অবশেষে মুখ খুললেন মনজুর

চসিক নির্বাচনের মাত্র তিনঘণ্টার মধ্যে নির্বাচন বর্জন ও রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন বিএনপি সমর্থিত উন্নয়ন আন্দোলনের প্রার্থী সাবেক মেয়র মনজুর আলম। কিন্তু নির্বাচন বর্জনের চেয়েও রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার ঘোষণায় সেদিন অবাক হয়েছিলেন চট্টগ্রামের রাজনৈতিক মহল।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ সম্মেলনে বলেই ফেলেছেন, নিজ দলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে দুঃখ পেয়ে মনজুর আলম রাজনীতিতে অবসর নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়া বিষয়টি রহস্যের জন্ম দেন চট্টগ্রামের রাজনৈতিক মহলে। রহস্য অনুসন্ধানে ছুটতে থাকেন গণমাধ্যম কর্মীরাও।

সেই থেকে গণমাধ্যমে নানা আলোচনা ও বিশ্লেষণ ধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও রাজনৈতিক মহলের প্রকৃত রহস্য যেন মিটছে না।

মনজুর আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, নির্বাচন বর্জনের কারণ তো সেদিনই বলেছিলাম যে এটা কোন নির্বাচন নয়, প্রহসন। ছোট বেলায় দুষ্টুমি খেলতে গিয়ে খেলার সাথীর মুখের সামনে কলা নিয়ে আবার ছোঁ মেরে নিজে গিলে খেয়েছি। বিদেশি দাতা সংস্থা ঋণের নামে অধিক মুনাফায় তাদের তৈরি সরঞ্জাম ক্রয়ে বাধ্য করে আবার ওই টাকা হাতিয়ে নেয়। এই নির্বাচন হচ্ছে সে রকম।

তিনি বলেন, জীবনে এ পর্যন্ত ৬টি নির্বাচনে অংশ নিয়েছি, কারচুপি, অনিয়মসহ নানা রকম চুরি দেখেছি। কিন্তু প্রকাশ্যে কেন্দ্র দখল করে এভাবে ভোট ডাকাতি কখনো দেখিনি। যা দেখে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম কর্মীসহ সবাই হতবাক। মুখ খুলে কারো কিছু বলার সুযোগও নেই।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে প্রকাশ্যে অস্ত্র দিয়ে গুলি করে কেন্দ্র দখল করা হয়েছে। ভোট গ্রহণে নিয়োজিত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জিম্মী করে ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়েছে।

শুধু দলের নেতাকর্মী নয়, বর্তমান সরকারের সাংসদরা পর্যন্ত লাইসেন্স করা অস্ত্র নিয়ে গুলি করে কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে জোরপূর্বক সীল মেরেছে। এরপরও এ নির্বাচন মেনে নিই কিভাবে। তাই নির্বাচন বর্জন করেছি। আর যে রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। রাজনীতির পরিবেশ নেই, সেই রাজনীতি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই রাজনীতিতেও অবসরের ঘোষণা দিয়েছি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গণতন্ত্র নস্যাৎ ও পরিবেশ নষ্টের পেছনে শুধু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বা তার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট নয়, সাবেক ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটও কম দায়ী নয়। এই দুই জোটের বলির পাঠা গণতন্ত্র। সাধারণ মানুষ এখন মত ও কথা বলার অধিকার হারিয়েছে।

নির্বাচনে দলীয় নেতাকর্মীদের অসহযোগিতা এবং পাশে না থাকার কারনে দুঃখ পেয়ে রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ সংবাদ সম্মেলনে যে মন্তব্য করেছেন সে ব্যাপারে জানতে চাইলে মনজুর আলম বলেন, প্রতিপক্ষ হিসেবে মন্তব্য করতেই পারেন। এটাই গণতন্ত্র। তবে এ মন্তব্য একেবারে ফেলে দেওয়ার মতও নয়।

তিনি বলেন, নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও সাংসদরা তাদের সমর্থিত প্রার্থীর জন্য যেভাবে ঝাপিয়ে পড়েছেন। আমি ঠিক সেভাবে চায়নি। অন্তত পাশে থেকে সহযোগিতা ও সাহস যুগিয়ে তো যেতে পারত। দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই মামলার অজুহাতে দুরেই থেকেছে। ঠিক যতটা নয় ততটা করায় দুঃখ পেয়েছি বৈকি!

