কেন সবকিছু ভুলে প্রবাসে পড়ে থাকি?
প্রবাসী জীবনের সুখ দুঃখের কথা লিখতে গেলেই মনটা কষ্টে ভরে উঠে, কলম যেন থেমে যেতে চায়।বুকের মধ্যখানে অজানা এক শুন্যতা আসন করে বসে, পুরনো স্মৃতির খাতার প্রতিটি পাতা নতুন করে চোখের সামনে ভেসে উঠে নিজের অজান্তে চোখ থেকে অনাখাংখিত কিছু জল ঝরে পড়ে।
নিজেকে বড় একা মনে হয়, পাওয়া আর না পাওয়ার হিসেব মিলাতে পারি না।অবহেলা আর অনাদরের এই প্রবাসী জ়ীবনের ইতিবৃত্ত জানি না কোথা থেকে শুরু করবো। চেষ্টা করবো আমাদের যন্ত্রনা গুলো সবার সাথে ভাগাভাগী করে নিতে, জানি সম্ভব নয় তবুও চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি। স্ব্প্নে্র প্রবাস বাস্তবে বিশাল আকারের এক দানব বললে ভূ্ল বলা হবে না। প্রবাস নামক দানবের কাহিনী লিখতে বসেছি তাই কিছু ভয় কিছু কস্ট আমাকে পিছনে আকড়ে ধরেছে।
আজ আমি সব কিছু উপেক্ষা করে পাঠকের সামনে প্রবাস জীবনের যন্ত্রনা তুলে ধরার আপ্রান চেষ্টা করবো, যা অনেকের কাছে নতুন এবং অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে। আমি যা লিখবো তার এক একটি অক্ষর বাস্তব সত্য। যাহা বাস্তব, তাহা সহজে শ্রুতি মধুর হয় না, সুখের শেষ সীমায় নিয়ে যায় না। স্বপ্নের সাজানো প্রবাস আর বাস্তবের এই প্রবাসের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যাবধান।বিষেশ করে আমার এই লেখার সাথে স্বপ্নের প্রবাসের কোন যোগসূ্ত্র নেই।
আমরা যারা প্রবাসী তাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে অনাখাংখীত হাজারো কাহিনী যা আমাদের আপনজন দেশবাসী জানেন না, আজ আমি প্রবাসের বাস্তব রূপ দেখাবো। আজ আমি প্রবাসীর ক্রন্দন শুনাবো।
অনেকদিন থেকে এই ধরনের একটি লিখবো লিখবো করে লিখা হয়ে উঠেনি। কষ্টের কথা গুলো নিয়ে লিখতে গেলে কষ্ট বাড়ে বই কমে না, আমাদের যন্ত্রনা হাহাকার শুনিয়ে আমাদের ভালোবাসা প্রান মানুষের চোখে জল ঝরিয়ে কি লাভ? যাদেরকে আমরা প্রবাসীরা এতো ভালোবাসি ওদেরকে বেদনার সাগরে ভাসানো কি ঠিক হবে?
হয়তো অতিরিক্ত কষ্ট থেকে নিজেকে মুক্তি দেয়ার জন্য এই নিরবতা পালন করছি। কিন্তু এখন সময় এসে গেছে তাই বুকে পাথর রেখে হলেও আমাকে লিখতে হবে। আমাদের অজানা কষ্ট পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জানা উচিৎ।আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমার যন্ত্রনা আমার মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখবো কাউকে কোনদিন কিচ্ছু বলবো না, আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত কথা রাখতে পারলাম না।আমি আমার বিবেকের কাছে হার মেনেছি, আমার বিবেক আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় বিবেকের এই দংশন থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় অবলম্বন করতে হলো।
আজ আমি অনাখাংখীত বিষয় নিয়ে লিখবো, আমি যা জেনেছি আমি তা সবাইকে জানাবো,
আমি যা দেখেছি তাই লিখবো, আমি যা শুনেছি তা লিখবো না। আমার এই লিখার সত্যতা যাচাই করবে লক্ষ লক্ষ প্রবাসী ভাই বোন।
এই লিখা কোন রোমান্টিক উপন্যাস নয়, কারো একজনের জীবন কাহিনী নয়।এই লেখাগুলো আমার মতো লক্ষ লক্ষ প্রবাসী ভাই বোনের প্রতিদিনের কাহিনী, চোখের জল দিয়ে লেখা এই কাহিনী।
আমি জানি এবং বিশ্বাস করি আমার এই লেখা ভালোবাসা প্রান আপন মানুষকে অন্তরে অন্তরে কাদাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
পৃথিবীর ওজন থেকে আরো বেশী ওজনের কষ্ট বুকে নিয়ে আমরা যে বেঁচে আছি তা আজ আমাকে লিখতে হবে। সবাইকে পরিচয় করে দেয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
ভাগ্য পরিবর্তে্র দৌড় ঝাঁপ দিতে গিয়া প্রবাসীরা কতবার মৃত্যুবরন করে আর কতবার বেঁচে উঠে তার হিসাব কে রাখে?
ভালোবাসার কাংগাল, একটু আদরের কাংগাল চোখের জল চোখেই শুকায়, যাদের বুকের আশা বুকেই শুকিয়ে কাঠ হয় যা স্বচোক্ষে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে কারন আমি ছিলাম তাদের একজন।
এসব রূপকথার পল্প নয়, সাজানো কোন কাহিনী নয় যা আমি আমার ইচ্ছেমত কাগজের বুকে আঁচড় কেটে কল্পনার রঙ দিয়ে সাজিয়েছি।
এক সময় প্রবাস সম্পর্কে আমারও অন্য রকম ধারনা ছিল যা আজ আর নেই। বাস্তবতার সাথে পরিচিত হবার পর আমার ক্কপল্পনায় সাজানো প্রবাসের প্রানকাড়া ছবিটি তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে গেল। দেখতে দেখতে সারাজীবনের তিল তিল করে গড়ে তোলা স্ব্প্ন মরুভূমির আকার ধারন করতে এতটুকু সময় লাগে নি। কল্পনায় যে কোন কিছুতে রঙ দেয়া যত সহজ বাস্তবে তা কিন্তু অনেক সময় হয়ে উঠে না।
আমরা যাহা ধরতে পারি না, যাহা নাগালের বাহিরে থাকে না এই ধরনের বিষয়বস্তুকে খুবই প্রাধান্য দিয়ে থাকি এবং ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। মনে মনে সফলতার একটা চিত্র দাঁড় করে নিজে নিজেই তৃপ্ত হই, যেমন প্রবাস জীবন।
যারা প্রবাসের সাথে এখনও পরিচিত হবার মত সুযোগ হয় নি বা তেমন সম্ভাবনা নেই তাদের বেলায় এই ধরনের সুখস্ব্প্ন দেখা খুবই সাভাবিক।
স্ব্প্ন দেখা অন্যা্য নয়, প্রতিটি মানুষের জীবনে সুন্দর কিছু স্ব্প্ন থাকে এবং এই স্ব্প্নকে বাস্তব রূপ দেয়ার সহজ উপায় হল প্রবাস গমন। জীবনকে নানা রঙ্গে সাজাতে হলে স্ব্প্ন দেখা খুবই জরুরী, স্বপ্ন ছাড়া এই জীবন তো আর সাজানো যায় না, তাই স্ব্প্নকে সম্বল করেই আমাদেরকে এগুতে হয়।
স্বপ্নকে যত সুন্দর করে সহজে সাজানো যায় বাস্তবকে এত সহজে হাতে নাতে ধরে কাছে বসানো যায় না। স্বপ্নের সাথে বাস্তবের এই বিবাদ আজীবন থেকেই চলে আসছে যা অশ্বিকার করার কোন উপায় নেই। আকাশের তারা দেখে আমরা কত ধরনের আশা পোষন করে থাকি। “আহারে যদি ঐ তারার দেশে যেতে পারতাম” সত্য কিন্তু অন্য কথা বলে। তারার বুকে বাস করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় কারন তারাকে মানুষের বাসযোগ্য করে সৃষ্টি করা হয় নি।এত কিছু জানার পরও তারার দেশে যাবার আকাঙ্ক্ষা থেকেই যায়। তার একটি মাত্র কারন আর তা হলোঃ যাহা লাগালের বাহিরে তাহা নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার একান্ত চেষ্টা আর এরই নাম হল স্বপ্ন।
আমরা যারা প্রবাসী সবার মনে এই তারার দেশের সুন্দর একটা স্বপ্ন ছিল ভাগ্যক্রমে এই তারার দেশের স্বপ্ন সত্য হলো। তবে যেভাবে স্বপ্নকে সাজিয়ে অপেক্ষমান ছিলাম ঠিক সেভাবে স্বপ্ন ধরা দেয় নি। অনেকটা সবুজ রঙের বিষের মতো। বিষের রঙ দেখতে খুবই সুন্দর তবে পান করে প্রান বাঁচনো যায় না, হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলে হাত পোড়ে যায়। স্বপ্ন সব সময় বাস্তব থেকে একটু দূরে থেকেই যায়।
মানুষ যখন কাংখীত জীবনের স্বপ্ন দেখে তখন বেহিসেবী স্বপ্ন সাজাতে এতোটকু কার্পন্য করে না।স্বপ্নের পর স্বপ্ন সাজিয়েছি, বাড়ী হবে গাড়ী হবে জায়গা জমি কাঁচা টাকা সহ পরিপুর্ন সুখী হবার জন্য যতকিছু প্রয়োজন সব। ভূ্ল করেও মা মাটির বিরহের কথা মনে আসে নি। জীবনে যাহা বাস্তব হয় নি অনুমান করে তা বুঝে নেয়া সহজ বিষয় ছিল না। আমরা শুধু সুখটাকে হিসেব করেছি দুঃখটাকে হিসেব করি নি কারন অজানা ভূবনের সাথে আমাদের কোন পরিচয় ছিল না।
প্রবাসের মাটিতে পা দিতেই শুরু হয়ে যায় মা মাটির বিরহ, স্বজনের বিরহ যা স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি। মনে হতো প্রবাসে যাবো আর দুহাত ভরে টাকা রোজগার করবো, অবস্থার পরিবর্তন হবে জীবনে আর কোন স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা অপুরন থাকবে না। মাত্র কিছু দিনের ব্যা্বধানে চোখের জল শুন্য হতে শুরু করলো অন্তরের চারপাশে নতুন যন্ত্রনার জন্ম হলো। শত সুখ শত স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেখেও আমাদের অশান্ত মন শান্ত হয় না। ফেলে আসা কুঁড়ে ঘরের কথা বার বার মনে পড়ে। মায়ের হাসি কান্না সন্তানের বাবা ডাক শুনার জন্য প্রান হু হু করে বেলায় অবেলায় কেঁদে কেঁদে মরে। এই বিরহের কান্না থেকে আমাদের এক মূহুর্তের জন্য মুক্তি নেই। প্রবাসীর বুকে এই কষ্ট সব চেয়ে বেশী জায়গা দখল করে বসে আছে।অথচ আমাদের বুকের এই যন্ত্রনাকে দেশের মানুষ বড় করে দেখে না এমনকি কেউ জানতেও চায় না।
