গা শিউরে ওঠা চড়ক পূজা

হিন্দু ধর্ম মতে চৈত্র মাসের শেষ থেকে বৈশাখ মাসের প্রথম পর্যন্ত ভক্তরা মহাদেব শিবঠাকুরের আরাধনা করতে থাকেন। মহাদেবের সন্তুষ্টি লাভের আশায় সপ্তাহব্যাপী নানান পূজার আয়োজন করেন তারা। ফলপূজা, কাদা পূজা, নীল পূজাসহ সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন পূজা পালন শেষে আয়োজন করা হয় গা শিউরে উঠা চড়ক পূজা।

চড়ক পূজায় পিঠে বাণ ফুড়িয়ে চড়ক গাছের সঙ্গে বাশঁ দিয়ে তৈরি করা বিশেষ এক ধরনের চড়কায় ঝুলন্ত দড়ির সঙ্গে পিঠের বড়শি বেঁধে দেওয়া হয়। তখন বাণ বিদ্ধ সন্ন্যাসীরা শূণ্যে ঝুলতে থাকেন। রাতে নীল পূজার পর সন্ন্যাসীরা উপোস থাকেন। পরদিন বিকেলে এ চড়ক পূজা শেষেই উপোস ভাঙেন তারা।

চড়ক পূজার শুরুতে শিবপাঁচালী পাঠক মন্ত্রপড়া শুরু করলে সন্ন্যাসীরা শিবধ্বনি দিতে দিতে নদীতে স্নান করতে যান। স্নান শেষ করে মাটির কলসি ভরে জল আনেন তারা। এরপর চড়ক গাছের গোড়ায় গোল হয়ে দাঁড়ান সন্ন্যাসীরা। আবার শিবপাঁচালী পাঠ করতে থাকেন বালা (শিবপাঁচালী পাঠক)। সন্ন্যাসীরা চড়ক গাছে জল ঢেলে প্রণাম করে চলে যান ফাঁকা জায়গায়। চড়ক পূজাসেখানেই তাদের বাণবিদ্ধ করা হয়। সন্ন্যাসীরা নিজের শরীর বড়শিতে বিঁধে চড়কগাছে ঝুলে শূণ্যে ঘুরতে থাকেন। আবার সন্ন্যাসীর আর্শীবাদ লাভের আশায় শিশু সন্তানদের শূন্যে তুলে দেন অভিভাবকরা। সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে কখনও কখনও শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদ ও করেন। এ অব্স্থায় একহাতে বেতের তৈরি বিশেষ লাঠি ঘুরাতে থাকেন আর অন্য হাতে দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে বাতাসা ছেটান এই ঝুলন্ত সন্ন্যাসীরা। তাদের বিশ্বাস জগতে যারা শিব ঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের জন্য স্বেচ্ছায় এত কঠিন আরাধনার পথ বেছে নিয়েছেন বিনিময়ে পরলোকে শিবঠাকুর তাদের স্বর্গে যাওয়ার বর দেবেন।
চড়ক পূজা কবে কিভাবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পূজা প্রচলন করেন। রাজ পরিবারের লোকজন এই পূজা আরম্ভ করলেও চড়কপূজা কখনও রাজ-রাজড়াদের পূজা ছিল না। এটি ছিল হিন্দু সমাজের লোকসংস্কৃতি। পূজার সন্ন্যাসীরা প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মের কথিত নিচু সম্প্রদায়ের লোক। তাই এ পূজায় এখনও কোন ব্রাহ্মনের প্রয়োজন পড়ে না।

চৈত্র সংক্রন্তির ১৫ অথবা ৭ দিন আগ থেকে শুরু হয় চড়কের প্রস্তুতি। উৎসবের আমেজ শুরু হয় গ্রামের বারোয়ারি তলায়, শ্মশানে কিংবা গৃহস্থ বাড়ির আঙিনায়। যেখানে আর যেভাবেই এই উৎসব উপস্থাপিত হোক না কেন এর মূল আবহ জুড়ে থাকে কৃষি দেবতা শিবের আবাহন। শিবই এই উৎসবের মুখ্য। তাই শিবকে সন্তুষ্ট করাই পূজারীদের উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, বগুড়া, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা প্রভৃতি জেলায় চড়ক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। স্থানগুলো একটু ভালো করে খেয়াল করলেই দেখা যায়, বাংলাদেশের যে অঞ্চলগুলো মূলত কৃষিপ্রধান সেখানেই চড়কপূজা উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলার প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার শরীরে প্রবেশ করতে হলে এরকম উৎসবগুলোকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলেই কেবল লৌকিক বাংলার আদিরূপ দেখা সম্ভব হবে।



মন্তব্য চালু নেই