ভেতরে-বাইরে দুই রূপে সুয়ারেজ
বার্সেলোনায় হঠাৎই লিওনেল মেসি এবং নেইমারের কাছাকাছি জনপ্রিয়তায় পৌঁছে গেলেন লুইস সুয়ারেজ। ফিরে পেলেন লিভারপুলের সোনালি ফর্ম। দশ মাস আগের বিশ্বকাপে যে তিনি খলনায়ক হয়েছিলেন, ভুলে গেছে সবাই। সেই সুয়ারেজকে নিয়েই নানা দিক থেকে কাটাছেঁড়া করেছেন তাঁর তিন ঘনিষ্ঠতম স্ত্রী সোয়িফা বালবি, বড় ভাই পাওলো সুয়ারেজ এবং দীর্ঘদিনের সতীর্থ দিয়েগো ফোরলান। পাঠকদের জন্য সেগুলোই উপস্থাপন করা হল…
ব্যক্তি সুয়ারেজ
সোফিয়া বালবি : যে সময় ওর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা, তখন আমি ১২, সুয়ারেজ ১৫। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত ওর ব্যক্তিত্ব একটুও বদল হয়নি। পার্থক্য একটাই। ওকে এখন টিভিতে বেশি দেখা যায়। আগের থেকে বেশি লাজুক হয়েছে। কিন্তু মানুষটা একই আছে, তাই ওকে আমি এখনও ভালোবাসি।
পাওলো সুয়ারেজ: আমি ওর থেকে ছ’বছরের বড়। আমি যখন বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতাম, তখন সেও খেলতে চাইতো। ছোট বলে তখন বড়দের সঙ্গে খেলতে মোটেই ভয় পেত না। আমার বন্ধুরাও তাই খুব সহজে ওর সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। কিন্তু সে যখন সবাইকে ড্রিবল করে চলে যেত, তখন অবশ্য তাদের ভালো লাগত না!
দিয়েগো ফোরলান: ও যখন উরুগুয়ের অনূর্ধ্ব২০’র টিমের সদস্য, তখন প্রথম দেখা। একটা ওয়ার্ম আপ ম্যাচ খেলেছিলাম ওদের সঙ্গে। কানাডায় বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচ ছিল সেটা। তখনই তার প্রতিভা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তবে জাতীয় দলে ঢোকার আগে ওর সঙ্গে আমার তেমন কথা হয়নি।
২০১৪ বিশ্বকাপ
ফোরলান : আমরা বুঝতেই পারিনি সে চিয়েল্লিনিকে কামড়ে দিয়েছে। যখন বুঝতে পারলাম, তখন মারাত্মক আহত হয়েছিলাম। লুইস-এর ক্ষেত্রে আগেও এই সমস্যা হয়েছে। তাই তখনই বুঝতে পারছিলাম, এর শাস্তি কী হতে চলেছে। এটাও বুঝে যাই, এটা উরুগুয়ের জন্য কতটা খারাপ হল।
সোফিয়া: উরুগুয়েতে লুইস যে রকম সমর্থন পেয়েছে, ভাবা যায় না। সবার কাছ থেকে এক রকমের প্রতিক্রিয়া হয়তো আশা করা যায় না। কিন্তু, বেশিরভাগ মানুষই ওর পাশে থেকেছে। আমি চোখের সামনে এ সব দেখেছি। ভালো লেগেছে। তবে, অতীতেও এমন কঠিন দিন আমরা দেখেছি। বিশ্বকাপ থেকে আমরা যখন ফিরে আসি, তখন সর্বত্র মারাত্মক আলোচনা ওকে নিয়ে। সব সময় টিভি ক্যামেরা, সংবাদপত্রের সাংবাদিক বাড়ির সামনে। সুয়ারেজ বাড়ির বাইরে বেরোতেই চাইত না। কিছু দিন একেবারে নিজেকে বন্দি করে রেখেছিল।
ফোরলান : পরে শুনেছি, উরুগুয়েতে মানুষজন তার শাস্তির পরে ক্ষেপে গিয়েছিল। চার মাস খেলতে না পারার শাস্তিটা ওদের খুবই বেশি মনে হয়েছিল। আমারও তাই মনে হয়। আমি জানতাম, লুইস বুঝতে পেরেছে, সে একটা ভুল করেছে। ক্ষমাও চেয়েছিল। ভুল থেকে শিক্ষাও নিয়েছিল। তারপরও কেন এত বড় শাস্তি? দেশের সকলে ওকে ভালোবাসে। তাই তাদের প্রিয় ফুটবলারকে বিশ্বকাপে আর দেখতে পাবে না জেনে ক্ষেপে গিয়েছিল।
সুয়ারেজের দুই দিক
