টেলিফোনে আড়িপাতা
সরকারের কতটুকু এখতিয়ার আছে ব্যক্তিগত নাগরিক জীবনে টেলিফোনে আড়ি পাতার? এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।
মাহমুদুর রহমান মান্নার টেলিফোন সংলাপ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। বিশেষ করে দু’টি টেলিভিশনে বক্তা ও উপস্থাপক উপস্থাপিকা এবং কিছু নির্ধারিত বক্তা এমনভাবে কথা বলেছেন, রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই, সব বিষয় নিয়েই সব কিছুর মধ্যে সবাই অংশ নিতে পারে। আগেই বলে নেয়া ভালো মাহমুদুর রহমানের টেলিফোন সংলাপ নিয়ে আমার কোনো কথা নেই, কারণ ওটা তদন্তাধীন। যে বিষয় নিয়ে আমি দ্বিমত পোষণ করছি তা হচ্ছে, বাংলাদেশের বিশেষ করে দু’টি টেলিভিশন চ্যানেলের বক্তা ও উপস্থাপক উপস্থাপিকা মরিয়া হয়ে উঠেপড়ে লেগেছেন টেলিফোনে সরকারের সংস্থা আড়িপাততেই পারে রাজনীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের টেলিফোনে; প্রথম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন রাজনীতিবিদদের ষড়যন্ত্র ধরার জন্য আড়িপাতা বৈধ। দ্বিতীয় বিষয় হিসেবে আলোচনায় উঠে এসেছে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই, সব কিছু সবার জানার অধিকার আছে।
যারা টেলিফোনে আড়িপাতাকে বৈধ মনে করছেন ক্ষেত্রবিশেষে যদি সেখানে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাজনিত কোনো বিষয় থাকে তবে সেখানে আমার কথা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয় ছাড়া ব্যক্তিগত চরিত্র নিধন, সামাজিকভাবে কাউকে হেয় করার উদ্দেশ্যে যদি কাটিং পেস্টিং, ভয়েস সুপার ইম্পোজ, বক্তব্যের সংযোজন, বিয়োজন করে বিশেষ ব্যক্তিদের নির্দেশে বিশেষ বিশেষ সংস্থার তৈরি অডিও ভিডিও ক্যাসেট যদি ইউটিউবে ছাড়া হয়, সেটিকে কোন চোখে দেখবেন? তাই আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বেশ কিছু দিন আগে আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান শুভ্রের টেলিফোন সংলাপ প্রচার করা হয়েছিল। প্রচার করা হয়েছিল জয়নুল আবেদিন ফারুকের নাম দিয়ে একটি রোমান্টিক কথোপকথন, জয়নুল আবেদিন ফারুকের নাম দিয়ে যে অডিও রেকর্ডটি ইউটিউবে ছাড়া হয়েছিল, সেখানে ছিল না রাষ্ট্রের কোনো ষড়যন্ত্রের কথাবার্তা। সেটি কেন ও কারা, কোন স্বার্থে প্রচার করেছিলেন- এই প্রশ্নের সন্তোষজনক কোনো উত্তর টেলিভিশনের টকশোর বক্তা এবং উপস্থাপক বা উপস্থাপিকারা দিতে পারবেন কি? মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ী, সংবাদপত্রের সাথে জড়িত অনেক ব্যক্তি, প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক কর্মী টেলিফোনে বান্ধবীদের সাথে যারা হরহামেশাই যোগাযোগ রাখেন-হোটেল রেস্তোঁরায়, কর্মক্ষেত্রে বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে হরহামেশাই রোমান্টিক কথাবার্তা বলছেন, রোমান্টিক কর্মকাণ্ড করেছেন প্রতিনিয়ত, সমাজে তাদের সংখ্যা তো কম নয়। বিশেষ সংস্থা যদি এগুলো ধারণ করে অডিও কিংবা ভিডিও ইউটিউবে ছেড়ে দেয়। সেই ব্যক্তির ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন, রাজনৈতিক জীবন, পেশাগত জীবনে কী অবস্থার সৃষ্টি হবে এর ভয়াবহতা কতদূর পর্যন্ত গড়াবে চিন্তা করেছেন একবারও? এবং তা প্রকাশ করা বৈধ না অবৈধ, উচিত না অনুচিত, বলবেন কি? যে যেই অবস্থার মুখোমুখি হন সে সেই অবস্থা বুঝতে পারেন তার যন্ত্রণা কতটুকু। জয়নুল আবদিন ফারুক রাজনীতি করেন, তাই তার সব কিছু সরকার ও সমাজের কাছে অপরাধ। হীন কু-মনোবৃত্তি নিয়ে মোবাইল কথোপকথন নিয়ে আলোচনার মুখরোচক বিষয়বস্তু করে তোলার পশ্চাতে কি ব্যক্তিগত জীবন, রাজনৈতিক জীবন কলুষিত করা নয়? এর মধ্যে রাষ্ট্রের কোনো স্বার্থ নিহিত ছিল?
