মেয়েদের ধর্ষণ থেকে বাঁচতে হলে যা করতে হবে
আমেরিকার দশটি রাজ্যে কলেজ ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার স্বার্থে ছাত্রীদের বন্দুক রাখবার অনুমতি দিতে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ করতে চাইছেন কিছু জনপ্রতিনিধি। তাঁরা বলছেন, ছাত্রীদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র আছে জানলে তাঁদের ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থার আশঙ্কা কমবে, সম্ভাব্য হানাদাররা আর তাদের বিরক্ত করতে সাহস করবে না।
রাস্তাঘাটে আত্মরক্ষার হাতিয়ার রাখার কথা আমাদের দেশেও এখন পরিচিত, কিন্তু তাই বলে কলেজ ক্যাম্পাসে বন্দুক? উত্তর লুকিয়ে আছে আমেরিকার ইতিহাসে, তার সংবিধানে প্রদত্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার ইতিহাসে। সেই সংবিধানের ‘সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট’ নামক সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র রাখার মৌলিক অধিকার নাগরিকের আছে।
ব্যক্তিস্বাধীনতাকে আমেরিকা এতটাই মূল্য দেয়। এবং এই অধিকারটি কাজে লাগিয়েই সে দেশে অস্ত্র-ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে প্রতিপত্তি বিস্তার করেছে। ‘গান লবি’র সেখানে বেজায় ক্ষমতা। নাগরিকদের অস্ত্র রাখবার এবং অস্ত্র কেনবার স্বাধীনতা বহু রাজ্যের আইনেই জোরদার।
যেখানে সেখানে, বিশেষ করে স্কুলকলেজে থেকে থেকেই বন্দুকবাজের গুলিতে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটে, তখন অস্ত্র রাখার অধিকার খর্ব করার জন্যে দাবি ওঠে, কিন্তু বিশেষ লাভ হয় না। বারাক ওবামাও দু’বছর আগে সেই অধিকার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি, সেনেট আটকে দিয়েছে। কলেজ ক্যাম্পাসে আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে দেওয়ার নতুন উদ্যোগটির পিছনেও বন্দুক-লবি-র অবদান আছে। কতটা কার্যকর হবে এ উদ্যোগ, সময়ই বলবে, তবে ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে অস্ত্র-ব্যবসায়ীরা যে ভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে, তাতে সত্যিই ব্যক্তির স্বাধীনতা কতটা রক্ষিত হচ্ছে, সে প্রশ্ন ওঠে বইকী।
তার সঙ্গে সঙ্গেই ওঠে দায়িত্বের প্রশ্ন। কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। সেই দায় ঝেড়ে ফেলে ‘তোমরা বাপু নিজেরা নিজেদের সামলাও’ বলে একখান করে বন্দুক মেয়েদের হাতে তুলে দেওয়াটা কি খুব উচিত কাজ? তা হলে তো রাষ্ট্রও তার নাগরিকদের হাতে একটি করে বন্দুক ধরিয়ে বলতে পারে, নিজ নিরাপত্তা নিজ দায়িত্বে রাখুন, পকেটমারি হলে কর্তৃপক্ষ দায়ী না! প্রয়োজনে বন্দুক দিয়ে হিংসা বা অন্যায় দমন করার আইনি অধিকার কেবলমাত্র রাষ্ট্রেরই রয়েছে। সেই অধিকার আর কাউকে দিলে সেটা অনৈতিক অধিকার হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আত্মরক্ষার্থে গুলি বা অন্য অস্ত্র চালালে তো সেটা অন্যায় নয়, আইনেও তার অনুমতি মিলতে পারে। পারে, কিন্তু হঠাৎ তৈরি হওয়া পরিস্থিতিতে নিজেকে রক্ষা করার জন্য গুলি চালালাম বা রড দিয়ে মারলাম, আর আগে থেকে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থেকে এক জনকে মারতেই পারি এবং মেরে ফেললাম এই দুটো পরিস্থিতি চরিত্রে আলাদা। আবার এ প্রশ্নও উঠতে পারে যে, আত্মরক্ষার জন্য মেয়েদের ব্যাগে পেপার স্প্রে গোছের ‘অস্ত্র’ রাখা যদি অন্যায় না হয়, তা হলে বন্দুকই বা নয় কেন? এ দুটো ব্যাপারও আলাদা, তার সহজ কারণ চোখ জ্বালা করা প্রাণটা চলে যাওয়া এক নয়।
ক্যাম্পাসে বন্দুক নিয়ে চলাফেরার পক্ষে আইন চাইছেন যাঁরা, তাঁরা অবশ্য বলবেন, আগে থেকে তৈরি থাকলে তবেই মেয়েরা বিপদে পড়লে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পাবে, হানাদারদের বলতে পারবে, এ বার পথে এসো বাছাধনরা। লাগতে আসবে আর মেয়েদের সঙ্গে? মুশকিল হল, বাস্তবে ব্যাপারটা তেমন মাখন-মসৃণ না-ও হতে পারে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণ বা হেনস্থাকারীরা চেনা-পরিচিত, বন্ধুবান্ধব। এই ধারা দুনিয়া জুড়েই, ভারতেও যেমন, আমেরিকাতেও তেমন। তো, একটা পরিচিত মানুষের সঙ্গে মেশার সময় মেয়েরা হাতের কাছে বন্দুক নিয়ে আলাপচারিতায় বসবে বা বিপন্ন হয়ে সেই বন্দুক বের করবে, এটা ভাবা একটু বাড়াবাড়ি বোধ হয়। আবার যদি তেমনটা হয়ও, তা হলেও এই বন্দুক দিয়ে আত্মরক্ষার ব্যাপারটায় নানান ফাঁক থেকে যাচ্ছে না কি?
