মির্জাপুরের রণদা প্রসাদ সাহার দানবীর হওয়ার গল্প

দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা। সংক্ষেপে যাকে সবাই এক নামে জানে আরপি সাহা। একজন সংগ্রামী, আত্মপ্রত্যয়ী মানবসেবক। দরিদ্র থেকে দানবীর খেতাবে এখন যিনি এশিয়াখ্যাত। তিথি অনুযায়ী মানবতা রোধের উজ্জ্বল এ নক্ষত্রের জন্ম ১৮৯৬ সালের উত্থান একাদশীতে। ঢাকার অদূরে সাভারের কাছুরে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার লৌহজং নদীবিধৌত নিভৃত পল্লীর মির্জাপুর গ্রামে। মাতার নাম কুমুদিনী সাহা, পিতার নাম দেবেন্দ্র নাথ সাহা।

মাত্র সাত বছর বয়সে বিনা চিকিৎসায় মা কুমুদিনী সাহার মৃত্যুর পর দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন আর্থিক সচ্ছলতা পেলে চিকিৎসা বঞ্চিত হতদরিদ্র মানুষের জন্য কিছু করবেন।

মায়ের মৃত্যুর পর বাবা দেবেন্দ্রে নাথ সাহা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দারিদ্র্যের কঠোর কষাঘাত আর সৎ মায়ের অবহেলা নিয়ে অনাদরে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেন রণদা। অভাবের তাড়নায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে খাবার চেয়ে খেয়েছেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে দিনমজুরের কাজ করেছেন।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে ভবিষ্যৎ গড়ার আশায় পাড়ি জমান কলকাতায়। সেখানে বেঙ্গল এম্বুলেন্স কোরে যোগদান করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ৩৮ জন সেনাসদস্যকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে বীরত্বগাথা ভূমিকার জন্য বিভিন্ন মহলে প্রশংসা অর্জন করেন। এরপর পরিচয় হয় জর্জ ভি নামে এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তার মাধ্যমে তিনি রেলওয়ে বিভাগে টিটিইর চাকরি নেন। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে চাকরিটিও হারান।

কম বয়সে আয় করা কিছু টাকা জমিয়ে ১৯৩২ সালে তিনি কলকাতাতে প্রথমে লবণ ও পরে কয়লার ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসা থেকেই ধীরে ধীরে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। ব্যবসায় কিছুটা সফল হওয়ার পর তিনি বেঙ্গল রিভার নামে একটি জাহাজ ক্রয় করেন। এরপর নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লাতে তিনটি পাওয়ার হাউজ ক্রয় করেন। নারায়ণগঞ্জে জর্জ এন্ডারসন কোম্পানির পাটের বেল তৈরি করেন। পরবর্তী সময় তিনি লেদার ব্যবসা শুরু করেন। এভাবে তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ এলাকা মির্জাপুরে ফিরে আসেন। ছেলেবেলার সংকল্পের কথা স্মরণ করে ১৯৩৮ সালে তিনি মির্জাপুর গ্রামের লৌহজং নদীর তীর ঘেঁষে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে ৭৫০ শয্যাবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল কুমুদিনী হাসপাতালে রূপ নেয়। দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিজে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হলেও নারী শিক্ষার জন্য তিনি কুমুদিনী চত্বরের ভেতরেই ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতেশ্বরী হোমস। প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী নার্সিং স্কুল। তিনি টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজ, মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্রনাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা, মির্জাপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও মির্জাপুর এসকে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। জীবনসংগ্রামে প্রতিষ্ঠা পেয়ে প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হলেও তিনি ভোগ বিলাসে ব্যয় করেননি। অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। তার জীবনের অর্জিত সব অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল। এ ট্রাস্টের মাধ্যমেই তার নাতি কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব প্রসাদ সাহা মির্জাপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন কুমুদিনী মহিলা মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ ও কুমুদিনী হ্যান্ডিক্রাফট।

রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন লোকহিতৈষী মানবতাবাদী ও দানবীর। সংস্কৃতির দিকেও তার ছিল বড় ঝোঁক। তিনি প্রায়শই কুমুদিনী চত্বরের আনন্দ নিকেতনে যাত্রাপালাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। যাতে তিনি নিজেও অভিনয় করতেন।

১৩৫০ সালের ভয়াবহ মন্বন্তরের সময় তিনি লঙ্গরখানা খুলেন। ওই সময় সেখানে হাজার হাজার দরিদ্র লোক প্রতিদিন খাবার খেত। ’৭১-এর ৭ মে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য ও তাদের এদেশীয় দোসররা রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা রবিকে তাদের নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। আজ অবধি তাদের কোন খোঁজ মেলেনি।

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত সব প্রতিষ্ঠান আজও তার অমর কীর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেখান থেকে যুগ যুগ ধরে মানুষ সেবাসহ নানা উপকার পেতে থাকবে। তিনি প্রমাণ করে গেছেন “মানুষ বাঁচে তার কর্মে, বয়সের মধ্যে নয়”। তার কর্মের মাঝেই এ দানবীর হয়ে থাকবেন চির অমর।



মন্তব্য চালু নেই