এ কেমন বর্বরতা- শিবগঞ্জে নৃশংসভাবে খুন দুই স্কুলছাত্রী
শিশু লতিফা (৯) ও আঁখি (৯) তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। দুই জনই বেশ মেধাবী। প্রতিদিনের মতোই ২৮শে মার্চ সকালে গলা ধরাধরি করে বই-খাতা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় স্কুলের পথে। স্কুল ছুটি হলেও ঘরে ফেরেনি তারা। গতকাল দুপুরে গ্রাম থেকে আধা কিলোমিটার দূরের এক ভুট্টা খেতে মিলে তাদের মস্তক ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গবিহীন ক্ষতবিক্ষত লাশ। দুর্বৃত্তরা নৃশংসভাবে শিশু দুটিকে হত্যার পর কিডনিসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গও কেটে নিয়ে গেছে। কেটে নিয়ে গেছে মাথা। এই রোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নের পদ্মা তীরের সীমান্তবর্তী গ্রাম কানছিড়া ডাক্তারপাড়ায়। ফুলের মতো ফুটফুটে শিশু দুটির নির্মম এই হত্যাকাণ্ডে গ্রামজুড়ে ক্ষোভের পাশাপাশি শোকের ছায়া নেমে এসেছে। লতিফা ও আঁখিকে চিরতরে হারিয়ে তাদের পরিবার ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে এলাকার বাতাস। শোকে কাতর চর বাবুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার দাবি করেছেন তারা। কেউ কেউ বলছেন অঙ্গ পাচারকারী সিন্ডিকেট এ ঘটনা ঘটিয়েছে। পুলিশ বলছে ময়নাতদন্তের পরই জানা যাবে কিভাবে শিশু দুটিকে হত্যা করা হয়েছে। তবে লতিফা ও আঁখির পরিবারসহ গ্রামবাসী অভিযোগ দেয়ার পরও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ এনেছেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সেদিন উপজেলা সদর থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণ- পশ্চিমের পদ্মার তীরবর্তী কানছিড়া ডাক্তারপাড়া গ্রামের আবদুল লতিফের ছোট মেয়ে ৯ বছরের লতিফা ও আশরাফুলের বড় মেয়ে আঁখি প্রতিদিনকার মতো বই-খাতা নিয়ে সকালে স্কুলের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয়। দুপুরে স্কুল ছুটির পর বাড়িতে না ফেরায় পরিবারের পক্ষে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাড়িতেও খোঁজা হয়। পরিবারের লোকজন আশপাশের গ্রাম ও আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে ফোন করে খোঁজ নেন। অবশেষে মসজিদের মাইক থেকে মাইকিং করা হয়। কিন্তু কোথাও তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এভাবে কেটে যায় আরো একটি দিন। অবশেষে গ্রামবাসীর পরামর্শে ৩০শে মার্চ আবদুল লতিফ ও আশরাফুল শিবগঞ্জ থানায় পৃথক দুটি সাধারণ ডায়েরি করেন। গতকাল সকালে কানছিড়া ডাক্তারপাড়ার বেলালসহ আরো কয়েকজন জমিতে গম কাটছিলেন। ভুট্টা খেতের যে জায়গাটায় শিশু দুটির লাশ পাওয়া যায় তার উত্তরে গম কাটছিলেন বেলালরা। বেলালের ভাষায় সকাল থেকেই দক্ষিণা বাতাসে উৎকট গন্ধ নাকে লাগছিল। কোথায় কিছু মরে আছে মনে হলেও বাতাসের গতি বাড়তে থাকায় মরা গন্ধ আরো তীব্র হয়ে ওঠে। এসময় সবাই মিলে গন্ধকে অনুসরণ করে কিছুটা এগোতেই ভুট্টা খেতের মাঝামাঝি দেখতে পায় একটি শিশুর গলাকাটা লাশ। তার একশ’ গজ দূরে মিলে আরেক শিশুর ক্ষত-বিক্ষত দেহ। মুহূর্তের মধ্যেই খবরটি ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে। গ্রামের শত শত মানুষ ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। ছুটে আসেন লতিফার বাবা আব্দুল লতিফ ও আঁখির বাবা আশরাফুলসহ ভাইবোনেরা। পরনের জামা কাপড় দেখেই লাশের পরিচয় শনাক্ত করে পরিবার। পুলিশকে খবর দেয়া হলে শিবগঞ্জ থানার ওসি ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায় ময়নাতদন্তের জন্য।
