আজ ভয়াল ২৫শে মার্চ
আজ ভয়াল ২৫শে মার্চ। আজ থেকে ৪৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীদের উপর অন্যায়ভাবে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে।
পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়লে একটি জনযুদ্ধের আদলে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। পঁচিশে মার্চের কাল রাতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ঢাকায় অজস্র সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পুলিশ হত্যা করে।
সেদিন গ্রেফতার করা হয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল আওয়ামী লীগ প্রধান বাঙালীর প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেফতারের পূর্বে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
২৫ মার্চ, ১৯৭১-এর রাতে সমগ্র ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয় ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কয়েকটি সুসজ্জিত দল ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধপূর্ব বেশ কয়েকটি আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় পাকিন্তানীদের প্রধান টার্গেট ছিল এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিকড় উপড়ে ফেলা।
তারই অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল ১৮নং পাঞ্জাব, ২২নং বেলুচ, ৩২নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটেলিয়ন। এই বাহিনীগুলোর অস্ত্রসম্ভারের মাঝে ছিল ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক, ভারি মর্টার, হালকা মেশিনগান ইত্যাদি। এই সমস্ত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। ইউনিট নং ৪১ পূর্ব দিক থেকে, ইউনিট নং ৮৮ দক্ষিণ দিক থেকে এবং ইউনিট নং ২৬ উত্তর দিকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলে।
২৫ মার্চের গণহত্যার (অপারেশন সার্চলাইট) প্রথম পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষককে হত্যা করা হয়।
অসহযোগ আন্দোলন মূলত গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলের ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন পরিষদ’কে কেন্দ্র করে। তাই, পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্য ছিল এই হলটি। অধ্যাপক ড. ক ম মুনিমের মতে, ওই রাতে এই হলের প্রায় ২০০ জন ছাত্রকে পাকবাহিনী গুলিবর্ষণ করে হত্যা করে।
২৫ মার্চের কালরাতে বাঙালীদের প্রথম প্রতিরোধ গড়ে উঠে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে।
সে রাত সম্পর্কে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান পুলিশে ওয়্যারলেস অপারেটর হিসাবে কর্মরত মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টা। আমরা শুনতে পেলাম পাকিস্তানী সেনারা ট্যাংক, মর্টার ও ভারি মেশিনগান নিয়ে এসেছে এবং আমাদের ঘিরে ফেলেছে। আমরা কেবলমাত্র ৩০৩জন পুলিশ ছিলাম।সবার হাতে ছিল রাইফেল।’
শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘আমাদের হাতে অস্ত্র বলতে কেবল ৩০৩ রাইফেল। পুলিশের সাহসী যোদ্ধাদের নিয়ে আমরা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সামগ্রিক শক্তির মোকাবেলা করলাম। সম্মুখযুদ্ধে ওই রাতে পুলিশের প্রায় ১৫০ সদস্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।’
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সে রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার হলো আরও ৩০০০জনকে। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলে মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। গোটা বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।’
পাকিস্তানীদের পরিকল্পিত গণহত্যার মুখে পূর্ব পাকিস্তানের সারাদেশে শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ। জীবন বাঁচাতে প্রায় ১ কোটি মানুষ পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, সামরিক বাহিনীর বাঙালী সদস্য এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ দেশকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর কব্জা থেকে মুক্ত করতে কয়েক মাসের মধ্যে গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী সারাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।
পরবর্তী সময়ে লাখো বাঙালী শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করি।
মন্তব্য চালু নেই