বাস্তব সব সময় একটু তেতো হয়ে থাকে,তবুও আমাদের এই ভাগ্য অন্নেষনের দৌড় ঝাঁপ চলতেই আছে এবং চলবে।
প্রবাসীর ক্রন্দন 2
প্রবাসীদের সম্পর্কে দেশের মানুষের ধারনা অন্য রকম, অনেকটা রূপকথার কাহিনীর মত। কোন এক সময় আমিও ঐ রূপকথায় বিশ্বাসী ছিলাম তাই সহজেই অনুমান করতে পারি।
একটানা ১৫ বছর দেশে যাবার সুযোগ হয় নি অনেক চেষ্টা ও তদবির করার পর দেশের মাটিতে যাবার সৌভাগ্য হয় এবং অনেক অজানা সত্য ও তথ্য জানতে পারি যা অনেক সময় কষ্টের কারন হয়।আবার কখনও হাসির খোরাক।
প্রবাসী বলতে একটা সুখী মানুষকে ইঙ্গিত করা হয়। যাদের নেই কোন অভাব।
পকেট ভর্তি টাকা আর না চাইতে হাজার সুখের ফুলঝুরি আমাদের চারপাশে চরকার মত ঘোরতে থাকে। চাহিবা মাত্র সবকিছু আমাদের সামনে এসে হাজির।
এই কথা গুলো যখন সবাই বলাবলি করে আমি একা একাই হাসতে বাধ্য হই। না হেসে কি উপায় আছে? প্রবাসের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর এই কথা যখন কানে আসে তখন নিজেকে নিয়েই হাসি। সত্য কথা গুলো বলতে ইচ্ছে হয় কিন্তু বলা হয় না কারন আমার এই বস্তা পঁচা কথা কেউ শুনবে না তা আমি ভালো করেই জানি। ভূ্ল করে যদি কারো কাছে প্রকাশ করা হয় তখন আমাদেরকে নিয়ে অন্য কথা বলা হয়, রহস্যময় চোখ দিয়ে আমাদেরকে বার বার পরখ করা হয়।
দেশের মানুষের বিশ্বাস আমরা মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছি, ফাঁকি দেবার জন্য কাহিনী রচনা আর কি। দেশের মানুষের ধারনার সাথে আমাদের কোন মিল নেই যা আমার মতো প্রবাসীরা এক বাক্যে স্বীকার করবেন। দেশের অধিকাংশ মানুষ আমাদেরকে স্বার্থ্পর হিসাবেই জানে। আমরা নাকি আমাদেরকে নিয়েই ব্যাস্ত। আমরা যদি সত্যি সত্যি স্বার্থ্পর হই তাহলে কেন বার বার দেশের মাটিতে ফিরে যাই? কেন আমাদের চোখের জল শুকায় না?
কেন সবকিছু ভূ্লে প্রবাসে পড়ে থাকি? আমাদেরকে বলা হয় স্বার্থ্পর! হায়রে মানুষ একি হলো তোমাদের? কেন এত বড় অপবাদ দাও? লক্ষ লক্ষ প্রবাসীরা যদি স্বার্থ্পর হতো তাহলে এই বাংলার অন্য এক রূপধারন করতো।
বিশ্বে্র বুকে মাথা উঁচু করে দাড়াবার মতো সুযোগ হতো না। আমাদের বদান্যতায় আমাদের সাহায্য সহযোগীতায় এই সোনার বাংলা স্বদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যার প্রমান বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যমান। আমাদের কষ্টার্জিত এক একটি পয়সা দেশের মানুষের সুখের পিছনে ব্যা্য হচ্ছে তা কি কেউ অশ্বিকার করতে পারবে?
এই বাস্তব সত্য বেশীর ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে না। না জেনে না বুঝে আমাদেরকে দোষ দেয়া হয়, আমাদেরকে ভূ্ল বুঝে অপবাদ দেয়া হয়, আঘাত করা হয়। যাদের মঙ্গল কামনায় আমাদের আমাদের শরীরের রক্ত ঘাম হয়ে ঝরে পড়ে ওরা যখন বলে প্রবাসীরা স্বার্থ্পর এই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা থাকে না। এই কষ্ট প্রবাসীরা না পারে সইতে না পারে প্রকাশীতে নিশিদিন অন্তরে অন্তরে কেঁদে নিজেই নিজেকে শান্ত্বনা দিতে হয়।
আমাদের সম্পর্কে যা বলা হয় বাস্তবের সাথে মিল রেখে বলা হয় না তাই কষ্ট হয়। আমাদের কষ্ট হয় কি না হয় তাতে কেরো কিছু যায় আসেনা। লক্ষ লক্ষ প্রবাসীদের প্রতি দেশের মানুষের ভূল ধারনাকে প্রমান করার জন্য লিখতে বসি নি। আমাদের বুকের যন্ত্রনার সাথে সবাইকে পরিচিত করে দেয়ার জন্য চেষ্টা করবো। আমরা তো আপনাদেরই একজন আমাদের বুকের যন্ত্রনা হাহাকার আপনাদেকে ছোঁয়ে যায় না? একবারও কি মনে হয় না এই মানুষ গুলো আপনাদের আপনজন?
আমাদের কি ইচ্ছা হয় না আপনাদের মতো দেশের মাটিতে বসবাস করি, সবার সাথে হাসি কাঁদি, মা মাটির আলো বাতাসে বেড়ে উঠি, মায়ের কোলে মাথা রেখে সস্থির নিঃশ্বাস নেই? আমাদেরও ইচ্ছে হয় দেশের মাটিতে খেয়ে না খেয়ে পড়ে থাকি, মা মাটির বিরহে আমাদেরও বুক ফাটে হু হু করে হাহাকার যন্ত্রনা সারাদিন অগ্নিগিরির মত জ্বলতে থাকে। প্রান চায় সব কিছু পিছনে ফেলে রেখে দেশের মাটিতে পড়ে থাকি যেখানে কেটেছে আমাদের শৈশব কৈশর, যে মাটিতে ঘুমিয়ে আছে আমাদের রক্ত বাঁধনের অপনজন কিন্তু পারি না।
আপনাদের মুখে হাসি ফোটাবার দায়িত্ব যে নিয়েছি তাই নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই।আমাদের চাওয়া পাওয়ার কোন মুল্য নেই। আমাদের জীবন আমাদের জন্য নয়, দেশের মানুষের জন্য
স্বার্থপরের মত এই সুখ ভোগ করতে পারি নি বলেই আজ আমাদেরকে বলা হয় স্বার্থ্পর। আঁড়চোখে দেখা হয় আঘাত করা হয়, চপেটাঘাত করা হয় ভালোবাসার নিষ্পাপ চেহারায়।
কষ্ট প্রকাশ করা ও এক মহাকষ্ট, এই কথা গুলো লিখতে গিয়ে বুকের মাঝে চিন চিন করে একটা ব্যাথা অনুভব করছি। দুটি চোখ ঝাপসা হয় আসে। হউক যত যন্ত্রনা, অঝোর ধারায় ঝরে পড়ূক লবনাক্ত বিষের জল তবুও আমাকে লিখতে হবে, প্রবাসীর কান্না পৃথিবীর ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তুলে শুনাতে হবে। ভূ্ল ধারনা ভাঙ্গাতে হবে নইলে বিবেকের কাছে আমি দায়বদ্ধ থেকে যাবো। প্রবাসীরা কষ্টের কথা সহজে প্রকাশ করে না।
আমি প্রবাসীর পক্ষ হয়ে লিখছি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোটি কোটি বাংলাভাষী প্রবাসীর হয়ে লিখছি।
যাদের যন্ত্রনা প্রকাশের ভাষা নেই আমি তাদের হয়ে লিখছি।
আমাদের প্রতিদিনের কষ্ট, প্রতি ক্ষন মূহুর্তে ঝরে পড়া আমাদের এক এক ফোটা নয়ন জলের হিসাব জানুক এই পৃথিবীর মানুষ, একটু সহানুভূতির স্ব্রে বলুক “হে প্রবাসী ভাই বোন তোমাদের কষ্ট আমাদের বুকে বাজে, তোমাদের ত্যাগ তোমাদের ঋন শোধ হবার নয়”
প্রবাসীর ক্রন্দন 3
প্রবাসীর বুকে কষ্টের আগুন বিরহের আগুন,এই কষ্টের অসহ্য যন্ত্রনা প্রবাসী ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।আমাদের প্রতিদিনের কষ্ট কাহিনী অনেকেই জানে না, বেশীর ভাগ সময় আমরা নিজেই প্রকাশ করতে সাচ্ছন্দ বোধ করি না কারন কষ্টের কথা যন্ত্রনার কথা প্রকাশ করাও এক ধরনের কষ্ট।
আমাদের বুকের যন্ত্রনা প্রতিটি ক্ষন মূহুর্তে অন্তরে অন্তরে অবলীলায় আমাদেরকে কাঁদিয়ে যায়। আমাদের চোখের জল চোখেই শুকায়, কেউ আদর করে মুছে দেয় না। বেঁচে থাকার জন্য, ভালো থাকার অভিনয় করে নিজেই নিজের সাথে ছলনা করি। দেশের পরিবার পরিজন যাহাতে ভালো থাকতে পারে এই চিন্তা মাথায় রেখেই আমাদেরকে অভিনয় করে হলেও সুখী মানুষের মত অভিনয় করতে হয়। একজন প্রবাসী আরো একজন প্রবাসীর সাথে যেভাবে জীবনের দুঃখ যন্ত্রনা ভাগাভাগি করে আপন পরিবার পরিজনের সাথে এই ভাবে প্রান খোলে কথা বলতে পারে না। কারন মাত্র একটা “পিছনে রেখে আসা মানুষ গুলো সুখে থাকুক আমাদের কষ্ট যেন ওদেরকে স্পর্শ করতে না পারে” দেশের মানুষ শুধুই আমাদের সুন্দর সাস্থ্য আর হাসি মাখটাই দেখে, তাই আসল সত্যটা হাসি আর চোখে দেখা সুখের আবরনে ঢাকা পড়ে যায়।আর এক ধরনের ভূ্ল ধারনা বদ্ধমূ্ল হয়। প্রবাসের বাস্তব চিত্র আমি যেভাবে দেখেছি তার সাথে দেশের মানুষের অনেক দ্বিমত থাকতে পারে, তবে যা দেখেছি তা কাগজ কলমের সাহায্যে আপনাদের কাছে প্রকাশ করার চেষ্টা করবো। তির্থের কাকের মত আশায় চেয়ে থাকা প্রবাসী জীবনের এক একটি দিন যা কাউকে সহজে বুঝাতে পারি না।
প্রবাসে টাকা আছে তবে সুখ যে নেই তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সবার ধারনা প্রবাস মানেই হলো সুখ আর সুখ। বাস্তব সত্য হলো আমরা নামে মাত্র শুধু বেঁচে থাকি তবে বেঁচে থাকার স্বাদ আমাদের ভাগ্যে নেই। ভালোবাসাহীন জীবন নিয়ে বুক ভরা কষ্টের পাহাড় নিয়ে সুখের আশে পাশেও যাবার ভাগ্য হয় না আমাদের। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা বেঁচে নেই যাকে বলে জিন্দা লাশ।