হত্যার পর কেটে নেয়া হয়েছে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ: বুধবার দুপুরের পর ঘটনাস্থলে পৌঁছে দুই শিশু লতিফা ও আঁখির লাশের সুরতহাল প্রস্তুত করেন শিবগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুরে আলম। সুরতহাল প্রতিবেদনে দেখা যায় হত্যার পর দুর্বৃত্তরা শিশু দুটির মাথার চুল কেটে ফেলে। লাশের কাছেই পড়ে রয়েছে কাটা চুলের গোছা। দুটি লাশের কোনটিতেই মাথা নেই। জামা কাপড় ও স্যান্ডেল পড়ে রয়েছে লাশের খানিকটা দূরে। এসআই নুরে আলম বলেন, শিশু দুটিকে কাছাকাছি জায়গায় পৃথক দুটি স্থানে গলা কেটে হত্যা করা হয়। মস্তকও দুর্বৃত্তরা নিয়ে গেছে। দুই লাশেরই পীঠের নিচে গর্ত করে কাটা। এতে ধারণা করা হচ্ছে শিশু দুটির কিডনিগুলো কেটে নিয়েছে হত্যাকারীরা। লতিফার একটি পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ঘটনাস্থলে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখে ধারণা করা হচ্ছে গলা কেটেই শিশু দুটিকে হত্যার পর অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো কেটে নেয়া হয়েছে। নুরে আলম বলেন, শিশু দুটির খুন নৃশংসতায় পূর্ণ। শিবগঞ্জ থানার ওসি মইনুল ইসলাম বলেন, যেদিন নিখোঁজ হয়েছে সেদিনই শিশু দুটিকে হত্যা করা হয় বলে আমরা ধারণা করছি। তবে ময়নাতদন্তে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
পরিবারের অভিযোগ পেয়েও ঘটনাস্থলে যায়নি পুলিশ: ২৮শে মার্চ শিশুছাত্রী লতিফা ও আঁখি নিখোঁজের একদিন পর ৩০শে মার্চ শিবগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন দুই শিশুর বাবা। কিন্তু গ্রাম থেকে আকস্মিকভাবে দুটি স্কুলপড়ুয়া শিশু নিখোঁজ হলেও পুলিশ এব্যাপারে নিয়মমাফিক বার্তা প্রেরণ ছাড়া আর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থলে কোন কর্মকর্তাকেও পাঠানো হয়নি। আঁখির বাবা আশরাফুল বলেন, অভিযোগ পাওয়ার দিন পুলিশ গ্রামে আসলে দুর্বৃত্তদের কাউকে না কাউকে ধরা যেত। লতিফার বাবা আব্দুল লতিফ বলেন, পুলিশ তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিলে ঘটনার পরপরই খুনিরা ধরা পড়তো। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওসি বলেন, পুলিশ দুই শিশুর নিখোঁজের ব্যাপারে দেশের সব থানাতে বার্তা পাঠিয়েছে। তবে জিডিগুলো তদন্তের দায়িত্ব কাদের দেয়া হয়েছিল তা জানাতে পারেননি তিনি। এদিকে শিশু আঁখির পরিবারে চলছে শোকের মাতম। আঁখির মা লিপি খাতুন ঘটনা শোনার পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আঁখির মা শুধু বলছেন তোমরা আমার মেয়েকে এনে দাও। স্কুলে যাওয়ার আগে বলেছিল ফিরে এসে নানী বাড়ি যাবে। আমার আঁখিকে তোমরা এনে দাও। এব্যাপারে শিবগঞ্জ থানার ওসি এসএম মইনুল ইসলাম বলেন, ধারণা করা হচ্ছে গ্রামেরই কতিপয় দুর্বৃত্ত শিশু দুটিকে ফুঁসলিয়ে গ্রামের বাইরে ভুট্টা খেতের দিকে নিয়ে যায়। তারা ধর্ষণের পর ঘটনা জানাজানির আশঙ্কায় শিশু দুটিকে হত্যা করে। হত্যার পর লাশ গুম করার চেষ্টা করার কারণেই মাথা কেটে নিয়ে গেছে। দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো কেটে নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হতে পারে এগুলো কেটে পার্শ্ববর্তী পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চুরি কোন সিন্ডিকেটের কাজ কিনা সেটি নিশ্চিত নয় পুলিশ। খুনিরা ধরা পড়লে বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে তিনি মনে করছেন। ওসি আরো বলেন, শিশু আঁখির বাবা আশরাফুল ও তার মা লিপি গ্রামেরই কয়েকজনের নাম বলেছে যারা লতিফা ও আঁখি নিখোঁজের পর থেকে গ্রামের বাইরে অবস্থান করছে। এসব যুবকদের আচরণও ঘটনার পর থেকে সন্দেহজনক বলে ওসি জানিয়েছেন। তবে দ্রুত খুনিদের শনাক্ত করার আশা করছেন তিনি।
মন্তব্য চালু নেই