খেলা প্রেমিক খুলনার এক ‘দার্শনিক’ রিকশাওয়ালার গল্প

দর্শন মানে দেখা। কিছু না কিছু আমরা দেখতে থাকি সব সময়ই। সেই অর্থে প্রতিটা মানুষই আসলে দার্শনিক। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে এখন অবশ্য খুব উচ্চপর্যায়ের চিন্তকদেরই দার্শনিক বলার চল।

নিম্ন শ্রেণির পেশাজীবী মানুষও যে কোনো বিষয়কে অনেক গভীরে তলিয়ে দেখার সামর্থ্য রাখেন, সেটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। মাঝেমধ্যে সেটা মনে করিয়ে দেন খুলনার রিকশাচালক মুনির হাওলাদারের মতো মানুষ। তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়াম লিগ (আইপিএল) না দেখার কারণ হিসেবে অকপট যুক্তি দেন, ‘ওটা কে দেখে? জুয়ার খেলা!’ তিনি খুব দারুণভাবে বিশ্লেষণ করে যান খুলনা টেস্টের আদ্যোপান্ত। পরিচয় দেন গভীর রাজনৈতিক বিচক্ষণতার।

খুলনা টেস্টের তৃতীয় দিন শেষে প্রথম ইনিংসে পাকিস্তানের লিড ছাড়িয়ে গেছে ২০০ রান। পাকিস্তানের রানপাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে ধুঁকছে বাংলাদেশ। স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে চেপে বসি মুনিরের রিকশায়। প্রথম দু-এক কথায় জানা গেল, তিনি মাঠে বসে খেলা দেখে খুব একটা তৃপ্তি পান না। টিভিতে বিশ্লেষণযুক্ত খেলা দেখতেই তিনি বেশি অভ্যস্ত। তাই বলে মাঠে বসে খেলা দেখার অভিজ্ঞতা যে একেবারেই নেই মুনিরের, তা নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খুলনায় যে হাতে গোনা কয়েকটি ম্যাচ হয়েছে, সেগুলোর দু-একটিতে উপস্থিত ছিলেন মধ্যবয়সী এই রিকশাওয়ালা।

ক্রিকেটের খবরাখবর রাখেন, এমনটা জানার পর তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আইপিএল দেখেন না? প্যাডেল মারতে মারতেই মুনির জবাব দেন, ‘ওটা কে দেখে? জুয়ার খেলা! সাকিব থাকলে কলকাতার খেলা দেখি।’ সাকিব যে পাকিস্তানের বিপক্ষে চলমান টেস্ট সিরিজ শেষ করে আবার কলকাতায় পাড়ি জমাবেন সেই খবরও আছে তাঁর কাছে।

এরপর বাংলাদেশের খেলা নিয়ে কিছুক্ষণ আফসোস করলেন মুনির। ক্রিকেটারদের দুষলেনও খানিক। তবে অনেকখানি ব্যাটফুটে চলে গেলেও বাংলাদেশ যে টেস্টটা ড্র করতে পারবে সেটা মনপ্রাণ দিয়েই বিশ্বাস করেন তিনি। তাঁর সমীকরণ অনুযায়ী, দেড়দিনের মতো ব্যাটিং করতে হবে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। নিজের প্রত্যাশা পূরণের দাবি রেখে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দিকে ছুড়ে দিলেন মোক্ষম প্রশ্নটা : ‘আটজন ব্যাটসম্যান নিছে দলে। না পারলে হইব?’

খুলনা টেস্টের চতুর্থ দিনে (শুক্রবার) যে ভালো দর্শক হবে সেই আশাবাদ শোনা গেল মুনিরের কণ্ঠে। প্রথম তিনদিন অফিস করা মানুষগুলো তো সপ্তাহান্তে সত্যিই চাইবেন গ্যালারিতে বসে প্রিয় তারকাদের খেলা দেখতে। খুলনায় প্রথম তিনদিনের দর্শকসমাগমও ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু খুলনায় খুব বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজিত হয় না বলে আক্ষেপও করলেন মুনির।

সব শেষে দিলেন নিজের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয়। তাঁর ধারণা, ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশন নির্বাচন থাকায় এবার খুলনাতে টেস্ট আয়োজন করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকার পরে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজিত হয় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের মর্যাদা পেলেও সুন্দরবনের কোলঘেঁষা খুলনা খানিকটা উপেক্ষিতই থেকে গেছে। মুনিরের কথা শুনে সত্যিই মনে জাগল প্রশ্নটা- সত্যিই তো! ঢাকা-চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশন নির্বাচন হওয়ার কারণেই কি শিকে ছিঁড়েছে খুলনার ভাগ্যে?



মন্তব্য চালু নেই