ফোরলান: মাঠের মধ্যে এবং মাঠের বাইরে তার চরিত্রের বিরাট পার্থক্য রয়েছে। মাঠের মধ্যে সে একজন ফাইটার। জয়ের জন্য যা ইচ্ছে, তাই করতে পারে। মরিয়া বলতে আমরা যা বুঝি, সে তাই। কিন্তু, মাঠের বাইরে তার চেয়ে ভদ্রলোক আর হয় না। ফ্যামিলি ম্যান বলতে যা বোঝায়, সুয়ারেজ একদম তাই।
সোফিয়া : যে লোকটা ফুটবল খেলে এবং যে লোকটা বাড়িতে আমার সঙ্গে থাকে, এই দু’টো মানুষ আলাদা। এদের একেবারে উল্টো প্রকৃতির দু’টো লোক বলতে পারেন। ফুটবল খেলতে গিয়ে সে যা করে, বাড়িতে কিন্তু মোটেই তা করে না। বাড়িতে খুবই শান্ত। বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটায়।
বার্সেলোনায় পা রাখা
সোফিয়া : আমার এখনও বিশ্বাসই হয় না, যে এটা সত্যি হয়েছে। সে যখন বার্সেলোনায় প্রথম ম্যাচ খেলছে, তখন আমি এমনভাবে ওর ম্যাচ দেখেছিলাম, যেন মনে হচ্ছে যে আমি ওর খেলা প্রথমবার দেখছি। আমি এতটাই নার্ভাস ছিলাম। জানতাম, এটা তার কাছে ঠিক কত বড় ব্যাপার। এখনও মাঝেমাঝে আমার ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হয় না। বছর শেষে সে ট্রফি জিতবে কি না, সেটাই এখন চ্যালেঞ্জ। আসলে কী জানেন, বার্সেলোনা আমাদের দ্বিতীয় বাড়ি। আক্ষরিক অর্থেই। আমার বাবা-মা এখানে থাকেন। আমাদের দ্বিতীয় সন্তানও এখানে জন্মেছে। প্রচুর আত্মীয় চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাই, তার সঙ্গে সম্পর্কের পর আমাদের এটা রূপকথার মতো মনে হত, যে সে একদিন বার্সেলোনায় খেলবে। সেটা যে দিন সত্যি হল, কী আনন্দ যে হয়েছিল, বলে বোঝাতে পারব না। সে যে দিন প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচে বার্সেলোনার হয়ে গোল করল, সেই মুহূর্তটা কখনও কি ভোলা যাবে? আমি মাঠে ছিলাম না। আমার ছেলে বেঞ্জামিনের একটা ছোট দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তাই তাকে নিয়ে একটু বোরোতে হয়েছিল। কিন্তু, সে দিনও আমি বাড়ি ফিরে টিভিতে গোলটা দেখতে ভুলিনি। ওটা লুইসের প্রথম গোল। আমার ওর জন্য গর্ব হয়।
ফোরলান: এটা তার স্বপ্ন ছিল। তার স্ত্রী, পরিবার ওখানে অনেক দিন ধরে থাকে। তাই সে প্রতিনিয়তই ওখানে যেত। তা ছাড়া বার্সোলোনা শহরটার ফুটবল প্রেমের কথা সবাই জানে। তাই সে যে অনেক দিন থেকেই বার্সেলোনায় খেলতে চাইবে, তা খুবই স্বাভাবিক। আমি যত দূর জানি, তার ছোট থেকে স্বপ্ন ছিল বার্সেলোনায় খেলা।
পাওলো : লুইসের সঙ্গে আমরা সবাই একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। তার বড় হওয়া, ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠা… সবই তো আমাদের চোখের সামনে। তার বড় ভাই হিসেবে, উরুগুয়ের নাগরিক হিসেবে আমরা খুবই গর্বিত। দেশের জার্সি গায়ে তো কম বিখ্যাত লোক খেলেনেনি। তাই সেই নীল জার্সি গায়ে ওকে যখন প্রথম বিশ্বকাপে দেখি, তখন যে কত আনন্দ হয়েছিল বলে বোঝাতে পারব না। আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতে ওর থেকে এমন ভালো লাগার মুহূর্ত আরও অনেক অনেক আসবে।
লুইসকে তিনটি শব্দে বর্ণনা
সোফিয়া : (একটু ভেবে ) আমি পারব না, মাপ করবেন!
ফোরলান : ডিটারমাইন্ড , ফাইটার , ফ্যামিলি ম্যান।
মন্তব্য চালু নেই