একটি জলজ ইতিহাস
একজন নারীর ক্ষেত্রে এর ওজন ৯ আউন্স এবং একজন পুরুষের ক্ষেত্রে এর ওজন ১০.৫ আউন্স প্রায়। সাধারণভাবে প্রতি মিনিটে এটি ৭২ বার সংকোচন এবং প্রসারণের মাধ্যমে শিরা পথে আসা কার্বন-ডাই-অক্সাইড যুক্ত অপরিশোধিত রক্তকণিকাগুলোকে বিশুদ্ধ করে ধমনি পথে আবার ছড়িয়ে দেয় শরীরের প্রতিটি প্রান্তে। আর এভাবেই আপনার হৃদয়যন্ত্র আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যায় জীবনেরই দিকে। তেমনিভাবে, জীবনের প্রতীক নদী জোয়ার-ভাটার মধ্যদিয়ে নগরবাসীর সব আবর্জনাকে সরিয়ে নিয়ে যায়, বিপরীতে বয়ে আনে নতুন জীবন এগিয়ে চলে সভ্যতা। লেখক কেইটলিন ডেভিস টেমস নদীতে সাঁতারে ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন তার ‘ডাউনস্ট্রীম : এ হিসট্রি অ্যান্ড সেলিব্রেশন অব সুইমিং দ্য রিভার টেমস’ বইটি। হান্টার ডেভিস এবং মার্গারেট ফস্টারের মেয়ে কেইটলিন ডেভিস ১৯৬৪ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। ডেভিস পেশায় একজন লেখক, সাংবাদিক এবং শিক্ষক।
বাইরন, সুইফ্ট, বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন, ডেভিড উইলিয়ামস এবং ১৪ বছরের অ্যাগনেস সাধারণ কেউ না; এরা সবাই টেমস নদীতে দীর্ঘ সময় সাঁতার কেটে ছিলেন। যখন উইলিয়ামস ২০১১ সালে চ্যারিটির জন্য নদীতে ১৪০ মাইল সাঁতার কেটে ছিলেন তখন সেটা বিশ্ব মিডিয়ায় শিরোনাম হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সাঁতারু থেকে শুরু করে ভয়ডরহীন বুনো সাঁতারু এবং কখনও কখনও দুঃসাহসী অপেশাদার সাঁতারুরাও ঝাঁপিয়েছেন এ নদীতে। তবুও ২০১২ সাল থেকে টেমসের পানিতে সাঁতার কাটা আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ।
লন্ডন বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি হল যে, ব্যস্ত জলপথ, সেই সঙ্গে ঘূর্ণিজল এবং প্রচণ্ড স্রোত মানুষের প্রবেশের অনুপযোগী। উৎসাহীরা গর্ব করতে পারে যে এটি ইউরোপের শহুরে নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিষ্কার নদী, কিন্তু এর ঘূর্ণিত স্রোত, উত্তাল ঢেউয়ের কারণে শুধু কেন্দ্রীয় লন্ডনেই এক বছরে ৪০ জনের প্রাণহানি ঘটে। যে নদীটি এক সময় দিয়েছিল জীবন সেটাকেই এখন বিপজ্জনক স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়!