একে তো সেই ধরনের পরিস্থিতিতে মেয়েটা ঘাবড়ে থাকবে বা মাদকাসক্তও থাকতে পারে, তার মধ্যে মাথা ঠান্ডা ও লক্ষ্য স্থির রেখে ছেলেটাকে গুলি করবে বা ভয় দেখাবে এমনটা থ্রিলার-এর শেষ দৃশ্যে সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে? এবং, ছেলেরা সচরাচর মেয়েদের চেয়ে শারীরিক ভাবে সবল (‘তা হলে মেয়েরা কেন বাসে লেডিস সিট চাইছে’ ইত্যাদি ছেঁদো কথাগুলো ঝুলি থেকে বার করবেন না প্লিজ), অতএব মেয়েটার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়ে ছেলেটা তাকেই ঘায়েল করবে না, তার গ্যারান্টি নেই।
ধরা যাক, এমনটা হবে না, মেয়েরা ব্যাকপকেটে বা কলেজের ব্যাগে চেম্বার বহন করবে আর ঘুরতে ফিরতে বলবে, ‘অব গোলি খা!’ কিন্তু যদি এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, সহপাঠী আদরের ছলে হেনস্থা করতে যাচ্ছিল আর মেয়েটি সেই মুহূর্তে মনে করল হয়তো বা বিষম কিছু ঘটতে চলেছে তার জীবনে, এবং সে ভয়ে বা আতঙ্কে বন্দুক চালিয়ে দিল?
আর, পরে যদি মেয়েটির মনে হয়, হয়তো ব্যাপারটা তেমন গুরুতর ছিল না যাতে একটা প্রাণ নষ্ট করে ফেলা যায়, ভুল শোধরানোর একটা জায়গা ছিল! কে বলতে পারে! সেই মেয়েটি এই মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে সারাটা জীবন খুব ভাল থাকবে তো? এতে তার মানসিক আত্মরক্ষা হবে? বাকি জীবনে সে অন্য ছেলেদের সঙ্গে সুস্থ ভাবে মিশতে পারবে?
শুধু কি তা-ই? কোনও মেয়ে যদি বিপদে পড়ে বা বিপদ ভেবে গুলি চালায়, আদালতে তো তাকে জবাবদিহি করতে হবে। তখন তো রাষ্ট্র তার হয়ে সওয়াল-জবাব করতে আসবে না। প্রতিপক্ষের উকিল যখন বলবে যে, ‘তুমি কী করে জানলে যে ছেলেটি তোমায় ধর্ষণ বা খুন করত?’ তখন মেয়েটি যদি বলে, ‘আমার মনে হয়েছিল, ও আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।’ তখন ফের সওয়াল উঠবে, ‘ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মানেই কি খুন বা ধর্ষণ করত? তুমি এ-রকমটা ধরে নিলে কেন? তুমি তো আসলে এক জন মানসিক রোগী!’ এর উত্তর রাষ্ট্র দেবে না। রাষ্ট্র তখন বলবে, আমি তোমার আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক দিয়ে দিয়েছি, এ বার তুমি চালাবে কি না, কোন পরিস্থিতিতে চালাবে, সে সব তোমার দায়িত্ব।
আবার মেয়েরা সতত মহান ও বিপন্ন, এমন ভাবারও দরকার নেই। পুরনো কিংবা নতুন প্রতিশোধের স্পৃহা চরিতার্থ করার জন্য একটা মেয়ে বন্দুক চালিয়ে দেবে না, তার গ্যারান্টি নেই। যেমন আমাদের এখানে ৪৯৮এ ধারার অপব্যবহার হয়, কে বলতে পারে আত্মরক্ষার অস্ত্র রাখার তেমন ফল হবে না? কখন আত্মরক্ষা আক্রমণে পরিণত হবে, কেউ জানে না।
আর একটা কথা। শেষ কথাও বলা যায়, গোড়ার কথাও বলা যায়। যখনই একটি মেয়ে ব্যাগে রাখছে বন্দুক (কিংবা পেপার স্প্রে অথবা ছোট্ট বোতাম দেওয়া ছুরি যা এক নিমেষে স্যাট করে খুলে যায়), তখনই তো সে এই ধারণাটির বশীভূত হচ্ছে যে, সে আক্রান্ত হতে পারে, অপমানিত হতে পারে, তার গায়ে হাত দেওয়া হতে পারে, তার নিজস্ব স্পেসটি যত্রতত্র লঙ্ঘনের শিকার হতে পারে! অতএব তাকে সর্বক্ষণ নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে! আত্মরক্ষার প্রয়োজনটা কঠোর বাস্তব।
কিন্তু সেই বাস্তবটার মোকাবিলা করতে গিয়ে একটা আত্মিক সংকট তৈরি হচ্ছে না কি? আমার কাছে আত্মরক্ষার বর্ম বা হাতিয়ার আছে, সেটা যেমন আমায় ভরসা দেবে, তেমনি আমাকে এক মুহূর্তও ভুলতে দেবে না যে, বিপন্নতা আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। আমি রাত্রের শো’তে সিনেমা দেখতে যাই কিংবা পার্টিতে মজা করতে যাই এই বিপন্নতার ভাবনা আমার যৌন অস্তিত্বকে নাগাড়ে মনে করিয়ে দেবে এবং মনে করিয়ে দেবে যে, সেই যৌন অস্তিত্বের কারণে আমি সব সময় লঙ্ঘনযোগ্য। বন্দুক না থাকলেও হয়তো এ ভয় থাকত, কিন্তু বন্দুকটা আছে বলেই সে ভয়কে এক মুহূর্তও ভুলতে পারব না আমি। তা হলে মেয়েরা যায় কোথায়?
সূত্র : অানন্দবাজার পত্রিকা
মন্তব্য চালু নেই