এবার টোয়েন্টি২০ বিজয়ের গল্প

ওয়ানডে সিরিজ জয়ের গল্প শেষ; এবার শুরু হয়েছে টোয়েন্টি২০ বিজয়ের গল্প। যেখানে আকাশ-বাতাস উৎসবের বর্ণিল সৌরভে সুরভিত হয়েছে। বাংলাদেশ নতুন এক ক্রিকেট অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

দীর্ঘ অপেক্ষার (১৬ বছর) পর ওয়ানডেতে দ্বিতীয় ম্যাচ জয়। পরের দুইয়ে দুই। ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানকে ‘বাংলা ধোলাই’। সেই গল্পের রেশ কাটতে না কাটতেই শুক্রবার মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের মাঠে বাংলাদেশ উড়িয়েছে টোয়েন্টি২০ ম্যাচে বিজয়ের লাল-সবুজের পতাকা। এই ম্যাচেও প্রতিশোধের স্পৃহায় উজ্জীবিত বাংলাদেশ ছিল অপ্রতিরোধ্য। পাকিস্তান কোনো প্রতিরোধ করতে পারেনি। হেরেছে অসহায়ভাবে।

২২ বল হাতে রেখে টোয়েন্টি২০ ম্যাচে জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। এই ভার্সান নিয়ে আফ্রিদিদের হম্বি-তম্বি মিরপুরের মাঠে মারা গিয়েছে। ৭ উইকেটে জয় এই এক গৌরবময় ইতিহাস রচনার পথ। হারের চোরাবালিতে অনেক পথ হাঁটার দিন। বরং ক্রমেই বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। ওয়ানডে সিরিজে বাংলা ধোলাইয়ের পর টোয়েন্টি২০ ম্যাচেও কোনো পাত্তা পায়নি পাকিস্তান। পাকিস্তানকে ১৪১ রানে আটকে ফেলে বাংলাদেশ সাব্বির-সাকিবের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে অনায়াস জয় তুলে নিয়েছে। সাকিব-সাব্বির দুই জন হাফসেঞ্চুরি করে বোলার মুস্তাফিজুর-তাসকিন-সানিদের দারুণ জয়ের সূচনা-ধারাকে অক্ষত রেখেছেন। এমন স্মরণীয় জয় দেখতে হয়তো সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছুটে এসেছিলেন। দেখেছেন বিজয়ের স্রোত। দর্শকদের উচ্ছ্বাস-উন্মাদনার অভূতপূর্ব আনন্দ উদযাপনী।

পর পর ৩ ম্যাচেই টস জেতা পাকিস্তান সন্ধ্যার সন্ধিলগ্নে ব্যাটিংয়ে নেমেছিল। কিন্তু তাতেও সেই আগের বেগতিক অবস্থাই প্রমাণিত। ওয়ানডে সিরিজের হারের বৃত্ত ভাঙতে পারেননি তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকা আফ্রিদি-হাফিজ-গুল-ওহাব-আজমলদের দল। বরং ধীর-স্থিরভাবে শুরু করার চরম মাশুল দিয়েছে পাকিস্তানীরা। ক্যারিয়ারের তৃতীয় ওভারেই উইকেট তুলে নিয়েছেন বাংলাদেশের নবীন পেসার মোস্তাফিজুর রহমান। খুবই গুরুত্বপূর্ণ উইকেটের পাশে নাম লিখিয়েছেন এই নতুন ক্যাপড। পাকিস্তানের অধিনায়ক শহিদ আফ্রিদিকে বোকা বানিয়েছেন এই ১৯ বছরের বোলার। আফ্রিদির কাছে অবশ্য আউটটি মনপুত হয়নি।

