আলোচিত-সমালোচিত পিন্টু

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় কারা অন্তরীণ থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন বিএনপির সহ-সাংগঠনিকবিষয়ক সম্পাদক, প্রাক্তন সাংসদ নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টু। প্রয়াত এই নেতা তার রাজনৈতিক জীবনে ছাত্রদলের সভাপতি থেকে হয়েছিলেন বিএনপিদলীয় সাংসদ।
চেয়েছিলেন মন্ত্রী হতে। সে আশা পূরণ হওয়ার আগেই গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান তিনি।
সর্বশেষ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হতে চেয়েছিলেন তিনি। এ জন্য কারাগার থেকে ভোটের লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আইনজীবীকে দিয়ে কিনেছিলেন মনোনয়ন ফরমও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নামতে পারেননি ভোটের লড়াইয়ে। আলোচিত-সমালোচিত এই নেতার রয়েছে রাজনৈতিক উত্থানের গল্প।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকাকালে লালবাগ এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন প্রয়াত বিএনপি নেতা লে. জে (অব.) মীর শওকত আলী। তার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৪ সালে তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৬৫ ও ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার নির্বাচিত হন হাজি মো. সেলিম। তিনি যোগদান করেন বিএনপির রাজনীতিতে।
ওই সময় একই এলাকার জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা নাসির উদ্দীন পিন্টুও মীর শওকত আলীর আশীর্বাদপুষ্ট হন। মীর শওকতের আশীর্বাদে হাজি সেলিম তার পৈতৃক ছোট পরিসরের ব্যবসা থেকে অল্প সময়ের ব্যবধানে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হন, আর নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টুও সময়ের ব্যবধানে হয়ে যান ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি।
১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হাজি সেলিম এবং পিন্টু দুজনেই লালবাগ এলাকার সংসদ সদস্য পদে প্রার্থিতার জন্য বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার দ্বারস্থ হন। কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যান পিন্টু। হাজি সেলিম যখন বুঝতে পারলেন তাকে বিএনপি থেকে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে না, তিনি তখন তৎকালীন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ হানিফের মাধ্যমে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং লালবাগ এলাকা থেকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে যান। আর রাতারাতি বনে যান আওয়ামী লীগের নেতা।
এলাকাবাসীর মতে, হাজি সেলিম এবং পিন্টু তখন থেকেই সতীর্থ এবং রাজনৈতিক সহকর্মী থেকে পরিণত হলেন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হাজি সেলিম বিজয়ী হন, পরাজিত হন পিন্টু। ২০০১ সালের নির্বাচনে ঠিক তার উল্টো। এ সময় পিন্টু নির্বাচিত হন, পরাজিত হন সেলিম। পুরান ঢাকার এই দুই নেতার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব আলোচিত হয় ওই এলাকায়। বিভিন্ন কারণে পুরান ঢাকায় বসবাসকারীদের কাছে যেমন আলোচিত তিনি, তেমনি সমালোচিতও। এর মধ্যে কবরস্থানের ওপর দিয়ে রাস্তা করায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
হাজি সেলিম আর পিন্টুর পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও সামঞ্জস্য দেখা যায় নানা ক্ষেত্রে। এই দুই নেতার মধ্যে হাজি সেলিম ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র কিনেও জমা দিতে পারেননি দলীয় বাধার কারণে, আর নাসির উদ্দীন পিন্টু একই পদের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিলেও সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তা বাতিল হয়ে যায়।
জানা গেছে, একই ‘গুরুর’ শিষ্য হাজি মো. সেলিম এবং নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টু। দলীয় পরিচয় ভিন্ন হলেও এই দুই নেতা তাদের নিজ নিজ দলীয় সরকারের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ক্ষমা এবং আশীর্বাদ প্রাপ্তির মাধ্যমে ঐতিহাসিক নজির তৈরি করেন।
বিগত বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট আমলে ২০০১-০৬, সর্বোচ্চ সরকারি আনুকূল্য পান নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টু। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সর্বোচ্চ ৭৬টি মামলা প্রত্যাহার করে যাবতীয় অপরাধের অভিযোগ হতে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ঠিক একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকার ২০০৯-১৩ সালে হাজি সেলিমের বিরুদ্ধে দায়ের করা সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৩৭ মামলা প্রত্যাহার করে যাবতীয় অপরাধের অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়।
পিন্টু গত ৬ বছরের বেশি সময় ধরে বিডিআর বিদ্রোহ মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারাগারে আটক ছিলেন। ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআর জওয়ানদের পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করার মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়। পিন্টু এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন।
রোববার সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বুকের ব্যথা অনুভূত হলে পিন্টুকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা ১২টা ২০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন।

































মন্তব্য চালু নেই