‘ডাউনস্ট্রীম’ বইটির মধ্য দিয়ে লেখক ডেভিস ভয়ডরহীনভাবে টেমসে ঝাঁপ দিয়েছেন আনন্দের উৎস হিসেবে এর সুনাম ফিরিয়ে দিতে। ডেভিসের খেয়ালি ধ্বনির প্রতিফলন হয়েছে জো লিওয়ার্ডের মার্জিত প্রচ্ছদে। যেখানে দেখা যায়, বিস্তৃত জলজ দৃশ্যে একজন মানুষ সাঁতার কাটছে স্যামন মাছের মতো মোচড় দিয়ে দিয়ে। এটি এক ধরনের বন্যতার অনুভূতি যা এই কাহিনীকে বিদ্রোহের বারুদ জোগায়। পানিতে নামার মধ্য দিয়ে আমরা সব জাঁকজমক এবং প্রভাবকে পরাভূত করি, যেটা হবে কর্তৃপক্ষের প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। এটি নিশ্চিত মোহিনী, নোংরা এবং বিপজ্জনক যে কোনোভাবেই হোক বৃটেনের জাতীয় জীবনে টেমসের প্রভাব অনেক। এটি একটি মহাসড়ক, একটি সীমানা, খাদ্য ভাণ্ডার, খেলার স্থান এবং শতাব্দীর পর শতাব্দীর গ্লানিকর সমাধিক্ষেত্র। ডেভিস এখানে নদীতে গোসল করার ৪০০ বছরের একটি চার্ট দেখিয়েছেন।
রাজা দ্বিতীয় অ্যাডওয়ার্ড এবং রাজা দ্বিতীয় চার্লস নদীতে গোসলে অভ্যস্ত ছিলেন এবং নিয়মিত সাঁতার কাটতেন। রানী ভিক্টোরিয়ার শাসন দেখেছে বিভিন্ন নদী প্রতিযোগিতার প্রতিষ্ঠানের জন্ম, অপেশাদার সাঁতারুদের দীর্ঘ-দূরত্বের চ্যাম্পিয়নশিপ। এছাড়াও গোসল ঘর, উন্মোক্ত স্থানে গোসলের ব্যবস্থার জন্য সাধারণ শ্রমিকের উত্থান হতে। লন্ডন এবং গ্রিনিচে সৈকতের সৃষ্টি হয়েছিল। টেমসের ২১৫ মাইল ভ্রমণে এটা গ্লাসটারশায়ার থেকে শুরু হয়ে ‘নর্থ সী’-তে গিয়ে মিলিত হওয়ার পথে অক্সফোর্ডশায়ার, বার্কশায়ার, বাকিংহ্যামশায়ার, সারে,
এসেক্স, কেন্ট অঞ্চলসমূহ ধুয়ে গেছে। নদীর যাত্রাপথের পাশাপাশি সেতুগুলো ডুব এবং ঝাঁপ দেয়ার জন্য সীমাহীন সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
এ বইতে ডেভিস দেখিয়েছেন কিভাবে ‘থ্রি মেন ইন এ বোট’, ‘টেলস অব দ্য রিভার ব্যাংক’ এবং ‘আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেন্ডস’ বইগুলোতে টেমস একটি প্রধান চরিত্র হিসেবে হাজির হয়েছে, সেই সঙ্গে এখানে আরও তুলে ধরেছেন আগের না দেখা চাল-চলন, পোশাক-আশাকের ছবি। এখানে আমরা জানতে পারি কিভাবে টেমস রাজনৈতিক প্রতিবাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘ স্থান দখল করে আছে; গেইল্টজ এখানে সাঁতার কেটে ছিলেন শহুরে গরিবদের সামাজিক মর্যাদাকে দৃষ্টিগোচর করার জন্য, ১৯৮৩-তে লেবার পার্টির রাজনীতিবিদ জন প্রেসকট সাঁতার কেটে ছিলেন সরকারের অনিরাপদ আবর্জনা সাগরে ফেলার প্রতিবাদে। ১৯৫৭ সালকে ডেভিড বিষেশভাবে উল্লেখ করেছেন এখানে, যখন নদীটিকে ‘জীবতাত্ত্বিকভাবে মৃত’ ঘোষণা করা হয় আর মানুষ ফিরে যেতে থাকে বাড়ির ভেতরে অবস্থিত ক্লোরিনযুক্ত পানির পুলের দিকে। এরকম ভিন্ন ভিন্ন কারণে আমরা খোলা পানিতে আমাদের সাঁতারের ঐতিহ্য হারাই।
‘ডাউনস্ট্রীম’ লেখার মাধ্যমে ডেভিস সাধারণ্যে একটা স্বপ্ন ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস চালিয়েছেন, বুনো সে স্বপ্নের পেছনে ছুটে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় লন্ডনবাসী টেমসে ফিরিয়ে আনবে হারানো স্রোত, ভবিষ্যৎ সময়ের ভাঁজ খুলে এমন একটি দৃশ্য দেখার প্রত্যাশায় রইলাম আমরা।
সূত্র : গার্ডিয়ান ও ইন্ডিপেনডেন্ট অনলাইন
মন্তব্য চালু নেই