ব্যক্তিগত চতুর্থ মুস্তাফিজুর ওভারে তুলে নিয়েছেন হাফিজের উইকেট। অভিষেক ম্যাচে ২ উইকেট তুলে নিয়ে এই বাঁহাতি নতুন আশার মশাল জ্বালিয়েছেন। মাশরাফি এই নবীস বোলারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ওপেনিং বোলিংয়ের দায়িত্ব। প্রথম ওভারেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন তাকে দলে নেওয়া ভুল হয়নি। বারুদে বোলিং করে প্রথম স্পেলে ২ ওভারে দিয়েছেন মাত্র ৫। পরের দুই ওভারে যথাক্রমে তৃতীয় এবং চতুর্থ ওভারের একটু রান খরচা হলেও তুলে নিয়েছেন ২ উইকেট। দিয়েছেন ১৫ রান। তার টোটাল স্পেল ৪-০-২০-২। ঘরোয়া ক্রিকেটে আবাহানী লিমিটেডের হয়ে খেলা মুস্তাফিজুর বয়সভিত্তিক ম্যাচ বাদ দিলে মাত্র প্রথম শ্রেণীর ১৩টি ম্যাচ খেলেছেন।

সাকিব বল হাতে উইকেট না পেলেও ৪ ওভারে মাত্র ১৭ রান দিয়েছেন। প্রথম স্পেলে সাকিব ছিলেন ভয়ঙ্কর। ২ ওভারে দিয়েছেন মাত্র ২ রান। বলা যায় মুস্তাফিজ-সাকিবে দারুণ বোলিংয়ের সূচনা করেছিল বাংলাদেশ। ১০ ওভার শেষে পাকিস্তানের স্কোর যখন ৫৩; নেই এক উইকেট; তখনই আশায় বুক বাধতে শুরু করেছিল ক্রিকেটভক্তরা। সেই আশায় গুঁড়েবালি দিতে পারেন নি পরের দিকে দ্রুত রান তোলা হাফিজ-হারিস। বুমবুম আফ্রিদি জ্বলে ওঠার আগে সাজঘর দেখেছেন। তাসকিন রানে দিলেও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট তুলে নিয়ে পাকিস্তানকে লড়াই করার সমৃদ্ধ পুঁজি গড়তে দেননি। তাসকিনে সাজঘর দেখেছেন বিপদ হয়ে ওঠার আগেই শেহজাদ। তখন তার ব্যাটে ১৭ রান; ৩২ বলে। তবে তাসকিনের এই উইকেটটির অর্ধেক কৃতিত্ব পেতে পারেন মাশরাফি। মাশরাফি লং অফে ঝাঁপিয়ে ক্যাচ তালুবন্দীর যে অনুপম দৃশ্যের অবতারনা করেছেন; তা বিপুল টাকায় টিকিট কেনা দর্শকরা পয়সা উসুলের উপলক্ষ খুঁজে নিয়েছেন।

টস জয়ী পাকিস্তানের উইকেট বিবেচনায় শুরুটা মন্দ হয়নি। যদিও বাংলাদেশের বোলারদের আটোসাটো বোলিং মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছিল। তারপরও ৯ ওভারে পাকিস্তান ৫০ রান তুলেছিল বিনা উইকেটে। কিন্তু সেট ব্যাটাররা ফিরে যাওয়ায় এবং নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পতন তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানের নবীন ওপেনার মুক্তার আহমেদ ৩০ বলে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩৭ রান করেছেন। আরফাত সানির বলে স্ট্যাম্পিং হয়েছেন দুরন্ত ঘূর্ণিতে। এ ছাড়া হারিস টোয়েন্টি২০ স্টাইলে ৩০ রান তুলে নিয়েছেন মাত্র ২৪ বলে। হাফিজের ব্যাটে ২৬ রান। একটি রান আউট। সব মিলিয়ে উড়তে থাকা বাংলাদেশের বিপক্ষে ৫ উইকেট হারিয়ে পাকিস্তান ১৪২ রানের টার্গেট ছুড়ে দিয়েছিল।