কিছু দিন আগে আমি নিজেও এ রকম সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি, আমি আমার অবস্থান সে সময়ে স্পষ্ট করেছি। যারা টেলিফোনে আড়িপাতা রাষ্ট্রের প্রয়োজন উচিত বলে জোরালো বক্তব্য রাখছেন, তাদের উদ্দেশে বলতে চাইÑ আমার যে কাটিং পেস্টিং করা বক্তব্যটি যারা ইউটিউবে ছেড়ে প্রচার করার দায়িত্বে ছিলেন, তা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কি কোনো ষড়যন্ত্র ছিল? রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে তা তৈরি করা হয়েছিল ও বিশেষ সংস্থার তৈরি করা অডিও টেপটির প্রচার করার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু ছিল? আমার বিরুদ্ধে কাটিং পেস্টিং করে তৈরি করা রেকর্ড ছেড়ে আমার দলের মধ্যে বিভ্রান্তি ও আমার অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা ছাড়া কি অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ছিল? যারা এই কাটিং পেস্টিং করা অডিও রেকর্ডিং প্রচার ও প্রকাশ করেছেন, তারা কতটুক লাভবান হয়েছেন? দেশ, জাতি ও সমাজ কতটুকু উপকৃত হয়েছে বলতে পারেন? একটা অডিও ক্যাসেট বানিয়ে বাজারে ছেড়ে দিলেন, আর দীর্ঘ দিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্তরিকতা, বিশ্বাস, অবস্থান, মর্যাদা নষ্ট করা কি এতই সহজ?
আমার প্রশ্ন হচ্ছে মাহমুদুর রহমান মান্নার টেলিফোন সংলাপ ফাঁস হওয়ার পর যেসব ব্যক্তি রাজনীতির সাথে জড়িত যেকোনো ব্যক্তির যেকোনো কথাবার্তা ফাঁস করার প্রয়োজনীয়তার সাপেক্ষে যারা যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, তাদের কাছে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমার প্রশ্ন, আমি যেহেতু এই ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হয়েছি, এ ষড়যন্ত্রটুকুর কতটুকু আইনি বৈধতা রয়েছে এবং সরকারের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কতটুকু প্রয়োজন রয়েছে? যদি প্রয়োজন হয় তবে কেন? সরকারের কি এর চেয়ে বেশি গুরুদায়িত্ব নেই।
বেশ কয়েকটি এ ধরনের ঘটনায় আমি খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি। কথার মধ্যে হুবহু রেকর্ডিং না করে, কিছু বাদ দিয়ে কিছু রেখে, কিছু বিভিন্ন জায়গার কথাবার্তা কাটিং পেস্টিং করে, সংযোজন-বিয়োজন করে তৈরি করা হয় এক অদ্ভুত জিনিস। যারা সরকারের এ কাজটি সরকারের নির্দেশমাফিক করেন, তারাই সরকারের বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে এটি প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছেন। শুধু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয় নয়।
শিরোনামের সাথে বিষয়বস্তুর মিল নেই অনেক ক্ষেত্রেই। যেমন বেগম খালেদা জিয়া দলের নেতাদের সাথে কথা বলার কিছু অডিও ইউটিউবে ছাড়া হয়েছে এবং মন্ত্রিপরিষদের মিটিংয়ে সেগুলো বাজিয়ে শুনেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীও, সংবাদপত্রে তা প্রকাশিত হয়েছিল কিন্তু সেখানে ‘শিরোনামের’ সাথে কথাবর্তার কোনো মিল নেই। সন্ত্রাসের স শব্দটিও পাওয়া যায়নি। অডিওটিতে সাধারণ কথাবার্তা ছাড়া অন্য কিছু নেই।
মাহমুদুর রহমান মান্নার টেলিফোনে কথাবার্তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল কি না, আমি সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না, কারণ এটা তদন্তাধীন। এ ছাড়া মাহমুদুর রহমান মান্না ও আমি কখনো কোনো দিনও একদল করিনি। বরং ওনাকে কোর্টের বারান্দায় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সাথে তাহের হত্যা মামলার সাক্ষী হিসেবে এবং মামলা চলাকালে হাইকোর্টের বারান্দায় বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল। কিন্তু আমি একটা বিষয়ে খুব কষ্ট পেয়েছি, যখন চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচনের বোর্ড থেকে তার নাম মুছে ফেলতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারাও গণধোলাইয়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