আমরা প্রবাসীরাও এক একটা জিন্দা লাশ। যে সুখের আশায় রক্ত বাঁধনের মানুষ গুলোকে পিছনে রেখে একদূর পথ পাড়ী দিলাম কিন্তু সুখের মুখ দেখা হলো না। বুক ভরা শুন্যতার শুন্যস্থান সঠিক ভাবে পুর্ণ হলোনা। কষ্ট আর হাহাকার বুকে নিয়ে সুখের আশায় বৃথা এই দৌড় ঝাঁপ দিতে দিতেই আমাদের জীবনে প্রদীপ নিভে যায়। (প্রবাসে কিছু মানুষ আছে যারা আমাদের মত অসুখী নয়, তাদের টাকা পয়সা সবই আছে তবে ওরা সংখ্যায় খুবই কম ওদের কথা আলাদা।
আবার এই সুখী মানুষের অসুখের কাহিনীরও শেষ নেই) টাকা পয়সা সব সময় অসুখীর মূল বষ্য নয়। জীবনে টাকার প্রয়োজন তা আমি অস্বীকার করবো না, জীবনে টাকার প্রয়োজন আছে, জীবনকে সুন্দর ভাবে সাজাতে হলে টাকা অগ্রনী ভূমিকা পালন করে থাকে। টাকা যে আবার সব সমস্যার সমাধান তাও স্বীকার করবো না। যেখানে মানুষের প্রয়োজন সেখানে টাকা একেবারে অর্থহীন হয়ে যায়। জীবনে সুখী হবার জন্য হিসাবের কিছু বিষয় আছে আমাদের জ়িবনে প্রতিফলিত না হলে আমরা সুখের মুখ দেখতে পাই না। প্রবাসীরা কোন সময় পরিপূর্ন সুখী হবার স্বপ্ন দেখে না।
আমাদের চাহিদা একেবারে সিমীত, পরিবার পরিজন নিয়ে এক চিলতে হাসি ভাগাভাগি করে একই ছাদের নিচে হাতে হাত ধরে বসবাস করা। সুখে দুঃখে ভালোবাসার মানুষের বুকে মাথা রেখে আগামীদিনের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজ আমরা প্রবাসী, হিসাবের সুখটুকু আমাদের ভাগে আর পড়ে না। কাংগালের মত মানুষের সুখ দেখে দেখেই বেঁচে থাকতে হয়, চোখের জলে বুক ভাসাতে হয় দিনের পর দিন রাতের পর রাত। অনিশ্চয়্তার মাঝে কেটে যায় আমাদের জীবনের এক একটি দিন রাত বড়ো অবহেলায় বড় অনাদরে। বুকের মাঝে সমাহীত কষ্ট গুলো বুকের মাঝেই কেঁদে কেঁদে মরে। আমাদের চারপাশে শান্তনা দেবার কেউ নেই, আমাদের মা নেই ভাই বোন কেউ নেই যার সাথে এক দুঃখ কষ্টের কথা বলবো।
সারাদিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে যখন শুন্য চার দেয়ালের মধ্যে রাত পোহাতে হয় তখন শুরু হয় কাংখীত জীবনের চুলছেড়া হিসাব কিতাব। যোগ বিয়োগের হিসাব আর মিলে না, বড় ধরনের গড়মিল দেখা দেয়, হাহাকার ভরা অশান্ত মন হু হু করে কেঁদে উঠে গন্ড বেয়ে যন্ত্রনার বিষাক্ত জল ঝরতে থাকে। যন্ত্রনা ভূ্লে থাকার এই সহজ উপায় প্রতিটি প্রবাসী ভাই বোন বেশ ভালো করে রপ্ত করেছেন যা অনেকেই জানে না
প্রবাসীর ক্রন্দন 4
বুক ভরা অগনিত না বলা চাপা কষ্ট মিথ্যা হাসি দিয়ে ঢেকে রাখি আমরা প্রবাসীরা। এক একটি ক্ষন মূহুর্ত আমরা নিজের সাথে ছলনা করেই বেঁচে থাকি যাহা আমার মত লক্ষ লক্ষ প্রবাসী এক বাক্যে মেনে নিতে দ্বিমত থাকার কথা নয়। যারা আমার মত প্রবাসের স্বরূপ দেখেছেন শুধু ওরাই আমার কথার সত্যতা স্বীকার করবেন।
কল্পনা আর বাস্তবের মাঝে কত যে ব্যাবধান তা ভূক্তভোগী ছাড়া আর কেহ অনুমান করা সম্ভব নয়। প্রবাস বলতে আমরা শুধু কষ্টকে বুঝি। প্রবাস বলতে আশা আকাঙ্ক্ষার মৃত্যকে বুঝি। প্রবাস বলতে এক মহা সমুদ্র সমান যন্ত্রনেকে বুঝি। প্রবাস বলতে নতুন এক অজানা পৃথিবীকে বুঝি যেখানে মা নেই বাবা নেই স্ত্রী নেই সন্তান নেই। আছে শুধু হাহাকার আর না পাওয়ার অসংখ্য লাল কালো কষ্ট। আমাদের কষ্টের কোন সীমা পরিসীমা নেই।যেদিকে দুচোখ যায় অশান্তি আর নিরাশাই দেখতে পাই।
দেশে বিদেশে আমরা বিভিন্ন ভাবে কষ্টের সাথে পরিচিত হই। রক্তের টানে নাড়ীর টানে প্রবাসীরা যখন দেশের মাটিতে পা রাখে, আমাদেরকে বলা হয় “তোমরা বৃটিশ” কেউ কেউ হেসে হেসেই এই কথা গুলো বলতে থাকেন, আবার অনেকেই আছেন এই কথা গুলো শুনার পর গর্ব অনুভব করেন, মুচকি হাসেন। তবে আমার কষ্ট হয়, অনেক কষ্ট হয়। এই দেশ আমার এই দেশের আলো বাতাস আমার একান্ত আমার। প্রয়োজনের তাগিদে আমি প্রবাসী, আমি এই দেশের এই বাংলা মায়ের সন্তান। আমার একটি মাত্র পরিচয় আমি বাংলাদেশী। আমার আর কোন পরিচয় নেই, আমি আর কেউ নই আমি সব সময় বাঙ্গালী।
আমার রক্ত মাংসে চলবে বলনে আমি বাঙ্গালীত্ব ধরে রেখেছি। আমাদেরকে কেন বৃটিশ বলে খোঁচা দেয়া হয়? কেন বাঙ্গালী বলে মেনে নিতে পারে না আমার দেশের অপন মানুষ গুলো? আমরা যখন দেশের প্রতি ভালোবাসার কথা প্রকাশ করি, তাচ্ছিল্যের স্বরে অনেকেই বলে থাকেন “দেশের প্রতি যাদের প্রেম আছে ভালোবাসা আছে তারা দেশ ছেড়ে কোনদিন পালাবে না” তাই আমার আরো বেশী কষ্ট হয়। কথায় আছে যার জন্য চুরি করি সে বলে চুরা। এই ধরনের কথার উত্তর যে কতবার দিয়েছি তার কোন হিসাব নেই। দেশের বাইরে আসার পরেই সত্যিকারের দেশ প্রেম জন্ম নেয়। দেশে থাকলে দেশ সেবার সুযোগ বেশী তাতে আমার দ্বিমত নেই; তবে বিদেশে থেকে দেশ সেবা করা যায়না, দেশ প্রেম জন্ম নেয় না এটা ভুল ধারনা। তাৎক্ষনিক ভাবেও এই প্রবাসীরা অনেক কিছুই করতে পারে যার প্রমান আমরা বারবার দিয়েছি। প্রবাসীর ঋন অস্বী্কার করার কোন উপায় নেই।
একটা উদাহরন দিয়ে বলা যায়। আপনি যদি একটা ঘরের ভিতরে সারাজীবন বন্ধী থেকে যান তাহলে কি আপনি ঘরটির প্রকৃত স্বরূপ বোঝতে পারবেন? তা বোঝতে হলে আপনাকে ঘরের বাইরে এসে দূর থেকে দেখতে হবে। এটা মনে হয় দেশের বেলায়ও সম্পুর্ণ না হলেও কিছুটা মাত্রায় সত্য। তাই দেখা যায় দেশের বাইরে গেলে সবার মধ্যে হটাৎ করে দেশ-মাতৃকার জন্য একটা প্রচন্ড ভালোলাগার জন্ম নেয়, কাছে থেকেও যাকে তেমন করে অনুভব করা হয়নি কোনোদিন। তাকেই বড়ো বেশি করে মিস করা শুরু করে সবাই। তাই প্রবাসীরা অতিমাত্রায় হটাৎ করে স্বদেশপ্রেমী হয়ে উঠে, তারা নিয়মিত প্রবাসজীবনে উদযাপন করতে চায় স্বদেশীয়ানাকে। দেশ সেবায় প্রবাসীরা পিছিয়ে নেই। দেশে থেকে দেশ সেবার সুযোগ থাকলেও ক’জন দেশ সেবা করছে? প্রতিদিন দেশের জন্য আমরা ক’টা কাজ করি? যারা দেশকে ভালবাসে তারা বিদেশে থেকেও দেশ প্রেমকে জিইয়ে রাখতে পারে।
বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শ্রমিক বিদেশ থেকে দেশের রেমিটেন্স বাড়াচ্ছে তা সম্পর্কেক কজন অবগত? সেটা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে কি প্রভাব ফেলছে তা কি দেশের মানুষ জানেন না? যে ছেলেটার তেমন শিক্ষা নেই, সে তার শ্রম দিয়ে দেশের জন্য তার পরিবারের জন্য যে অবদান রাখছে তাতে তাদের প্রতি কজন শ্রদ্ধায় অবনত হয়। সে কি খুব সুখে আছে? বাবা মা ভাই বোন বন্ধু আত্মীয় পরিনজকে ছেড়ে এত দূর দেশে তার কি কষ্ট হয়না? শ্রমিকদের কথা বাদ দিলাম। এবার আসি মেধাবীদের কথায়।পশ্চিমা দেশ গুলো তাদের স্কলারশিপ দিয়ে নিয়ে আসছে আমার দেশের মেধাবী ছাত্র ছাত্রী। তাদের দেশের উন্নতি হচ্ছে ঠিক কিন্তু তাতেও কি আমার দেশ কিছু পাচ্ছে না? যে কোন ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের কথা যদি বলি; সবাই দেশের বাইরের কোন ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে আমাদের শিক্ষায় বিশাল অবদান রেখে যাচ্ছেন। বিদেশে একটা এক্সপেরিমেন্টে যে খরচ করা হয় তা আমার দেশের সাধ্যের বাইরে।
এখানে সারা পৃথিবীর যে কোন রাইটারের ব্ই পড়তে পারছি। সেটা কি দেশে থেকে সম্ভব হত? তাহলে কি যে এক্সপেরিয়েন্স হচ্ছে তা থিওরেটিকাল এন্ড প্রাকটিক্যাল নলেজ বাড়াতে সুবিশেষ ভুমিকা রাখছে না? প্রবাসীদের এক্সপেরিয়েন্স দেশের সরকার কি কাজে লাগিয়ে দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে না? এই প্রবাসীর অবদান আছে বলেই আজ বাংলাদেশ মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রবাসীদের প্রতি দেশের মানুষের অনেক ভুল ধারনা আছে যাহা আমি সহজে মেনে নিতে পারি না আমার কষ্ট হয়। দেশ প্রেম বলতে কি বুঝায়? কাজ কর্মহীন বেকার জীবন নিয়ে ধুকে ধুকে মরে যাওযার নাম কি দেশ প্রেম? শুধু কি লাল সবুজের পতাকা নিয়ে জয় ব্বাংলা জয় বাংলা শ্লোগান দেয়ার নাম দেশ প্রেম?দেশকে ভালোবাসি বললে তো আর হবে না! ভালোবাসার প্রমান দিতে হবে যাহা আমরা প্রবাসীরা প্রতিদিন প্রমান দিয়ে যাচ্ছি। দেশে বাস করার নাম দেশ প্রেম নয় আর যদি তাই হয়ে থাকে আমি তা বিশ্বাস করি না। গত চল্লিশ বছরে যে চিত্র আমরা দেখেছি তা যদি বিচার করি তাহলে কি দেখি? হাতেগুনা কিছু মানুষ ছাড়া বাকি সবাই শুধু নামে মাত্র বাংলাদেশী, দেশ প্রেমিক নয়। দেশ প্রেমের স্বরূপ দেখতে হলে একজন প্রবাসীকে দেখুন। প্রবাসীরা হলো দেশ প্রেমের জলন্ত প্রমান