রাতের অবয়ব। শিশিরের বালাই নেই। সেখানে বাংলাদেশের জয়ের জন্য প্রয়োজন ১৪২ রান।১৪ রানের মাথায় পাকিস্তান রান আউটের বদলা নিয়েছে তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান সৌম্যকে শূন্য রানে ফিরিয়ে দিয়ে। একটি বলও খেলতে পারেননি বাংলাদেশের এই নবীন সেনশেসন। অভিষেকে তামিমকে সঙ্গ দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। ১৪ রানে সৌম্য নেই। আবার দলের ১৬ রানের মাথায় ইনফর্ম তামিম ফিরেছেন স্লিপে ক্যাচ দিয়ে। তখন তার ব্যাটে মাত্র ১৪ রান। গুলের একটু লাফিয়ে ওঠা বলটি তামিমের ব্যাটের কানায় লেগেছিল। হাফিজ তা লাফিয়ে ওঠে কব্জা করেছেন। দলীয় ৩৮ রানে রানমেশিন মুশফিক যখন ফিরে গেছেন; তখন পাকিস্তান শিবিরে বিপুল উচ্ছ্বাস। শঙ্কা বাংলাদেশ শিরিবে। মুশফিক বোকা বনেছেন ওয়াহাব রিয়াজের বলে। তার স্লোয়ারে মুশফিকের ব্যাট ছুটে ভেঙে গেছে মিডল স্ট্যাম্প। দারুণ ছন্দেই ব্যাটিং করছিলেন মুশফিক। ১৫ বলে ১৭। সাকিবের ব্যাটিং অর্ডার বদলে পাঠানো হয়েছিল সৌম্য ফিরে যাওয়ার পর পরই। সাকিব তামিম-মুশফিকের ফিরে যাওয়া দেখেছেন। কিন্তু বিচলিত হননি। একটু ধীরে শুরু করলেও সাব্বিরকে পেয়ে বনে গেছেন ফুরফুরে। অনাবিল আনন্দদায়ী ব্যাটিংয়ে যেমন সাব্বির ছিলেন; ছিলেন সাকিবও। তাদের দুইয়ের ৬৬ বলে ১০৫ রানের রেকর্ড (টোয়েন্টি২০ ক্রিকেটে চতুর্থ উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ) পার্টনারশিপ টোয়েন্টি২০ ম্যাচেও পাকিস্তানের বিপক্ষে স্মরণীয় জয় এনে দিয়েছে। এটা ছিল বাংলাদেশ-পাকিস্তান অষ্টম টোয়েন্টি২০ ম্যাচ। সাব্বির মাত্র ৩১ বলে হাফসেঞ্চুরি পূর্ণ করেছেন। পরের বলে সাকিবও হাফ সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন ৪০ বলে। সাকিবের ম্যাচ জয়ী ৫৭ রানের ইনিংসে একটিও ছক্কার মার ছিল না। তবে সাব্বির কিন্তু ছক্কা ঠিকই মেরেছেন। বাংলাদেশের ইনিংস আরেকটি ছক্কা ছিল তামিমের ব্যাটে। সাকিব-সাব্বির মাত্র ৬৩ বলে ১০০ রান তুলে নিয়ে বিজয় সুনিশ্চিত করেছেন। ৩২ বলে ৫১ রান করা সাব্বিরের গলায় ঝুলেছে ম্যান অব দ্য ম্যাচের মালা। পাকিস্তানের বোলিংয়ের অবস্থা ছিল তথৈবচ।

ম্যাচ জয়ের পরপরই হাস্যোজ্জ্বল প্রধানমন্ত্রী যথারীতি বিজয়ের পতাকা নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছেন। একটু পরেই ছুটে এসেছেন উৎসমঞ্চে। যেখানে তিনি তুলে দিয়েছেন মাশরাফির হাতে ওয়ানডে সিরিজ এবং টোয়েন্টি২০ ম্যাচ জয়ের শিরোপা। ঠিক আগের মতোই তিনি ক্রিকেটারদের সঙ্গে তুলেছেন ছবি।



মন্তব্য চালু নেই