যারা ডাকসু, চাকসুর ছাত্রসংসদ থেকে ক্ষমতার দাপটে ও দলীয় ভিসিদের সহযোগিতায় ছাত্রসংসদের নির্ধারিত তালিকা থেকে নাম মুছে বীর পুরুষের কাজ করেছেন বলে মনে করছেন তাদের বলতে চাই- সব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় প্রশাসন দিয়ে নিজের নামটি মুছে ফেলা জায়গায় বসাতে কি পারবেন? এর জন্য একটি বিশেষ গুণাবলি ও যোগ্যতার প্রয়োজন হয় এবং যে নামটি লেখার জন্য সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা নির্বাচনের মাধ্যমে ভোট দেয়, ম্যান্ডেট দেয়ার পর ডাকসু ও চাকসু ভবনে নাম লেখা হয়। ক্ষমতা দিয়ে নাম যেমন লেখাও যায় না তেমন ক্ষমতা দিয়ে নাম মুছে ফেলাও যথার্থ নয়।
আর যেসব সংস্থা এই মহান কাজ, টেলিফোনে আড়িপাতার কাজটি করেছেন তাদের অনুরোধ করতে চাই সরকারের মনমতো টেলিফোনে আড়ি পেতে, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থের নাম দিয়ে সরকারের বিশেষ বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের মেধা, যোগ্যতা, সময় নষ্ট না করে ব্যক্তিচরিত্র নিধনের এই খেলায় মত্ত না হয়ে জনগণের প্রয়োজনের দিকে মনোনিবেশ করুন। তাতে দেশ-জাতি উপকৃত হবে।
যদি টেলিফোনে আড়ি পেতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার প্রিয় শিক্ষক ড. ইউনুস, ড. তাহের, সিনিয়র ভাই শফিকুল ইসলাম লিলন, চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলির অপহরণ ঠেকাতে পারতেন। বাঁচাতে পারতেন ২০০৮ নির্বাচনে চাটখিল সোনাইমুড়ী থেকে মনোনীত নুরুল ইসলাম মনি ও তার সন্তানকে দগ্ধ হওয়ার হাত থেকে। টেলিফোন আড়ি পেতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ড্রাইভারকে খুঁজে পেতেন ও বিশ্বজিৎকে বাঁচাতে পারতেন, টেলিফোনে আড়ি পেতে পেট্রলবোমা মারার আগেই দগ্ধ মানুষকে দগ্ধ হওয়ার আগেই বাঁচাতে পারতেন, টেলিফোনে আড়ি পেতে যদি মাওলানা ফারুকিকে বাঁচাতে পারতেন নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে। যত্রতত্র পড়ে থাকা লাশ, যেগুলোর দায় পুলিশ নিচ্ছে না, সেসব মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার আগে আড়ি পেতে বাঁচাতে পারতেন। বাঁচাতে পারতেন সানাউল্লাহ নুর বাবু, লোকমান হোসেন, ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়্যারম্যান একরাম, নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া স্মরণকালের নিকৃষ্ট বর্বরতা, জঘন্যতম নির্মমতা, ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা, অভিজিৎ হত্যার ষড়যন্ত্রের রহস্য টেলিফোনে আড়ি পেতে জানতে পারেননি কেন?
অভিজিৎ হত্যার দায় কি এড়াতে পারবে সরকার? ব্যাপকভাবে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে, মান্নার টেলিফোন সংলাপ ফাঁস করার পর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পুলিশের সামনে এমন ঘটনা? সরকারের পাতানো কোনো ষড়যন্ত্রের নাটক নয়তো?
তাই আমার শেষ কথা হচ্ছে আড়ি পাতুন ক্ষেত্রবিশেষে নয়, সর্বজনীনভাবে আড়িপাতার উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত চরিত্র নিধন, সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন, রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হনন, এগুলো না হয়ে সত্যিকার অর্থে মানুষের জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে আড়ি পাতুন, জীবন বাঁচান, নাগরিক জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে দিন, মর্মান্তিক ঘটনা ঘটার আগেই ভূমিকা রাখুন, মন্ত্রী ও এমপি, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের টেলিফোনে আড়ি পাতুন, টেলিফোনে আড়ি পেতে চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, পেট্রলবোমা ক্রসফায়ারের তথ্য সংগ্রহ করুন। দলীয় এমপিদের মোবাইলে আড়ি পাতুন তাদের প্রতিনিয়ত অপকর্মের খোঁজখবর নিন, মানুষকে দগ্ধ হওয়ার আগে অপহৃত ব্যক্তিকে অপহরণের আগে বাঁচানোর জন্য আড়ি পাতুন, মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক, লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর নয়।
লেখক:
মন্তব্য চালু নেই