প্রবাসীর ক্রন্দন 5
আমার যতদুর মনে পড়ে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলার দামাল ছেলেরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়ার যে গুরুদায়িত্ব স্কন্ধে নিয়েছিল তারই ফলশ্রুতিতে ভাই ভাইকে, পিতা সন্তানকে, আত্মীয় আত্মীয়কে এবং বিশ্বস্ত পড়শী পড়শীকে এনওসি জোগাড় করে সম্পূর্ণ নিজেদের প্রচেষ্টায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাকরী জোগার করে দিতে লাগল।
এসব ক্ষেত্রে সরকারের কোনো সাহায্য সহযোগীতা ও সহানুভূতি ছিল না।
দেশকে সমৃদ্ধশালী করার জন্য প্রবাসীরা সব সময় অগ্রনী ভূমিকা পালন করে আসছে ।
আমাদের নিম্নবিত্ত ও প্রান্তজনের ছেলেরা মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাকরী করে মাতৃভুমিতে কাড়ি কাড়ি টাকা পাঠাচ্ছে পৃথিবীর মানুষ আশ্চর্য হয়ে যায় বাঙালী সন্তানদের ধৈর্য ও সহনশীলতা দেখে। এতো অত্যাচার, জুলুম প্রতারনা ভোগান্তির স্বীকারের পরেও তারা প্রবাসে যাবেই। নানান অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও নির্যাতনের স্বীকার হয়েও বাঙালী সন্তানেরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে তাদের রক্ত জল করা পয়সা দেশে পাঠাচ্ছে ও এদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল করে রেখেছে। বর্তমানে প্রায় এক কোটির উপর বাঙালী প্রবাসে আছে এবং তাদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ দেশের সর্বমোট প্রবৃদ্ধিও ৩০% এবং সত্যি বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা সোনার ছেলে হয়ে এদেশে মুঠো মুঠো সোনা পাঠাচ্ছে।
আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা শুধু যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রক্তশূন্যতাকে দূর করছে তা নয়, আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণঘাতি সমস্যায় নিজেদের অজান্তেই বিরাট অবদান রেখে যাচ্ছেন, যার আর্থিক হিসাব-পরিসংখ্যান শুনলে পিলে চমকে উঠবে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীরা কর্মস্থলে নানান সরকারী বিধিনিষেধ ও নিজেদের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে পরিবার পরিজন নিয়ে একসঙ্গে থাকার সুযোগ পায় না। আর যারা এসব সমস্যা মোকাবেলা করে প্রবাসে পরিবার নিয়ে থাকেন তাদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য ৫%। বাকী ৯৫% পরিবার দেশেই থাকে। প্রবাসীরা অর্থ বাঁচাবার জন্য কয়েক বছর পর পর স্বদেশে আসেন। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নিয়মিত বিচ্ছিন্নতার কারণে প্রতি বছর লক্ষাধিক অনাকাঙ্খীত শিশুর আগমন বন্ধ থাকে। এতে করে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে পিষ্ট বাংলাদেশ কোনো রকম জন্মনিরোধক সেবাপ্রদান ছাড়াই এক লক্ষ birth abort করতে সমর্থ হয়। একটি রক্ষণশীল হিসেবে দেখা যায়, একটি জন্ম নিরোধ করতে পারলে পরিবার ও সরকারের সতেরো লক্ষ টাকা সাশ্রয় হয়। এখন ভেবে দেখুন একটি birth abort-এ যদি সতেরো লক্ষ টাকা সাশ্রয় হয় তাহলে এক লক্ষ birth abort করলে সাশ্রয় হয় এক লক্ষ সত্তর হাজার কোটি টাকা যা বাংলাদেশের দুই বৎসরের বাজেটের সমান। প্রবাসীদের এই কৃতিত্ব অর্জনের জন্য শুধু সাধুবাদ দেওয়াই কি যথেষ্ট? তাদের প্রেরিত রেমিটেন্সের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনার এই ব্যয় সাশ্রয় যোগ করলে বছরে দাঁড়ায় তিন লক্ষ হাজার কোটি টাকা যা কিনা বিগত এক যুগে বিশ্বের বিভিন্ন অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান, দাতা দেশের দান-অনুদান ও ঋণের সমপরিমাণ অর্থ গ্রহণের সমান। সুতরাং বলতে দ্বিধা নেই, বর্তমানে বাংলাদেশের যেটুকু প্রবৃদ্ধি ও আর্থক স্বচ্ছলতা তা একান্তই বাংলাদেশের প্রবাসী ভাইদের অবদান। এখন আমাদের সরকারের উচিৎ প্রবাসীদের কল্যাণে ও তাদেরকে এদেশের ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে যথাযথ মূল্যায়ন করা। অথচ আমরা প্রবাসীরা হিসাবের ধন্যবাদটুকু পাই না।
সরকারী হিসাব মতে বর্তমান প্রবাসীর সংখ্যা ৮০ লাখ এর মত। এটা সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক। কেননা সরকারি পরিসংখ্যান কোনোদিন সত্য প্রকাশ করে না। আমাদের হিসাব মতে কম করে হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের এক কোটির উপর মানুষ প্রবাসে আছেন। এদের পাঠানো গত দশ বছরের গড় রেমিটেন্সের পরিমাণ মাসে সত্তর কোটি এবং বছরে আটশত চল্লিশ কোটি ডলার। যার অর্থ বাংলাদেশী মুদ্রায় পঞ্চাশ হাজার চারশ কোটি।
এই লিখা থেকে কি বুঝা যায় না যে প্রবাসীদের দান অতুলনীয়? দেশ প্রেমের সংজ্ঞা প্রবাসীদেরকে বুঝাতে হবে না। দেশকে সমৃদ্ধি করার জন্য প্রবাসীরা সব স্বার্থ ত্যাগ করে পড়ে থাকে অজানা অচেনা দেশে বছরের পর বছর যুগের পর যুগ। আমাদের অনুদান দেশের মানুষ যদিও ভুলে যায় তবে ইতিহাস আমাদেরকে ভুলবে না, ইতিহাসের পাতায় প্রবাসীদের নাম স্বর্নাক্ষরে লিখা থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আমাদের এক এক ফোটা চোখের জল শুধুই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য প্রবাহিত হয়ে থাকে। আমাদের বেদনা বিঁধুর চেহারায় যদি এক চিলতে হাসি ফুটে থাকে তাও দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য।
দেশ প্রেম বলতে কি বুঝায় তা প্রবাসী ছাড়া সহজে কেউ উপলব্দি করতে পারবে না।
দেশের প্রতি প্রবাসীদের ভালবাসার আরো একটি প্রমান,
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার নারিকেলতলা গ্রামের বাসিন্দাদের উপজেলা সদরে যাতায়াতের জন্য কিছুদিন আগেও ভালো কোনো রাস্তা ছিল না। স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের সাঁকো পার হয়ে স্কুলে যেতে হতো। গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে নৌকা লাগত।
গ্রামবাসীর এমন দুর্ভোগের চিত্র দেখে আহত হন যুক্তরাজ্য প্রবাসী রিজিয়া চৌধুরী। ২০০৬ সালে দেশে আসেন তিনি। সেই থেকে গ্রামবাসীর কল্যাণে কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করেন।
রিজিয়া চৌধুরীর একার চেষ্টায় নির্মিত রাস্তা দিয়ে গ্রামের লোকজন এখন উপজেলা সদরে যাতায়াত করে। ছেলেমেয়েরা সাঁকোর বদলে সেতু দিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি শতভাগ স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে গ্রামে একাধিক নলকুপ স্থাপন করেছেন তিনি।
রিজিয়া চৌধুরী ছোটবেলায় যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেখানে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ২০০৬ সালে সেখানকার রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন।
আশরাফুর রহমান বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে আমরা প্রতিশ্রুতির বাণী শুনেছি। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। রিজিয়া চৌধুরীর বদৌলতে দুই বছরে তিনটি কাঁচা সড়ক, দুটি সেতু নির্মিত হয়েছে। গ্রামে শতভাগ স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার নিশ্চিত হয়েছে। এর পরও কি বলবেন প্রবাসীর বুকে দেশ প্রেম নেই!!!
