিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন এ অভিনেতা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রতিবেদককে তিনি বলেন, এটি সৃষ্টিকর্তার কেমন পরীক্ষা জানি না। সংসারটা এলোমেলো হয়ে গেল। বড় একা হয়ে গেলাম। আমি আর ভালো নেই। অভিনয়ের ক্ষেত্রে ও আমাকে প্রচণ্ড রকমের সহযোগিতা করেছে। ওর অনুপ্রেরণাতেই অভিনেতা আনিস এবং সফল স্বামী ও বাবা হতে পেরেছি। যে আমাকে পথ দেখিয়ে আজকের এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে সে-ই যখন রইল না তখন আর অভিনয় করে কি হবে।

টিকাটুলির অভয়দাশ লেনের বাসায় বড় অসহায় অবস্থায় এখন দিন কাটাচ্ছেন হাসির রাজা আনিস। যে অভিনেতা কখনো কাঁদতে জানেননি, সবাইকে শুধু হাসিয়েছেন। তিনি আজ অঝোরে কাঁদছেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছেন এবং সবার কাছে দোয়া চাইছেন জীবনসঙ্গিনী কুলসুম আরা যেখানেই থাকুক যেন ভালো থাকে। আনিসের বড় মেয়ে ফারহা দীবা থাকে আমেরিকাতে। ওখানে তার স্বামী তারেক হোসেন ব্যবসা করে। ছোট মেয়ে ফাতেমা রহমান রিমি কুমিল্লায় আছে। তার স্বামী আলাউদ্দীন সেখানে ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কর্মরত। দুই কন্যাই এখন বাবার পাশে আছে।

আনিসের জন্ম ১৯৪২ সালে জলপাইগুড়িতে। ১৯৬০ সালে উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ ছবিতে তার প্রথম অভিনয়। কিন্তু ছবিটি মুক্তি পায়নি। ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায় আনিস অভিনীত প্রথম ছবি জিল্লুর রহমান পরিচালিত ‘এইতো জীবন’। এর আগে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ভ্রাতৃদ্বয় এহতেশাম ও মুস্তাফিজের লিও দোসানী ফিল্মসে সহকারী সম্পাদক ও পরিচালক ছিলেন তিনি। এ দুই নির্মাতার মাধ্যমেই এক সময় অভিনয়ে নিয়মিত হন আনিস। চার শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। এ ছাড়া টিভি ও মঞ্চেও কাজ করেন। কিছুদিন আগেও হাসির রাজা আনিস প্রাণখোলা হাসি দিয়ে এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘দুঃখ কি তা আমি জানি না, আমি শুধু হাসতে আর হাসাতে জানি। আমার জীবনে দুঃখ বলে কিছু নেই।’ সুখ নিয়ে এমন আত্দবিশ্বাসী আনিসের পৃথিবীজুড়ে এখন শুধুই নিকষ কালো দুঃখের অন্ধকার।

টেলি সামাদ
অভিনেতা টেলি সামাদ ভালো নেই। অসুস্থ অবস্থায় কর্মহীনভাবে কাটছে তার জীবনের সাদা-কালো দিনগুলো। আবার ব্যস্ততায় ফিরতে চান তিনি। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় দিয়ে হাসাতে চান দর্শক-ভক্তদের। প্রখ্যাত এই অভিনেতা বলেন, শরীরটা মোটেও ভালো যাচ্ছে না। এভাবে আর কতদিন শুয়ে বসে থাকা যায়। চাইলেও দৌড়াতে পারছি না। মনের গভীরে তিনটি ইচ্ছে লালন করে বাস্তবে তা রূপ দিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি। জানি না সৃষ্টিকর্তা আমার ইচ্ছে পূরণের সুযোগ দেবেন কিনা। টেলি সামাদের ইচ্ছেগুলো হলো- প্রথমে একটি ছবি নির্মাণ করবেন তিনি। যার গল্প, সংগীত সবই তার। গল্পের সারমর্ম হচ্ছে- একজন ভালোবাসা বঞ্চিত মানুষ। মনের মানুষটিও তার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। চরম দুঃখ-কষ্ট আর অপ্রাপ্তি নিয়ে জীবন সাঙ্গ হয় মানুষটির। দ্বিতীয় ইচ্ছে- নিজের জীবন কাহিনী নিয়ে বই লিখবেন তিনি। বইটি প্রকাশ হবে আগামী বইমেলায়। এতে উঠে আসবে ছোটবেলা থেকে শুরু করে তার সারা জীবন। শেষ ইচ্ছে- বশির আহমেদ, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, সতিনাথ মুখার্জী, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়সহ দুই বাংলার জনপ্রিয় শিল্পীদের গাওয়া গানগুলো টেলিভিশনে গাইতে চান তিনি।

মুন্সীগঞ্জে জন্ম নেওয়া ঢাকা চারুকলা কলেজের ছাত্র আবদুস সামাদ ১৯৭৩ সালে চলচ্চিত্রে আসেন। নজরুল ইসলাম নির্মিত ‘কার বৌ’ তার প্রথম অভিনীত ছবি। চলতি বছর মুক্তি পাওয়া অনিমেষ আইচের ‘জিরো ডিগ্রি’ তার এ পর্যন্ত অভিনীত শেষ ছবি।

গত বছরের অক্টোবরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে স্কয়ারে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। তখন তাকে লাইভ সাপোর্টে রাখা হয়। এর আগে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে তার হার্টের বাইপাস সার্জারি করানো হয়। ডায়াবেটিস, স্নায়ু, কিডনি, হার্টের সমস্যা ছাড়াও পায়ে গ্যাংগ্রিনের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। গ্যাংগ্রিনের কারণে ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল কেটে ফেলতে হয় তার। আর্থিকভাবেও অসচ্ছল হয়ে পড়েন তিনি। এ নিয়ে প্রতিবেদকের শোবিজ বিভাগে বেশ কটি রিপোর্ট প্রকাশ হলে গত বছরের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী তাকে আর্থিক সহায়তা দেন। বর্তমানে ফার্মগেইটের পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় শুয়ে বসে কাটছে তার অলস সময়। অসুস্থতা ও শারীরিক দুর্বলতার কারণে ঠিকমতো হাঁটাচলাও করতে পারেন না। কিছুটা সুস্থবোধ করলে ভক্তদের অনুরোধে স্টেজ প্রোগ্রামে অতিথি হয়ে যান তিনি। চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধ আর খাবার তালিকা মেনে চলতে হয় তাকে। অসুস্থতাকে তুচ্ছ করে আবার ছুটে যেতে ইচ্ছে করে প্রিয় ক্যামেরার সামনে। কিন্তু বয়স আর অসুস্থতার ভারে নুইয়ে পড়া শরীর বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার ইচ্ছের পথে।



মন্তব্য চালু নেই