অবশেষে স্বস্তি এনে দিল নির্বাচন!
অবশেষে তাহলে স্বস্তি নেমে এলো জনমানসে! কেটে গেছে আতঙ্ক, বাইরে বের হলে বা দূরপাল্লার বাসে মধ্যরাতে ঘুমের মধ্যে পেট্রোলবোমায় পুড়ে মরার ভয় নেই, আচমকা দুর্বৃত্তদের আক্রমণের শিকার হয়ে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের দিগবিদিক ছুটে যাওয়ার দৃশ্যও আর দেখতে হবে না। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই যেন পরিস্থিতিটা অনেকখানি নিরাপদ বোধ হতে শুরু করেছে। বিরোধী দল হরতাল থেকে সরে গেছে। অবরোধ এখনো অব্যাহত থাকলেও তা অকার্যকর হয়ে গেছে অনেক আগেই। আশা করা হচ্ছে, শিগগিরই অবরোধও তুলে নেয়া হবে।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে গত জানুয়ারি থেকে টানা আন্দোলন চালিয়ে আসছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। অনির্দিষ্টকালের অবরোধ আর নিয়মিত বিরতিতে হরতাল সারা দেশে দুর্বিষহ করে তুলেছে জনজীবন। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির কথা বললেও এ পর্যন্ত সহিংসতায় ১২৮ জন নিহত হয়েছেন যার মধ্যে ৭২ জনই পেট্রোলবোমা ও আগুনে দগ্ধ। সহস্রাধিক গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে অথবা আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থনীতিতে নেমে এসেছে স্থবিরতা। জনমনে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
কিন্তু আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছে। এমন বোধ যেমন নাগরিকদের মধ্যে তেমনি বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট আশা করছে, এই নির্বাচন চলমান সঙ্কট সমাধানেরও পথ দেখাবে।
চলমান আন্দোলন আর আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন তথা সার্বিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বিএনপি জোট। নির্বাচনে ফলাফল যা-ই হোক না কেন এ নিয়ে আশায় বুক বাঁধছে নেতাকর্মীরা।
আড়াই মাসের অধিক সময় ধরে অবরোধের পাশাপাশি হরতাল কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে এই জোট। কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকেই নেতাকর্মীরা রয়েছেন আত্মগোপনে। অনেকে রয়েছেন কারাগারে। বিএনপি জোট নেতাকর্মীদের অনেক পরিবারের অবস্থা শোচনীয়।
এর মধ্যেই চলছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আমেজ। প্রথমে এ নিয়ে বিএনপি জোটের অনীহা থাকলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রবল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে। আর বিএনপি জোটের এমন অবস্থান পরিবর্তনের পর সঙ্গত কারণেই কর্মসূচিতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কর্মকৌশলে নতুনত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাধারণত সপ্তাহের পাঁচ দিন হরতাল থাকলেও এ সপ্তাহে হরতাল ঘোষণা হয়নি। এবার এসেছে বিক্ষোভ কর্মসূচি। এছাড়া টানা হরতাল অবরোধেও কার্যত সরকারের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। নেতাকর্মীরাও ক্লান্ত।
এ অবস্থায় সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে লক্ষ্য করে বিএনপি জোটের বহুমুখি পরিকল্পনা রয়েছে। নেতাদের মতে, বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলগুলো বিএনপি জোটের পকেটে জমা হয়েছে। তাই সরকারকে স্থানীয় নির্বচানে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেয়া হবে না। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি জোট যে ভুল করেছে এবার তা করতে চাইছে না তারা। পাশাপাশি এই নির্বাচনকে ঘিরে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগও খুঁজছে বিএনপি জোট। জনগণের সরাসরি সমর্থন যোগ্য কর্মসূচি নিয়ে চিন্তা করছে তারা।
২০ দলীয় জোটের পরিবর্তিত কর্মসূচি প্রসঙ্গে জোটের শরিক ন্যাপ ভাসানীর মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কারণে ২০ দলীয় জোট কৌশলী ভূমিকায় রয়েছে।’
বিএনপির পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা আসেনি। যদিও আইন অনুযায়ী, এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এখানে দলীয়ভাবে ঘোষণা দেয়ার কিছু নেই। অবশ্য আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং বাম ও ডান দলগুলো নিজ নিজ প্রার্থী ঘোষণা করেছে।
বিএনপি এখনো বলছে, নির্বাচনের লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি হয়নি। তাদের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক মামলায় কারাগারে অথবা আত্মগোপনে আছে। এ জন্য তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তাদের কাছে পরিস্থিতি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুকূল মনে হলে কেবল তখই নির্বাচনে যাবেন। অবশ্য ইতিমধ্যে তিন সিটি করপোরেশনে তিন জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
অবশ্য লেভেল প্লেইং ফিল্ড না থাকা, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা- এসব কথা বিএনপি আসলে চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে বলে মনে করছেন রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা।
এ ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছি, প্রস্তুতি নিচ্ছি। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ চাই। যার কারণে নিয়মিত হরতাল আর থাকছে না।’
তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচন সরকারের একটা ফাঁদ। তারপরেও আমরা এই নির্বচানে অংশ নিচ্ছি। এই নির্বাচনে যদি সরকার কারচুপি করে তাহলে আমাদের আন্দোলন আরো চাঙা হবে। আর যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে বাংলাদেশের মানুষ বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে রায় দেবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম পরামর্শক রাষ্ট্র বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি না হলে বিএনপি এ নির্বাচন থেকে সরে আসতে পারে।’
বিএনপির পক্ষ থেকে যাই বলা হোক লাগাতার কর্মসূচি থেকে সরে আসার ফলে জনমনে যে স্বস্তি ফিরে এসেছে তা অনেকের সঙ্গে কথা বলে বুঝা গেল।
যেমন বিএনপি জোটের হরতাল মুক্ত কর্মসূচির খবরে প্রাণ ফিরে পেয়েছেন শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ি আশরাফ মোল্লা। তিনি বলেন, ‘হরতাল অবরোধের কারণে আমার ব্যবসার চরম ক্ষতি হয়েছে। ফুল ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে।’
আশরাফ মোল্লা বলেন, ‘হরতাল নাই শুনে ভালো লাগছে। আমি মহা খুশি। পেট্রোলবোমার আতঙ্ক নেই। ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারবো। পরিবার পরিজন নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে পারবো।’
হরতাল না দেয়ার কারণে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদ উপস্থাপিকা মার্জিয়া মান্নান বিএনপি জোটের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘হরতাল অবরোধে আতঙ্ক নিয়ে চলাচল করি। এর মধ্যে গতকাল (শুক্রবার) আমার বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করলাম। হরতাল অবরোধের কারণে ইচ্ছামতো অনুষ্ঠান করতে পারিনি।’
গুলশানের গৃহিনী ঐশী চৌধুরী হরতাল না থাকার খবের উল্লাস প্রকাশ করে বলেন, ‘চরম আতঙ্কের মধ্যে আমার দুই সন্তানকে স্কুল কলেজে আনা নেয়া করি। দম বন্ধ হয়ে আসে। হরতাল এবং অবরোধ একটি অকার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি।’
মন্তব্য চালু নেই