তিনি আরও বলেন, আমার যতটুকু করার দরকার ততটুকু বা তার চেয়ে বেশি আমি করেছি নেতাকর্মীদের জন্য। কিন্তু নেতাকর্মীরা আমাকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেছে। ঠিক কিনারায় নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলার ফাঁদের মতো। ফলে দুঃখটা বেশি পেয়েছি। এ ধরনের রাজনীতি আমি পছন্দ করি না।

তিনি বলেন, সরকারের বিরোধী আন্দোলনেও বিএনপির নিস্তেজতার অন্যতম কারণ হচ্ছে মৌসুমি নেতাদের হাতে দলের নেতৃত্ব। ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন কম। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলেন, ‘ধইয়ের আগদি, লড়াইন্যার পিছুদি পড়ি তায় দে নেতাদি অন্য হন কিছু হইলিও আন্দোলন নয়বু’।

সচেতন মহলের মতে, মনজুর আলম দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে স¤পৃক্ত ছিলেন। উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ড থেকে টানা তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তখনকার মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে প্যানেল মেয়র যেমন ছিলেন, তেমনি বিভিন্ন সময় ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

এক-এগারোর সময় তৎকালীন মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রেপ্তার হলে মনজুর আলম ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পান। মহিউদ্দিন চৌধুরী মুক্তি পাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে সন্দেহ-অবিশ্বাস ও দূরত্ব সৃষ্টি হয় মনজুর আলমের। এই দূরত্ব ও ভুল বোঝাবুঝি নিরসনের অনেক উদ্যোগ নিয়েও সফল হতে পারেননি মনজুর আলম।

যা-ই হোক, এসব ঘটনার পর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনজুর আলম তাঁর লিডার মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিলে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিএনপি তাঁকে সমর্থন দেয়। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার এই কৌশল যে ফলপ্রসূ হয়েছিল। সেই নির্বাচনে মনজুর আলমের বিজয়ই তার প্রমাণ। এরমধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে স¤পৃক্ত হলেন তিনি। বিএনপির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টার পদও লাভ করেন।

কিন্তু সে অর্থে বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচি বা আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁকে পাওয়া যায়নি বলে নগর বিএনপির সাধারণ স¤পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনসহ বড় একটি অংশের যে অভিযোগ, তা অনেকাংশেই সত্য। বরং মেয়র নির্বাচিত হওয়ার অল্প কিছুদিন পর থেকেই মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে স¤পর্কের উন্নতি ঘটে তাঁর। আগের মেয়াদে মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প যেমন তিনি অব্যাহত রেখেছেন, তেমনি কর্পোরেশনেও মহিউদ্দিন চৌধুরী বলয় ভেঙে নতুন কিছু করার চেষ্টাও করেননি তিনি। যা ক্ষুব্দ করে তোলে বিএনপি নেতাকর্মীদের।

এরপরও দলের নেতাকর্মী সমর্থকদের সাথে নগর বিএনপির শীর্ষ নেতারাও নাশকতাসহ নানা অভিযোগে মামলার আসামি হওয়ায় ক্লিন ইমেজের মনজুর আলমকেই মেয়র প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দিয়ে মাঠে নামেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনজুর আলমের কণ্ঠেই প্রকাশ পায়, রাজনৈতিক আন্দোলন ও কর্মকান্ডে পাশে না থাকার বদলা নিয়েছে বিএনপি নেতারা। পাশে না থাকার যন্ত্রণা কি তা মনজুর আলমকে বুঝিয়ে দিয়েছেন বলে গর্ব করে বলতেও শোনা যায় বিএনপির অনেক নেতাদের মুখে।

যোগাযোগ করা হলে নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রাজনীতি ছাড়ার বিষয় একান্তই মনজুর আলমের ব্যক্তিগত বিষয়। দলের কোনো সিদ্ধান্ত নয়। রাজনীতি করতে গেলে দলের কর্মকান্ড ও সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হয়।

আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, তিনি হয়তো বলতে চেয়েছেন বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিবেশ তাতে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। মনজুর আলম স্বচ্ছ রাজনীতির মানুষ, স্বচ্ছ রাজনীতি পছন্দ করেন তিনি। তবে এত তাড়াতাড়ি নির্বাচন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি তাঁর।

তিনি বলেন, আমি শেষ পর্যন্ত দেখতে চেয়েছিলাম। কারণ ভোটারদের মধ্যে মনজুর আলমের নীরব সমর্থন আছে। সেটা যে আছে এত অনিয়মের পরও প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যাই তা বলে দেয়।

এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টরা যেতে পারেননি, কিন্তু বিএনপির স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা কি কোনো কেন্দ্রে ছিলেন, যাতে কর্মীরা মনোবল পেতে পারেন, সমর্থকেরা নীরবে তাঁদের প্রার্থীর পক্ষে রায় দিতে পারেন?

তিনি বলেন, পরিচিত ও প্রভাবশালী নেতারা সরকারদলীয় সমর্থকদের প্রতিরোধের মুখে পড়লে বা নিগৃহীত হলে সেটা সংবাদমাধ্যম বা সাধারণ মানুষের কাছে আরও বড় সংবাদ হয়ে উঠত, অভিযোগেরও গুরুত্ব বাড়ত। কিন্তু বিএনপি নেতারা সেই ঝুঁকি নিতে চাননি। তাই তিনি দুঃখ পেয়েছেন।

তিনি বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ নিঃসন্দেহে হতাশাব্যঞ্জক, পাশাপাশি দলীয় নেতা-কর্মীদের হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মনোবৃত্তিও আশাহত করেছে মনজুর আলমকে। রাজনীতি থেকে মনজুর আলমের অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত এই হতাশার ফল।



মন্তব্য চালু নেই