প্রবাসীর ক্রন্দন 6
প্রবাসীর কষ্টের কথা বলতে গিয়ে অনেক কথা বলেছি কারন আমি দেশ বাসীকে আমাদের আত্মত্যাগের স্বরূপ পরিস্কা্র ভাবে তুলে ধরতে চাই। আমাদের দেশ প্রেমের সাথে কোন কিছুর তুলনা হয় না।আমরা দিনের পর দিন বাঁচা মরার লড়াই করে দেশকে উজ্জ্বল ভবিষ্যেতের দিকে নিয়ে যাচ্ছি কিন্তু দুর্ভাগা প্রবাসীর এই প্রতিদান কেউ ভূল করেও মূল্যায়ন করে না।
প্রবাসীরা দেশের মানুষকে আলোদিতে দিতে এক সময় নিভে যায়, হারিয়ে যায় চিরদিনের মত তাদের হিসাব কেউ রাখে না। আবহেলায় অনাদরে মত প্রান ঝরে তার একটা হিসাব কিছুদিন আগে প্রথম আলো ব্লগে পড়েছিলাম। আপনাদের সুবিধার্তে তা সংযোজন করে দিলাম।
দেশে রেমিটেন্স (প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো অর্থ) প্রবাহ নাকি মে মাসে সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এককভাবে কোনো মাসে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৮৯ কোটি ৫ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছে মে মাসে। ধারণা করা হচ্ছে, এ প্রবাহ অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে রেমিটেন্সের পরিমাণ ৯০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। জীবনযাত্রা সচল রাখতে ডলারের এ প্রবাহ বাংলাদেশের জন্য বিরাট এক ভরসাস্থল। তাই শাসকদের জন্য এ ঘটনা খুবই স্বস্তিদায়ক। কিন্তু এ ডলারের বেদিমূলে প্রতিনিয়ত নিঃশব্দে কত প্রবাসী শ্রমিকের জীবন বলি হচ্ছে তার কি কোনো খোঁজ আছে? অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এ সংখ্যাটা দুই-দশ নয়, এমনকি শতকের ঘরেও নয়, সহস্রের কোটা ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ, রেমিটেন্সের পরিমাণের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রবাসী শ্রমিকের লাশের সংখ্যা।
প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স নিয়ে যত উচ্ছ্বাস, বিদেশে যেনতেনভাবে শ্রমিক পাঠানোর ব্যাপারে যত তৎপরতা লক্ষ করা যায় – প্রবাসে তাদের কাজ ও জীবনের নিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তা নিয়ে কি সরকার কি অন্য কারো সে অনুপাতে কোনো উদ্বেগ বা তৎপরতা আছে বলে মনে হয় না। যদি তাই হতো তাহলে গত কয়েক বছর ধরে এভাবে প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যুর হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ত না।
গত ৫ বছরে বিদেশ-বিভূঁইয়ে নিহত প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ৮ হাজারেরও বেশি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের ৯ তারিখ পর্যন্ত ৪ মাস ৯ দিনে ৯০৪ জন প্রবাসী শ্রমিকের লাশ দেশে পৌঁছেছে। শুধু মে মাসের প্রথম ৮ দিনেই এসেছে ৬৪ জনের লাশ, যার মধ্যে ৩২ জন নারী শ্রমিক। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৮ জন করে শ্রমিকের লাশ এসেছে। এই ৯০৪ জন শ্রমিকের মধ্যে ৩৯১ জন মৃত্যুবরণ করেছে হৃদরোগে (কার্ডিয়াক এ্যরেস্ট), কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৬৮ জনের, ৬২ জন সড়ক দুর্ঘটনায়, বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতায় মারা গেছে ১১৫ জন।
এখানে আরো উল্লেখ করা দরকার যে শ্রমিক-মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। হৃদরোগে মৃত্যুবরণকারী ৩৯১ জনের ১১৯ জন মারা গেছে সৌদি আরবে, মালয়েশিয়ায় ৮২ জন, ৭২ জন সংযুক্ত আরব আমিরাতে, ৩৫ জন কুয়েতে, ওমানে ১৬ জন, কাতারে ১০ জন, বাহরাইনে ১০ জন, সিঙ্গাপুরে ৭ জন এবং লেবাননে ২ জন। (ডেইলি স্টার, ১৩ মে ২০০৯) দৈনিক সমকালে ৮ মে ‘০৯ তারিখে প্রকাশিত হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, তখন পর্যন্ত দেশে এসেছে ৮৮১ জন প্রবাসী শ্রমিকের লাশ। এদের ২৫৪ জন মারা গেছে সৌদি আরবে, মালয়েশিয়ায় ১৫৭ জন, দুবাই-তে ১০০ জন, কুয়েতে ৫৫ জন, ওমানে ৩৪ জন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৭ জন, আবুধাবি-তে ২৪ জন, কাতারে ২১ জন, বাহরাইনে ১৭ জন, যুক্তরাজ্যে ১৬ জন, ইতালি-তে ১৫ জন, দ: আফ্রিকায় ১১ জন, লেবাননে ৬ জন, পাকিস্তানে ৬ জন, গ্রিসে ৫ জন এবং অন্যান্য দেশে ৫২ জন।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ২০০৪ সালের পর থেকে প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিশেষত, ২০০৭ সালের তুলনায় ২০০৮ সালে সংখ্যাটা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৭ সালে যেখানে এ সংখ্যাটা ছিল ১ হাজার ৬শ’ ৭৩ জন, ২০০৮ সালে এসে সেটা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২শ ৩৭ জনে! ডেইলি স্টারের তথ্য মতে, ২০০৪ সালে মৃত্যুবরণকারী প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৭৮৮ জন, ২০০৫ সালে ১ হাজার ২শ’ ৪৮ জন এবং ২০০৬ সালে ১ হাজার ৪শ’ ২ জন।
মালয়েশিয়ার কারাগারে ও পুলিশী হেফাজতে গত ৬ বছরে মারা গেছে ১ হাজার ৩শ’ প্রবাসী শ্রমিক যার একটা বড় অংশ বাংলাদেশি। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় পুলিশ এদের গ্রেফতার করে জেলখানা বা থানা হাজতে আটকে রাখে। মালয়েশিয়ার মানবাধিকার সংস্থা সুহাকাম-এর মতে, এদের মৃত্যুর মূল কারণ সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়া। এ সংস্থা আটককৃত অবৈধ শ্রমিকদের চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করার জোর দাবি জানিয়ে বলেছে, কারাবন্দিদের চিকিৎসা সুবিধা না দেওয়াটা একটা অমানবিক কাজ, মানবাধিকারের লঙ্ঘন। পাশাপাশি পুলিশী নির্যাতনে বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যুসহ সকল মৃত্যুর স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে এ সংস্থা।
একেবারে খোলা চোখেই বোঝা যাচ্ছে, প্রবাসী শ্রমিকদের অবস্থা ভয়াবহ। একটা অত্যন্ত দুর্বিষহ অসহায় জীবন তারা যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। আসলে তাদের দুর্ভোগ শুরু হয় দেশের মাটি থেকেই। সরকার নির্ধারিত ফি’র তুলনায় আট/দশগুণ পর্যন্ত টাকা তাদের খরচ করতে হয়। এ খরচ যোগাড় করার জন্য অনেককেই ভিটেবাড়ি-জমি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়। কিন্তু এই ম্যানপাওয়ার বিজনেস বা আদম ব্যবসা বলে পরিচিতি সেক্টরটিতে প্রতারক এবং দালালদের এতটাই প্রাদুর্ভাব যে প্রতিবছর শত শত বিদেশ গমনেচ্ছু সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়, তাদের টাকা নিয়ে প্রতারকচক্র লাপাত্তা হয়ে যায়।
যারা কোনো ক্রমে বিদেশে যেতে পারেন, তখন শুরু হয় তাদের দ্বিতীয় দফা দুর্ভোগ। যে কাজের কথা বলে নেওয়া হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সে কাজে নিয়োগ পান না। যে পরিমাণ বেতনের কথা বলা হয়, সে বেতনও তারা পান না। সবচেয়ে অমানবিক, পরিশ্রমসাপেক্ষ, কষ্টকর কাজগুলো জোটে তাদের কপালে। সে তুলনায় বেতন নামমাত্র। কেউ কেউ মাসের পর মাস বেতনের মুখও দেখেন না। কারো কারো কপালে দুর্ভোগের পরিমাণ আরো বেশি থাকে। দেখা যায় তাদের কাগজপত্র জাল। ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে তারা পালিয়ে বেড়ান, অনেকেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে দিনের পর দিন বন্দি হিসাবে বিদেশের কারাগারগুলোতে কাটিয়ে দেন। এই হল বাংলাদেশ থেকে শ্রম বিক্রি করতে যাওয়া লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের
জীবনের বাস্তব চিত্র। এবার তার সাথে যুক্ত হয়েছে মৃত্যুর ঘটনা।
মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে হৃদরোগ (কার্ডিয়াক এ্যরেস্ট) এবং অন্যান্য অসুস্থতা। প্রশ্ন উঠেছে, যে শ্রমিকরা বিদেশে যান তাদের বয়সসীমা ১৮ থেকে ৪০। অর্থাৎ তারা সকলেই তরুণ। দেশ থেকে যাবার সময় প্রতিটি শ্রমিকেরই স্বাস্থ্য পরীক্ষা (মেডিক্যাল সার্টিফিকেট) করা হয় এবং তাদের সুস্থ বলে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। তাহলে ঠিক কি কারণে তারা বিদেশে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন? এখানে বলে রাখা ভাল যে বিদেশে যাওয়ার সময় শ্রমিকদের যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় তা প্রায়শই নামমাত্র, কাগজে-কলমে। টাকার বিনিময়ে গুরুতর অসুস্থ মানুষও সুস্থতার ছাড়পত্র পেয়ে যান। কিন্তু বিদেশে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার এটাই মূল কারণ নয়।
ডাক্তারদের মতে এর মূল কারণ হল কাজের অনিশ্চয়তা, বেতনের অনিশ্চয়তা, ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশ। আগেই বলা হয়েছে, যে কাজের কথা বলে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় অনেকেই সে কাজ পান না। একই ব্যাপার ঘটে বেতনের ক্ষেত্রেও। নিজেদের সব সহায়-সম্বল বিক্রি-বন্ধক দিয়ে যখন বিদেশে পাড়ি জমান সেখানে কাজ না পাওয়া, বেতন না পাওয়ায় তাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সীমা-পরিসীমা থাকে না। বৈধ কাগজপত্রের অভাবে যাদের পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শূন্য হাতে দেশে ফিরতে হয় তাদের সামনে কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। সহায়-সম্বল তো সবই গেছে।
যারা কাজ পান তাদের সে কাজ আজ আছে তো কাল নেই। যারা হাড়ভাঙা পরিশ্রমে রক্ত পানি করে সামান্য দু’চার পয়সা দেশে পাঠান তাদের শুরু হয় নতুন দুঃশ্চিন্তা। টাকাটা ঠিকভাবে দেশে পৌঁছবে তো? আত্মীয়-স্বজনরা পাবে তো? এর সাথে আরো একটি বিষয় তাদের দুঃশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেয়। প্রবাসীদের পাঠানো টাকা অনেকক্ষেত্রেই আত্মীয়-স্বজনরা নানা ভোগ-বিলাসের আয়োজনে এবং গাফিলতি করে উড়িয়ে দেয়। এ খবরটিও প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃশ্চিন্তার বোঝা বাড়িয়ে দেয়। দেশে ফিরে এসে কোন অথৈ সাগরে পড়বেন সেটা ভেবেই তারা দিশেহারা হয়ে যান। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে কার্যকর সহযোগিতা দূরে থাক, একটু বল-ভরসাও কেউ যোগায় না।
(দেশ বিদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা থেকে তথ্য ও হুবহু কিছু লিখা সংরহ। প্রবাসীর দেশ প্রেম বুঝাবার জন্য এই মূল্যবান লেখা ও তথ্যের আশ্রয় নিয়েছি। আমার দেশ, সমকাল, ইত্তেফাক, প্রথম আলো, যুগান্তর, সময়, আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ)
প্রবাসীর ক্রন্দন 7
যারা প্রবাসে বসবাস করেন, যাদের অবদান অনুদান সাহায্য সহযোগিতায় এই বাংলাদেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটে আমি শুধু সেই দেশ প্রেমিক বাংলাদেশীর একজন, আমি জানি না বাংলাদেশের মানুষ প্রবাসীর দুঃখ কেউ বুঝবে কি বুঝবে না, না বুঝারই কথা তবে আমার উচিৎ সত্য প্রকাশ করা আমি সেটাই করে যাচ্ছি। আমি চাই সবাই জানুক আমাদের এক একটি দিন রাত কেমন করে কাটে। কেমন করে এই প্রবাসী মানুষগুলো নিরাশার মাঝে বেঁচে থাকে। যে দেশে জন্ম নিলাম, যে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তের আশায় আমরা প্রতিদিন যুদ্ধ করে যাচ্ছি, নিজে খেয়ে না খেয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করার জন্য দিন রাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলি সেই দেশের মানুষ আমাদেরকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে মেনে নিতে পারে না।
বাংলাদেশের সরকার আমাদের অবদান স্বী্কার করলে কি আর না করলেই বা কি! সারা বিশ্বে্র মানুষ জানে প্রবাসী বাঙ্গালীর অবদান। ইতিহাস আমাদের কথা বলে, ইতিহাস আমাদের কর্মের সাক্ষী। আপন মানুষগুলো যখন আমাদের ঋন আস্বীকার করে তখনি কষ্ট হয়, এই কষ্ট আমাদেরকে মৃত্যু যন্ত্রনার মত এত শক্ত করে ধরে যেন হাউ মাউ করে কাঁদতে হয় । আজ পর্যন্ত আমাদেরকে ভোটের অধিকার দেয়া হয় নি। বাংলাদেশে সরকার আমাদের সাথে বিমাতা সুলব আচরন করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ তাই এই সব ভোটের অধিকার নিয়ে ভাবনার সময় নেই তবে ভাবতে গেলেই কষ্ট পেতে বাধ্য। ভোট সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে অন্য এক সময় লিখবো, আজ দেশবাসীকে আরো কিছু অজানা কষ্টের সাথে পরিচয় করে দিতে চাই।
আমরা না পারি দেশ ছাড়তে না পারি দেশে থাকতে। বাংলাদেশের মানুষ আমাদেরকে যেমন বিলেতী বলে ডাকতে ভালোবাসে ঠিক তেমনি ইংরেজরা আমাদেরকে ইন্ডিয়ান বলে ডাকতে পছন্দ করে। (বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের তেমন কোন ধারনা নেই, তাই গায়ের রঙ দেখে আমাদেরকে ইন্ডিয়ান বলে থাকে) আমরা আসলে কেউ নই,য়ামাদের কোন নাম নেই, আমাদের কোন দেশ নেই, আমাদের সব থেকেও কিছু নেই। আমাদের চোখের জল ছাড়া আমাদের নিজস্ব বলতে আর কিছুই নেই। আমরা অবহেলিত চির অবহেলিত প্রবাসী। আমরা হলাম অনাথ। প্রবাসীদের জীবন হলো নীড়হারা পাখির মত। আমাদের কোন কিছু স্থায়ী নয়। আমাদের বুকের যন্ত্রনা বুঝার মত মানুষ নেই যে যেখানে গেলে আমাদের যন্ত্রনা কারো সাথে ভাগাভাগি করবো?
আমাদের কষ্ট হয় বা আমাদের চোখে জল ঝরে এই বিষয়গুলো অনেকেই বিশ্বাস করে না। আমাদের সব সুখ সবার জন্য তবে দুঃখের ভাগ শুধু আমাদের, এই দুঃখ কেউ নিতে চায় না। বিলেতে দুই প্রকার প্রবাসীরা আছেন। ১। যারা পরিবার পরিজন নিয়ে থাকেন। ২। যাদের কেউ নেই। যাদের কেউ নেই আমি তাদের কথাই লিখবো। ওরা বড় একা,বড় অসহায়। এই ভালবাসা বঞ্ছিত মানুষের কষ্ট আমি অনেক কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে কারন এক সময় আমি তাদের খুবই কাছাকাছি ছিলাম। দায়িত্বের পাহাড় মাথায় করে যারা বয়ে বেড়ায় দিনের পর দিন, অবহেলা অনাদরে যাদের নয়ন জল অবিরাম ধারায় ঝরে পড়ে তারা আমার অতি আপনজন এই অবহেলিত মানুষগুলোকে আমি বড় বেশি ভালবাসি।
যে যন্ত্রনা একদিন আমার বুকে ছিল, যে কষ্ট আমি সহ্য করেছি বছরের পর বছর, এই কষ্টের সাথে কাউকে লড়াই করতে দেখলেই প্রানটা নিজের অজান্তে কেঁদে উঠে। এই কান্না আমি অনেক কেঁদেছি। প্রবাসের এক একটি মুহুর্ত যখন অনিশ্চয়তার মাঝে কাটে তখন জীবনকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়। স্বজনের বিরহ, মাটির বিরহ পৃথাবীর সব কষ্টের চেয়ে বড় কষ্ট। এই যন্ত্রনার সাথে যার পরিচয় হয় নি আমি বলবো জীবন সম্পর্কে তার কোন ধারনাই নেই। আপনজনের বিরহ কত যে যন্ত্রনার তা প্রবাসী জীবনের সাথে পরিচয় হবার পরই জানতে পারি। বাবা মা ভাই বোনের বিরহ অনুমান করে বুঝার কোন উপায় নেই। কাজ শেষ করে ক্লান্ত শরির যখন ঘুমের কোলে আশ্রয় নেবার কথা ঠিক তখনই শুরু হয় বিরহের পালা।
মায়ের কথা মনে পড়ে। মায়ের ভালবাসার জন্য বুক জুড়ে হাহাকার শুরু হয়। মনে পড়ে মায়ের আদরের এক একটি ক্ষন মুহুর্ত। বাবাকে ফাঁকি দিলে কেমন করে কাটগড়ায় দাড়াতে হত সব কিছু চোখের সামনে ভেসে উঠে। বাবার রাগি রাগি চেহেরাটা দেখতে ইচ্ছে হয়। বুকের পাজর আস্তে আস্তে গরম হয় আবার ঠান্ডা হয়। জোর করে চোখের জল চোখে ধরে রাখা যায় না। অবাধ্য চোখের জল শত বাঁধা উপেক্ষা করে গন্ডবেয়ে গড়িয়ে পড়ে ইচ্ছেমত। চোট ভাই বোনের আদর, ওদের নিস্পাপ মুখের আদল দেখার জন্য হৃদয় মন বদ্ধ খাঁচার পাখির মত চটপট চটপট করতে থাকে। প্রবাসীর জীবন কান্না আর বিষাদে ভরা, আমাদের জীবন কষ্ট আর বিরহ দিয়ে গড়া। আমরা কষ্ট নামক দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। আমাদের কথা কী ভাল করে জানে না। কেউ আমাদের কথা জানতে চায় না।
প্রবাসীর ক্রন্দন 8
একজন মানুষ যখন এই পৃথিবী থেকে চিরদিনের মত হারিয়ে যায়, আমরা কিছুদিন কান্না কাটি করে এক সময় শান্ত হয়ে যাই। হারিয়ে যাওয়া সেই স্বজন বা পরিচিত মুখের কথা কোন এক সময় আমরা ভূ্লে যেতে পারি। চিরতরে হারিয়ে যাওয়া মানুষের কথা ভূ্লে যেতে যতেষ্ট সময় লাগে না। যারা এই পৃথিবী থেকে চলে যায় তাদেরকে ভূ্লে যাবার জন্য হৃদয় মন এক ধরনের প্রস্তুত হয়েই থাকে বলা যায়। ঠিক একই ভাবে আমরা যারা প্রবাসী আছি তাদের কথা দেশের মানুষ ভূ্লে যায়, প্রযোজন ছাড়া আমাদের সুখ দুঃখের কথা কেউ জানতে চায় না। জানি অনেকেই আমার এই লেখা পাঠান্তে কষ্ট পাবেন তবে বাস্তবকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লিখছি, দেশের মানুষকে ছোট করার জন্য এই কথা গুলো লিখিনি।
প্রবাসীদের কষ্ট বুঝাবার জন্য লিখছি। গত ২৬ বছরের প্রবাস জীবন আমাকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে। দেশ বিদেশের মানুষকে এক কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে বলে এই কথা গুলো জানতে পেরেছি।
একজন প্রবাসী যখন অকেজো হয়ে যায় তখনই পরিবার পরিজনের আসল রূপ প্রকাশ হয়, এর আগে নয়।
দুহাত ভরে যতদিন দেবার সামর্থ থাকবে ঠিক ততদিন পরিবারের সবার কাছে প্রিয়। আমাদেরকে সুখের মাইল ফলক হিশাবে দেখা হয়। দুঃখ কষ্ট যন্ত্রনা আমাদের নিত্যদিনের সংগি। খোলা চোখে যা দেখা যায় তা দিয়েই আমাদেরকে সুখি মানুষ হিশাবে গন্য করা হয়, অথচ আমাদের বুখে জনমের শুন্যতা। একাকীত্ব প্রবাসী জীবন আমাদেকে মৃত্যুর আগে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে বাধ্য করে, এই যন্ত্রনা কাউকে বুঝানো যায় না, কষ্টের পাহাড় বুকে ধরে রেখেছি আমরা।
সুখটা কি শুধু কাড়ি কাড়ি টাকার মাঝেই সীমাবদ্ধ? কোন এক সময় আমিও তাই ভেবেছি যে টাকা পয়সা হাতে আসবে, নিজের মত করে জীবনকে সাজাবো, কষ্ট ভরা জীবনে আর কোন কষ্ট থাকবে না। সুখী সুন্দর একটা জীবনের জন্য টাকার প্রযোজনীয়তা অস্বী্কার করা যায় না তবে টাকাই যে সব সুখের মুলের মুল তা অনেকটা ভুল প্রমানিত হয়ে গেল। শুধু টাকা দিয়েই সুখী সুন্দর জীবন রচনা করা যায় না। আমার মত লক্ষ লক্ষ প্রবাসী এক বাক্যে এক মত হবেন, টাকাই সব সমস্যার সমাধান নয়। বিশেষ করে প্রবাসী জীবনের বাস্তবতা তো এই কথা বলে না। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে দেখা স্বপ্নের সাথে আজকের এই প্রবাসের কোন যোগসূ্ত্র নেই।
কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যখানে আকাশ পাতাল ব্যাবধান, কল্পনার রাজ্যে বেহিসাবী হতে কোন বাধা নিষেধ নেই, স্বপ্ন দেখতে কোন টাকা পয়সা লাগে না তাই ইচ্ছেমত কল্পনার টাকার মাঝে জীবনের সব সুখ খুঁজেছি। টাকা পয়সা ছাড়া একটা সুতাও হয় না তাও জানি তবে টাকার মাঝেই যে সব সুখ লুকিয়ে থাকে তাও সত্য নয়।
স্ব্পন আর বাস্তবের ব্যাবধান না বুঝে সংসারের জন্য একটু সুখ আর হাসি কিনতে গিয়েই আমাদের জীবনের প্রতিটি সুখ প্রবাসের মাটিতে কেঁদে কেঁদে মরে যায় যা কেউ জানতে পারে না।
দেশের আপনজনকে এই কষ্টের কথা এই যন্ত্রনার কথা জানতে দেই না, যাদের সুখের জন্য এত ত্যাগ এত অবহেলা অনাদর সহ্য করেছি সেই ভালবাসার মানুষগুলোকে কেমন করে কষ্টের কথা বলা যায়? কষ্ট আর যন্ত্রনার কথা বুক ভরা আশা নিয়ে বসে থাকা আপনজনকে বলা যায় না। যে সুখের জন্য এত দৌড় ঝাঁপ দিলাম, মা মাটি ছেড়ে অন্য এক ভূবনের বাসিন্দা হলাম, সেই সুখ নামের সোনার হরিণ তো আমাদের জীবনে এলোনা। হিসাবের কিছু সুখ যাহা অবশিষ্ট ছিল তাও আস্তে আস্তে হাতছাড়া হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় এই জীবনটা থেমে গেছে, এই যন্ত্রনা কাউকে বুঝানো যায় না। দিনরাত হাড়ভাংগা খাটুনি খেটে ঘরে ফিরে নিজেকে বড় আসহায় লাগে। এতটুকু আদর ভালবাসার জন্য মন চটপট করে মরে। আমাদের বেশির ভাগ প্রবাসীর মা নেই বাবা নেই আপনজন বলতে তেমন কী নেই যে আমাদেরকে একটু ভালবাসার কথা বলবে আমাদের কষ্টের সময় একটু সহানুভূতি দেখাবে।
একাকীত্বে্র বেদনায় আমাদের নয়নে যখন জল ঝরে কেউ আদর করে কাছে ডেকে এই জল মুছে দেয় না। নয়নের জল নয়নেই শুকায়। প্রবাসী যান্ত্রিক জীবনের সাথে যুদ্ধ করে আমরা প্রানে বেঁচে থাকি তবে এই বাঁচাকে বেঁচে থাকা বলা যায় না। আমাদের এই যান্ত্রিক জীবনের এক একটি মূহুর্ত অসম্ভব বেদনাদায়ক।
এই কষ্ট বেদনা বিরহ সহ্য করে, আমাদেরকে নতুন ভাবে শক্তি সঞ্চয় করে, অনিচ্ছাকৃ্ত এই প্রবাস জীবনের সাথে সন্ধী করে বেঁচে থাকতে হয় কারন এক ঝাক ভালবাসার মানুষ আমাদের পানে চেয়ে আছে। আমাদের ত্যাগ আপনজনকে সুখী সুন্দর কিছু মূহুর্ত দিতে সক্ষম তা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া তাই সব দুঃখ যন্ত্রনা ভূ্লে দায়িত্ব পালনে মরিয়া হয়ে উঠি। ভাইয়ের আবদার বোনের আবদার পূ্রন করতে গিয়ে নিজের পানে চেয়ে দেখার সময় থাকে না। মাসের শেষে দেশে টাকা পাঠাতে হয়, যতক্ষন বেঁচে থাকবো এই দায়িত্ব থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। অনেক সময় মাসের শেষে টাকা পাঠানো সম্ভব হয় না দেশ থেকে চিঠি আসে চিঠি ভর্তি শুধু কষ্টের কথা, প্রান হু হু করে কেঁদে উঠে, ধার দেনা করে সংসারের শান্তি ফিরিয়ে আনতে হয় যা একমাত্র প্রবাসীরাই জানেন।
প্রবাসীর ক্রন্দন 9
দীর্ঘ্য প্রবাস জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে এই লিখনীর উৎপত্তি সম্মানিত পাঠক হয়ত ভাবছেন আমি দুঃখ বিলাসী।
প্রবাসীরা দুঃখ বিলাসী হবার কোন অবকাশ নেই কারন আমরা তো একটু সুখের আশায় পাড়ি দিয়েছি অজানার দেশে, আমাদের দুটি চোখ এক চিলতে সুখ দেখার জন্য অপলকে চেয়ে আছে দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর। দুঃখ নিয়ে বিলাসীতা করার সুযোগ আমাদের নেই। দুঃখ নিবারন করার ইচ্ছা নিয়ে মা মাটি ছেড়ে অজানা অচেনা এক দেশের মাটিতে আমরা আশার ঘর বেঁধেছি, আমরা দুঃখ বিলাসী নই, আমরা সুখের কাংগাল। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সুখ খুঁজে বেড়াই।
দুঃখ বিলাসী ওরাই হয় যাদের জীবনে সুখের ছোঁয়া লাগে, যাদের জীবনে সুখ শান্তির নেই কোন অন্ত নেই কোন অভাব।
আমি তাদের কেউ নই, আমি এতটুকু সুখ সন্ধানী একজন খেটে খাওয়া মানুষ আমার জীবনে সুখের ছোঁয়া লাগে নি, প্রবাসী নিঃসংগ জীবনে সুখ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। সুখ খুঁজতে গিয়ে অবশিষ্ট সুখটুকু আমি হারিয়ে ফেলেছি।
হাজারে একজনের ভাগ্যে যদি সুখ থাকে ৯৯৯ জন বুক ভরা হাহাকার নিয়ে এই প্রবাসে ধুকে ধুকে মরছে, আমি ৯৯৯ জনের একজন তাই আমি আমার কথা বলবো ৯৯৯ জনের কথা বলবো। দু একজনের সুখের কাহিনী নাইবা শুনলেন। আমাদের কথা শুনুন এবং জেনে রাখুন যারা প্রতিদিন জীবনের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার লড়াই করে, যারা সুখের তরে সুখ হারায় ওদের কথা জেনে রাখা খুবই জরুরী কারন ওদের ত্যাগ তিতিক্ষার ফসল হল দেশবাসী আপনজনের মুখের নির্মল হাসি।
সত্যি কথা বলতে কি, প্রবাসীর কষ্ট প্রবাসী ছাড়া আর কেউ বুঝে না। অনুমান করে সব কষ্ট বুঝা যায় না। অনুমান করে যদি প্রবাসীদের কষ্ট বুঝা যেত তাহলে এই লেখার প্রয়োজন হতোনা। আমি এসব কেন লিখছি? কেন প্রবাসীদের প্রতি আমার এই দুর্বলতা? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হল আমি তাদের একজন।
দেশে বিদেশে আমাদের অসহনীয় কষ্ট যা লিখার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের কষ্টের একটি নমুনা সংযোজন করে দিলাম।
একজন ইতালি প্রবাসীর খোলা চিঠি – চিঠিটি লিখেছেন : খান লুৎফর রহমান
আমি অর্থনীতিতে এমএ পাস করে দেশে চাকরি না পেয়ে প্রবাসী হই। আমি একজন ইতালি প্রবাসী। ইতালি প্রশাসনের সঙ্গে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমি ১৯৯৫ সাল থেকে স্থানীয় প্রশাসন যেমন পৌরসভা এবং রিজিওনাল সন্মানিত কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করে আসছি। ওখানে যতবার বিদেশ বিষয়ক আইন হয়েছে সবক’টি আইনের মেম্বার হিসেবে দায়িত্ম পালন করেছি। বিগত বামপন্থি সরকারের সময় যখন সন্মানিত লিভিয়া তুর্কা ইমিগ্রেশন মন্ত্রালয়ের মন্ত্রী থাকাকালে আমি ইতালির পার্লামেন্টের একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করি এবং এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা আছে।
আমি ইতালি থেকে বাংলাদেশে আসার পরপরই রাজমণি সিনেমা হলের সামনে থেকে একটি গ্রুপ আমাকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যায় এবং একটি কাগজে লিখে নেয় তারা আমার কাছে ২০ লাখ টাকা পাবে। না দিতে পারলে তাদের প্রতি মাসে ২০% সুদ দিতে হবে। তারা এখনও মাঝে মধ্যে আমাকে টাকা দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। এ ব্যাপারে আমি রমনা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করি, যার নং-৩২৯, তাং ০৪-০৩-০৯ ইং।
দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে মোহাম্মদপুরে ৮-০৪-০৯ ইং তারিখে আমার স্ত্রীসহ একটি বাসা থেকে দাওয়াত খেয়ে ফিরছিলাম আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টায়। একটি সাদা গাড়ি আমাদের রিকশাকে আটক করে এবং গাড়ি থেকে রামদা নিয়ে তিনজন নেমে আসে। আমাদের কাছে কিছু না থাকায় আমার স্ত্রীকে ওরা কোপ দিতে আসে। ওটা আমি ঠেকানোর চেষ্টা করি। তাতে আমার বাঁ হাতে দুটি কোপ লাগে। আমার হাতের আঙুল কেটে পড়ে যাওয়ার মতো হয়। ইস্টার্ন হাসপাতালের ডাক্তার পারভেজ আমার হাতের চিকিৎসা করেন।
তৃতীয় ঘটনা ঘটে ১৬-০৫-০৯ ইং তারিখে আমি বাড়ি থেকে আসছিলাম। মিরপুর টেকনিক্যাল নামার পর বাসায় আসার জন্য একটি সিএনজি নিই। শ্যামলী শিশুপল্লী আসার পর ড্রাইভার সিএনজি নষ্ট হয়েছে বলে আমাকে জানায়। সঙ্গে সঙ্গে অচেনা তিন ব্যক্তি সিএনজিতে উঠে পড়ে এবং আমার চোখে মলম জাতীয় কিছু দিয়ে দেয় আর বুকে পিস্তল ধরে মুখে কিছু ঢুকিয়ে দেয়। এতে আমি সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যাই। এরপর আমি আর কিছু জানি না। জ্ঞান ফেরার পর একটি রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরি। তারা আমার কাছ থেকে অনেক টাকা, স্বর্ণের চেইন, আংটি এবং একটি ব্যাগ নিয়ে যায়। যার মধ্যে আমার প্রয়োজনীয় অনেক কাগজপত্র ছিল।
আমার সর্বশেষ অভিজ্ঞতা ২২-৫-০৯ ইং তারিখে আমি মোহাম্মদপুর থানায় এজাহার দিতে যাই। টাকার অংক বেশি হওয়ায় আমাকে ধমক খেতে হয় এবং মিথ্যাবাদী সাজতে হয়। এতে আমি একজন প্রবাসী হিসেবে ভীষণ লজ্জা পাই এবং ডিউটি অফিসারের কাছে ক্ষমাও চাই। এ অবস্থায় আমি বিভিন্ন থানায় ঘুরে আবার মোহাম্মদপুর থানায় আসি। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে বসে থেকে রাত ৯টায় আমি আমার এজাহারের কপি পাই। অসুস্থ একজন প্রবাসী এভাবে হয়রানির শিকার হওয়ায় সাধারণত খারাপ লাগে। ইউরোপের কোনো দেশেই এ রকম ডায়েরি করতে কিংবা এজাহার দিতে ৩০ মিনিটের বেশি লাগে না। বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। যে দেশে প্রচুর সম্ভাবনা আছে সে দেশের সম্ভাবনাকে যদি নষ্ট করে দেওয়া হয়, তাহলে দেশ যাবে কোথায় ?
এই চিঠি পড়ে আপনাদের কেমন লাগলো জানি না তবে একটা বিষয় পরিস্কার হয়ে যায় তা হলো আমরা যারা প্রবাসী তাদের নিরাপত্তা না আছে দেশে না আছে বিদেশে। এই কষ্ট কেউ বুঝে না হয়ত কেউ বুঝবে না কোনদিন।
প্রবাসীর ক্রন্দন 10
আজকের প্রসঙ্গ একটু ভিন্ন, কষ্টের কথা আজ লিখব না। কষ্টের কথা না হয় আগামী সপ্তাহে লিখবো, আজ কিছু আনন্দ সবার সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার চেষ্টা করবো।
গত ১৩ তারিখ আমার প্রিয় বন্ধু বাইস কাদিরের চিত্র পদর্শনী দেখতে লন্ডনের ব্রাডি সেন্টারে গিয়েছিলাম এবং শিল্পীকে কথা দিয়েছিলাম সময় করে কিছু লিখবো তাই আজকের এই লেখার সূচনা।
সামনে বসে কারো প্রসংশা করা আমার রুচিবিরুদ্ধ, নিজেকে কেমন গোপাল ভাঁড় গোপাল ভাঁড় টাইপ বলে মনে হয়। যাক সে সব কথা।
যারা খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলে, যাদের চিন্তা চেতনায় মানুষের সুখ দুঃখের চিত্র ফুটে উঠে আমি তাদেরকে শুদ্ধ সঠিক এবং সাদা মনের মানুষ বলে মনে করি।বাংলাদেশে যে ক’জন হিসেবের চিত্রশিল্পী আছেন(এই প্রজন্মের) বাইস কাদির মাধ্যে অন্যতম। যার তুলির আচঁড়ে ফুটে উঠে বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের জিবন্ত ছবি, অন্যায় অবিচারের নগ্নরূপ। বাংলার বাউলের উদাসী ভাব, হিংসুটে আত্মার কদাকার চেহারা, ভুল ধারার রাজনিতীর অন্ধকার বিভিন্ন দিক, এক’ই সাথে নির্যাতিত মানুষের প্রতি ভালোবাসার প্রমান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার প্রতিটি শিল্পকর্মে।
রঙ তুলির সাহায্যে মানুষের বিবেক জাগিয়ে তোলার অসাধ্য সাধন করে চলেছেন বাইস কাদির। মানুষের বিবেক জাগিয়ে তোলার যে মাধ্যম তিনি সাধন করেছেন তা প্রসংশনীয়।
তার এক একটি চিত্র মানুষের কষ্টের কথা বলে, বুকফাটা কান্নার হাহাকার বেজে উঠে যা আমাকে বার বার মুগ্ধ করে। এত সুন্দর এবং সাবলীল ভাবে মনের অনুভুতি গুলো ফুটিয়ে তুলেছেন তার একটা উদাহরন না দিলে বিষয়টা পরিস্কার হবে না। “চিন্তা” নামক চিত্রটি আমাকে অসম্ভব ভাবিয়ে তুলেছে।
এত সচ্ছ এবং সত্যমন্ডিত চিত্রকর্ম সচরাচর দেখিনা। আমরা যখন বাস্তবতাকে ফাকি দিয়ে কল্পনায় আরো একটা জগত সৃষ্টি করে নিজের ইচ্ছেমত বসবাস করি তার জলন্ত এক ছবি দেখতে পেলাম এবং পাশাপাশি বাস্তব জীবনের চিত্র আশে পাশে পড়ে থাকতেও দেখলাম। এত দূ্রদর্শী চিন্তা অনেক চিত্র কর্মেই ঝলমল করে তার দূ্রদর্শী চিন্তা চেতনার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে বার বার।
কল্পনায় মানুষ নিজের ইচ্ছেমত সুখ খুজে নিতে পারে, যার কোন সীমা পরিসীমা নেই। কল্পনার আর বাস্তবের মাঝামাঝি যে ব্যাবধান তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমান করতে সক্ষম হয়েছেন।
বাইস কাদির আমাদের কল্পনাকে বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে আসতে খুব বেশি জায়গা নষ্ট করেন নি। ছোট্ট পরিসরে জীবনের এক একটি দিক এত সহজ এবং সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন যা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়, এবং প্রতিটি চিত্রকর্ম সহজবোধ্য।
একজন বাঙ্গালী হয়ে দেশে বিদেশে আমাদের জন্য সন্মান বয়ে নিয়ে আসার জন্য চিত্রশিল্পী বাইস কাদিরকে আমি অভিনন্দন জানাই।
সোনার বাংলার সোনার ছেলে বলতে যা বুঝায় বাইস কাদির হলে ঠিক তাই। ভদ্র নম্র ব্যাবহারের জলন্ত প্রমান আমাদের এই সোনার বাংলার সোনার ছেলে।
চিত্রশিল্পী বাইস কাদির ভবিষ্যতে আমাদেরকে আরো অনেক কিছুই দিতে সক্ষম যার প্রমান আমরা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছি।এমন একজন গুনী মানুষের সাথে পরিচিত হবার পর নিজেকে অসম্ভব ভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছে। আমি এই গুনী শিল্পীর উজ্জ্বল ভবিষ্যত কমনা করছি। আমার বিশ্বাস এমন একদিন আসবে যেদিন শিল্পী বাইস কাদিরের পরিচিতি আমাদেরকে সন্মানের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে যাবে।
মন্তব্য চালু নেই